অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের পথ তৈরি করতে পারে, বাস্তবায়ন করুক নির্বাচিত সরকার
নিয়মিত সরকারের কর্মকাণ্ড মূল্যায়নের জন্য ১০০ দিন খুব বেশি সময় নয়। আর এই বিশেষ ধরনের সরকারের ক্ষেত্রে আমাদের আরও নমনীয় হতে হবে। তবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ১০০ দিনে এই সরকার কী কী দায়িত্ব পালন করতে পারতেন এবং কী কী দায়িত্ব পালন করেছেন তার একটি পর্যালোচনা হতে পারে। বর্তমান সরকারের ভূমিকাকে আরও কার্যকর করার জন্যই এ ধরনের পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। নিয়মিত সরকারের চেয়ে এই সরকারের আবার অনেক কিছু করার সুযোগ বেশি। কারণ এই সরকারের কোনো রাজনৈতিক পিছুটান নেই। তারা চাইলে জনস্বার্থে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবেন। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হবার কারণে তাদের কাছে প্রত্যাশা বেশি। তাদের ভোটের চিন্তা নেই। যদি জনগণের আকাঙ্ক্ষা তাদের হিসাবের মধ্যে থাকে তাহলেই তারা অনেক অর্থবহ কাজ করতে পারবেন।
এর আগের দলীয় সরকারের ভয়াবহ অত্যাচার-অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ক্ষোভের কারণেই তারা বিগত সরকারকে হটিয়ে দিয়েছে। এ জন্য তারা জীবন দিতেও দ্বিধা করেনি। কাজেই প্রথম থেকেই বর্তমান সরকারের গণপ্রত্যাশার প্রতি মনোযোগ থাকতে হবে। এই সরকার যেহেতু নির্বাচিত সরকার নয়, তাই তারা ইচ্ছে করলেও অনেক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। তারা তা না পারলেও সংস্কারের পথ রেখা তৈরি করে দিতে পারবেন। কিছু কিছু সংস্কার কার্যক্রম আছে, যা বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন আছে, কিছু সংস্কার কার্যক্রম আছে যা বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচিত সরকার থাকা প্রয়োজন। কাজেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে অনেক ধরনের সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। তবে তারা সংস্কারের রূপরেখা তৈরি করে দিতে পারবেন। নির্বাচিত সরকার এসে সেই অসমাপ্ত সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবেন।
একটি সফল গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হবার পর এই সরকারের যেসব কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা প্রয়োজন ছিল, তার মধ্যে কিছু সমস্যা ও দুর্বলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে আন্দোলন চলাকালে যারা নিহত এবং আহত হয়েছেন, তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা। আমি এটা মেনে নিতে রাজি নই যে, তিন মাসের মধ্যে এই কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। উদ্যোগ নিলে অবশ্যই তিন মাসের মধ্যে আন্দোলন চলাকালে আহত-নিহতদের একটি স্বচ্ছ এবং পূর্ণাঙ্গ তালিকা অবশ্যই তৈরি করা যেত; কিন্তু সেটা এখনো করা হয়নি। দায়িত্ব গ্রহণের পর যদি প্রশাসনিক পর্যায় থেকে নিহত ও আহতদের তালিকা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেয়া হতো, তাহলে এই তালিকা ইতিমধ্যেই প্রণীত হয়ে যেত। এই তালিকা প্রণয়ন জরুরি ছিল কারণ এদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা নিহত বা আহত হয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই শ্রমজীবী পরিবারের সদস্য।
স্বচ্ছল এবং শহরের স্থায়ী পরিবারের সন্তানদের অনুপাত কম। তার বাইরে যারা নিহত বা আহত হয়েছেন তাদের একটি বড় অংশও কম আয়ের শ্রমজীবী মানুষ। এরকম যে পরিবারের একজন সদস্য মারা গেছেন সেই পরিবারটি ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে। যারা আহত হয়েছেন, তাদের অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কাজেই এসব পরিবারের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহযোগিতা বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা আবশ্যক ছিল; কিন্তু এখনো সে ধরনের কোনো উদ্যোগ প্রত্যক্ষ করা যায়নি। যারা জীবনের বিনিময়ে একটি সরকারের পতন ঘটাল, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে কেন এত বিলম্ব, এটা আমি বুঝতে পারছি না। সরকারের ১০০ দিন পূর্তির পর আমরা দেখলাম, আন্দোলন চলাকালে যারা আহত হয়েছেন তারা নিজেরাই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসার দাবিতে রাস্তায় এসে বিক্ষোভ করছেন। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? আন্দোলনে আহত-নিহতদের তো পুনর্বাসনের জন্য প্রশাসনের কাছে যাওয়ার কথা নয়। বরং প্রশাসনই তাদের কাছে যাবে। ছাত্র আন্দোলনের নিহত ও আহতদের তালিকা চূড়ান্ত প্রণয়ন এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে না পারা বড় ধরনের ঘাটতি বলে আমি মনে করি।
বিভিন্ন স্থানে কারখানা শ্রমিকরা বকেয়া মজুরির দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন। আমার প্রশ্ন হলো শ্রমিকরা কেন বকেয়া মজুরির দাবিতে রাস্তায় থাকবেন? এমনিতেই তো তাদের মজুরি খুবই কম, তার ওপর যদি একজন শ্রমিকের ২-৩ মাসের বা তারও বেশি মজুরি বকেয়া থাকে, তাহলে তার সংসার চলবে কী করে? এই সমস্যা সমাধানের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছিল। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কারখানা মালিকদের সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, অক্টোবর মাসের ১০ তারিখের মধ্যে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ করা হবে; কিন্তু সেটা করা হয়নি। এখনো কেন কারখানা শ্রমিকরা বকেয়া মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন? সরকারকে তো শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে হবে। কারখানা মালিকদের বাধ্য করতে হবে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য। কারখানা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারিত সময়ে পরিশোধে ব্যর্থতা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
