Views Bangladesh Logo

শেখ হাসিনার পতনের ৬ মাস

জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘাটতি আছে: বিএনপি

Kamrul  Hasan

কামরুল হাসান

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ৬ মাস পূর্ণ হলো বুধবার (৫ আগস্ট)। গত বছর ৫ আগস্ট  ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে টানা সাড়ে ১৫ বছরের ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হন দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি চলে যান ভারতে।

এর তিন দিন পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সরকার পরিচালনায় সম্পৃক্ত করা হয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদেরও।

ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনে নতুন দেশ গড়ায় তার প্রতি আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়েই দেশের শাসনভার নিয়েছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

তবে ৬ মাস পরে এসে রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ দেশবাসী বলছেন, নানা সমস্যা, গুজব এবং ঘটনার আবর্তে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনস্থাপনই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের।

এ বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে দেশের বৃহত্তম দুদলের একটি বিএনপি। বলছে, সংবিধান বলবৎ রেখে এগিয়ে চলা এই সরকার মূল বিষয়গুলোকে পাশ কাটালেও ছুটে চলেছে অনেক অগুরুত্বর্ণ ইস্যুর পেছনে। সাধারণ মানুষের কল্যাণমূলক কাজ যেমন নিত্যপণ্যের মূল্য কমানো, দেশে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষাসহ জনদুর্ভোগ দূর করার মতো বিষয়গুলোতে মনোযোগ না থাকার অভিযোগ তুলে ইউনূস সরকারের সমালোচনাও করছে দলটি।

সংস্কার নিয়ে জোরালো বক্তব্য তোলা হচ্ছে; কিন্তু তা সাধনে খুব একটা তাদের তৎপর দেখছেন না বিএনপির নেতারা। বরং নির্বাচন আয়োজন থেকে সরকার নিজেদের দূরে রাখছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জনগণ এতো বড় গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যে ম্যান্ডেট দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেগুলোর বাস্তবায়নে ধীরগতি জনমনে শঙ্কা তৈরি করছে। জনআকাঙ্ক্ষা পূরণের সেই স্বপ্ন ম্লান হতে বসেছে'।

'জনগণ আশা করেছিল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। নিত্যপণ্যের দাম কমবে। সেগুলো কিন্তু খুব একটা করা সম্ভব হয়নি। আবার, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল; কিন্তু সেখানেও দেখা যাচ্ছে ঢিলেঢালা ভাব'- বলেন তিনি।

সালাহউদ্দিনের অভিযোগ, নির্বাচনের রোডম্যাপ দিচ্ছে না এই অস্থায়ী সরকার। আবার যে সংস্কারের কথা বলে তারা নির্বাচনে দেরি করতে চাচ্ছে, সে সংস্কারের পথেও তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপও নেয়নি। ফলে সংস্কারের কাজও এখনো দৃশ্যমান নয়'।

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন এবং স্বল্পমেয়াদি সংস্কারের প্রস্তাবগুলো এগিয়ে নেয়াই এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ব্যর্থতা বললেও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, গত ৬ মাসে এই সরকারের অনেক ব্যর্থতা থাকলেও কিছু সফলতাও কিন্তু আছে। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক দুর্নীতি বের করে এনেছেন। নানা সমস্যা ও দেশি- বৈদেশিক চাপের মধ্যেও দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে সরকারকে সুসংহত করতে পেরেছেন এবং অনেক কালো আইন তারা বাতিল করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছেন'।

তবে এ সময়ে তাদের ব্যর্থতার পাল্লাও কিন্তু কম নয় উল্লেখ করে আলাল বলেন, সরকারের প্রধান কাজ ছিল তিনটি। দেশে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, বিগত দিনের সব অপরাধের বিচার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মধ্যে আছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, নিত্যপণ্যের দাম কমানো, অর্থনীতি সচল ও স্বাভাবিক রাখা, পুরোনো চাকরির স্থলে নতুন চাকরি তৈরি করা এবং নির্বাচিত নতুন সরকার আসার আগ পর্যন্ত অর্থনৈতিক কাঠামো টিকিয়ে রাখা'।

বিএনপি নেতারা আরও বলেন, 'সরকারের উচিৎ ছিল দ্রুত নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু এমন কোনে কার্যকর পদক্ষেপ আমরা দেখতে পারছি না। আর বিচার, এ ক্ষেত্রে তো পুরোই গোঁজামিল। না বিচারকাজ ঠিকমতো এগোচ্ছে, না অপরাধীরা ধরা পড়ছে। এমনকি সেনাপ্রধান সেনানিবাসে আশ্রয় নেয়া অনেক আওয়ামী লীগ নেতার কথা বললেও তারা কোথায় এখন কেউ জানে না। অর্থাৎ সরকার এবং এর অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজেদের সদিচ্ছা প্রমাণেরও অনেক বিষয় থেকেই যাচ্ছে'।

'মনে রাখতে হবে, এসব কাজে যতো দেরি হবে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমও ততোই স্থবির হবে এবং পণ্যের দাম বাড়বে। আর তাহলে সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন কমবে বৈ বাড়বে না'।

কেমন ছিল এই দিন
জুলাই মাসজুড়ে চলা কোটা সংস্কার আন্দোলন ২ আগস্ট রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে দ্রোহযাত্রা শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশে জড়ো হন নানা শ্রেণি-পেশার লাখো মানুষ। মূলত সেদিনই প্রথম প্রশ্ন উঠে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

জনসমর্থন শূন্যের কোটায় জেনেও শুধু বল প্রয়োগ করেই ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকর আওয়ামী লীগ। ৩ ও ৪ আগস্টও ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। অসহযোগের ধারাবাহিকতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৬ আগস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ডাকে। কারফিউ ভেঙে জনতার ঢল নামে রাজপথে।

৫ আগস্টের শুরুটা হয় উৎকণ্ঠা ও একইসঙ্গে নতুন স্বপ্ন নিয়ে। আগের দিনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা একদিন এগিয়ে ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট লংমার্চ ডাকেন। জাতীয় কোনো নেতা না হলেও তাদের ডাকে সাড়া দেন দেশের অগণিত মানুষ।

৫ আগস্টের সকালে ছিল গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। শাহবাগকে ঘিরে মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ। ঢাকায় ঢোকার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেন তারা। ছিল সেনাবাহিনীও। সকালে রাস্তায় মানুষই জড়ো হতে পারেননি। পুলিশের ছোড়া টিয়ার গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেডেও যখন গণআন্দোলন দমানো যাচ্ছিল না, তখনই ফের বন্ধ করে দেয়া হয় ইন্টারনেট।

জুলাইয়েও বার বার ইন্টারনেট বন্ধ রেখে ছাত্র-জনতার আন্দোলন রুখে দেয়ার পাঁয়তারা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এবারও তাদের পরিকল্পনা ছিল একই। এবার অবশ্য কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসেনি।

সময় যতো গড়াতে থাকে, বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। দুপুর ১১টা নাগাদ কারফিউ ভেঙে লাখো মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। এক পর্যায়ে শাহবাগ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। অবস্থা বেগতিক দেখে সেনাবাহিনী প্রধানের পরামর্শে ক্ষমতা ত্যাগ করে ভারতে চলে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন তার বোন শেখ রেহানা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