সরকার পতনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল। সে সময় হয়তো সেটা ঠেকানোর কেউ ছিল না; কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ১০০ দিন অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নানা সমস্যা দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ছিঁচকে চুরি থেকে শুরু করে বড় ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। দলগত সহিংসতার ব্যাপারটিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। সাধারণ মানুষকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি পীড়িত করছে, তা হচ্ছে জীবনযাত্রায় ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া। প্রায় দুবছর ধরে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। করোনা-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি যখন উত্তরণের পর্যায়ে ছিল, তখন ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়।
ফলে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দেয়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এর মধ্যেই মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিট অতিক্রম করে গেছে। এর মধ্যে খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বিপদে আছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের শ্রমজীবী মানুষগুলো জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বিপর্যস্ত অবস্থায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিদায়ী সরকার জনগণের ক্ষোভের মধ্যে পড়ে, বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ১০০ দিনে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু এ ক্ষেত্রে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো উদ্যোগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না।উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা না গেলে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়বে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে বেশ কিছু কমিশন গঠিত হয়েছে। কমিশনে যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তাদের অনেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তি। কমিশন তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করলে তার সুপারিশের ভিত্তিতে একে একে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আশা করা যায়। তবে এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো এবং আন্দোলনে নিহত ও আহতদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। ব্যাংকিং সেক্টর অনেক দিন ধরেই নানা জটিল সমস্যায় ভুগছে। আমানতকারিরা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় টাকা উত্তোলন করতে পারছে না। অধিকাংশ ব্যাংকই তারল্য সংকটে ভুগছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ সর্বশেষ হিসাবে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। বাংলাদেশে ৬০টি ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে এত ব্যাংকের কোনো দরকার ছিল না; কিছু লোকের পকেটে জনগণের টাকা তুলে দেয়ার জন্য এগুলো খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
এরা জনগণের অর্থ লুটে নেয়ার জন্যই ব্যাংক স্থাপন করেছেন। পুরো ব্যাংকিং খাতের সংস্কার তাই করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকিং আইন মহল বিশেষের স্বার্থে পরিবর্তন করে এই খাতকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। ব্যাংকিং আইনগুলো পর্যালোচনা করে যথাযথ সংস্কার করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে কোনো দেশই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে না। বাংলাদেশের গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি, পরিবেশ বিনাশী বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ এসব করা হয়েছে বিশ্বব্যাংক এবং এডিবির নানা প্রকল্পের সূত্র ধরেই। তাদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে এবং তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ যেভাবে সাধারণ মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কোণঠাসা হয়েছে, সেই অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানো তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে। তাদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যারা খুন লুণ্ঠন, পাচার, অত্যাচারের জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তদন্ত করে কঠোর সাজার আওতায় আনতে হবে; কিন্তু বিভিন্ন স্থানে ঢালাও মামলার যে প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। যেভাবে মামলা করা হচ্ছে, তাতে মামলাগুলোর অধিকাংশই টিকবে না। আওয়ামী লীগ আমলে পাইকারি মামলার প্রবণতা অমরা প্রত্যক্ষ করেছি। গ্রেপ্তার বাণিজ্য হয়েছে। সেই অবস্থা এখন তো থাকার কথা নয়, কিন্তু বাস্তবে অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। এমন সব মামলা করা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ যা বিশ্বাস করছে না।
গত সরকার আমলে দেশের সম্পদ লুট করার জন্য কয়েকটি চিহ্নিত গোষ্ঠীকে সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। তারা ব্যাপকভাবে দেশের সম্পদ লুটে নিয়ে বাইরে পাচার করেছে। পাচারকৃত এই অর্থ ফেরত আনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা একান্ত জরুরি। পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার কাজটি সহজ নয়। তবে অসম্ভবও নয়। তাই উদ্যোগ নিতে হবে। যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করা যেতে পারে, যাতে আমরা সহজেই পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে পারি। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অবস্থা এখনো ভালো নয়। রিজার্ভ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলেছেন, সংস্কার কার্যক্রম শেষ হলে নির্বাচন দেয়া হবে; কিন্তু সংস্কারের নামে নির্বাচনকে বিলম্বিত করা হলে সাধারণ মানুষের মনে শঙ্কা ও অনাস্থা সৃষ্টি হতে পারে। তাই স্বল্পকালীন সময়ের মধ্যে যেসব সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব, তা করে দ্রুত যথাযথ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে