Views Bangladesh Logo

অন্তর্বর্তী সরকারকে কয়েকটি আশু দায়িত্ব নির্ধারণ করতে হবে

০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে যে অন্ধকার যুগের সূচনা হয়েছিল, সেই অন্ধকার ধীরে ধীরে সমগ্র দেশ ও জাতিকে গ্রাস করেছিল। নেমে এসেছিল জাতীয় জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, লুটপাট, হত্যা, গুম, অপহরণ, খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণ, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সমগ্র সমাজকে পঙ্গু করে ফেলে। এর ফলে দেশ ও জাতি গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।

ইউরোপের মধ্যযুগকে বলা হতো অন্ধকার যুগ। কারণ তখনকার যাজক-শাসক শ্রেণির সীমাহীন শোষণ, নির্যাতন, অত্যাচার, অনাচারে মানুষের জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ ও দুঃখ-কষ্ট। অবশেষে পঞ্চদশ শতাব্দীতে (১৪৫৩ সালে) রেনেসাঁসের সূত্রপাত এবং তারই ধারাবাহিকতায় রিফরমেশন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানুষ মুক্তির সন্ধান লাভ করে। শেষ হয় অন্ধকার যুগের, সূত্রপাত হয় আধুনিক যুগের। রেনেসাঁস ঘোষণা করে মানুষের মুক্তি। নিজস্ব শক্তিতে বলিয়ান, কর্মঠ, যুক্তিঋদ্ধ বিপ্লবের পর বিপ্লবের ভেতর দিয়ে ইউরোপের সমাজ ও সভ্যতাকে বিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

শাসক শ্রেণির শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, সীমাহীন দুর্নীতি, শেয়ারবাজার লুট, কুইক রেন্টাল, বিদ্যুৎ প্রকল্প ও সর্বোপরি সরকারদলীয় পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক টাকা লুটের মাধ্যমে দেশকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে; যার ফলে এ দেশের জনগণের কপালে নেমে এসেছে অসহনীয় এবং অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।

ফ্যাসিবাদ, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্রের যুগ পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করেছি গণতন্ত্রের যুগে। সারা বিশ্বের মানুষ আজ স্বাধীনতা এবং সাম্যের জয়গানে মুখরিত। তাই স্বাধীনতা কথাটি সবার কাছে অতিপ্রিয়। তাই বলেছিলাম, যে কোনো জাতির জীবনে বা জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং গৌরবময় অধ্যায় হলো সে জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম। বাংলাদেশের বাঙালি জাতির সবচেয়ে মহান অর্জন তার স্বাধীনতা। এ জাতির সবচেয়ে গর্বের বিষয় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা যুদ্ধ তাই আমাদের এক পরম গর্বের বিষয়।

১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করার পর অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বিশ্বে সাম্য ও গণতন্ত্রের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। ইতিহাসের এক পরম দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের সেই বহু লালিত স্বপ্ন থেকে যায় সুদূরপরাহত, কোনো এক অজ্ঞাত অন্ধকারে নিমজ্জিত। এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির অন্যতম প্রধান কারণ গণতন্ত্রহীনতা। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গণতন্ত্র হচ্ছে উন্নয়ন ও অধিকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন; যার অনুপস্থিতি বা বিকৃতি একটি রাষ্ট্র বা সমাজের প্রকৃত বন্ধনমুক্তির সব পথ রুদ্ধ করে দেয়।

মানব ইতিহাসে একাধিকবার দেখা গেছে ফ্যাসিবাদের নির্মম ও নিষ্ঠুর পরিণতি। হিটলার, মুসোলিনি প্রভৃতি ফ্যাসিবাদীর একনায়কতান্ত্রিক দাম্ভিকতা এবং ক্ষমতার নিরঙ্কুশ আস্ফালন অচিরেই নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের নির্ধারিত আস্তাকুঁড়ে, তবে ইতিহাসেরই নির্মম পৃষ্ঠার দিকে দৃষ্টি পড়ে না অনেক ফ্যাসিবাদী শাসকের।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, ইতিহাসের এই শিক্ষা এখনো ফ্যাসিবাদী শাসকরা গ্রহণ করেননি। তারা আজও ক্ষমতার অহঙ্কারে স্ফীত হয়ে দুর্দান্ত প্রতাপে শাসন ও শোষণের বল্গাহীন অশ্বের পিঠে সওয়ার হয়ে আছেন।

বাংলাদেশে গত দেড় দশকে প্রতি মুহূর্তে প্রত্যক্ষ করেছে ফ্যাসিবাদের বিলুপ্ত প্রেতাত্মার পুনরুত্থান। এক নিষ্ঠুর ও নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদের কবলে পড়ে আমাদের স্বদেশ; এর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জনগণের মৌলিক চাহিদা তথা সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক সুস্থতা। গত দেড় দশকে এই ধারা গণতন্ত্রের কবর রচনা করে জনগণের সর্বপ্রকার অধিকার হরণ করেছে। অপহরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে নির্বাচন চুরি।

সম্পূর্ণ অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং এই অবৈধ দখলকে কায়েম রাখার স্বার্থে গুম, হত্যা, বিনাবিচারে আটক, নির্বিচার গ্রেপ্তার তথা সব ধরনের রাষ্ট্রীয় ত্রাস ও সন্ত্রাসের এক বীভৎস রাজত্ব গড়ে তোলা হয়। সীমাহীনভাবে অবিরাম লঙ্ঘন করা হয় মানবাধিকার।

এসবের পাশাপাশি অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলে জনগণ ও রাষ্ট্রের সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন। জাতীয় সম্পদ লুট করে এরা বিদেশে পাচার করছে, গড়ে তুলছে সম্পদের পাহাড়। গণতন্ত্রহীনতার এমন এক দুর্বিষহ দুষ্কালে প্রতিবাদের কণ্ঠগুলো স্তব্ধ করার হীন প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। আমরা অবশ্যই ইতিহাসের অনিবার্য গতি ও পরিণতির শিক্ষা ভুলে যেতে পারি না। আমরা ইতিহাসের প্রতি উদাসীন থাকলেও ইতিহাস জড়িয়ে থাকে আমাদের জীবনের পরতে পরতে।

বিশ্বের মুক্তিপাগল মানুষের মতোই বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, ছাত্রসমাজ ও জনগণ স্বৈরাচারের শাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে গণআন্দোলন গড়ে তোলে। সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী ও শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ের সঙ্গে দেশের সুশীল সমাজ একযোগে এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, গুম ও শোষণ-বঞ্চনার কথা সবার জানা। তার অলিন্দ উপচে পড়েছিল স্বৈরাচারের সর্বপ্রকার উপাদানে- কী অর্থনীতি, কী রাজনীতি, কী সমাজ-সংস্কৃতি- সর্বত্র হাসিনার আগ্রাসী স্বৈরতন্ত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো। বিশ্বের বহু স্বৈরাচারীর অসংখ্য ‘কীর্তি’ বিবর্ণ হয়ে গেছে হাসিনার ‘মহাকীর্তির’ কাছে। আলাদীনের দৈত্য ফ্যাসিবাদের সবগুলো চেরাগ ধরিয়ে দেয় হাসিনার হাতে এবং ইতিহাস আতঙ্কে হেসে উঠেছে তার অবধারিত বিনাশের গতিপথের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে।

২০২৪ সালের জুলাই মাস এবং আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহজুড়ে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব ও অভূতশ্রুত গণআন্দোলন আমার পূর্ব ঘোষিত প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপদান করেছে। গণআন্দোলনেই যে হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের ঐতিহাসিক পতন হবে এ বিষয়ে আমি আগেই সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করি। একই সঙ্গে আমি এ কথাও গভীরভাবে বিশ্বাস করেছিলাম যে, উদীয়মান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিকশিত নবজাগরণের বা রেনেসাঁর উন্মেষ থেকেই নবপর্যায়ের একটি গণআন্দোলনের সূচনা হবে।

স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র-জনতার এই ঐতিহাসিক বিজয়লগ্নে দাঁড়িয়ে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি যে, এবারের গণআন্দোলন বৈশিষ্ট্যগত ও গুণগতভাবে ছিল বহুলাংশে ভিন্নতর মৌলিকতার দিক থেকে এবং এর প্রকৃতির দিক থেকে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিন্যাস ও পটভূমির আলোকেই আজ এক নতুন রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে। আমার বহু প্রত্যাশিত এ রেনেসাঁ ইউরোপের মতো নয়; চরিত্রগতভাবে এ রেনেসাঁ শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার ক্ষুরধার দিয়ে ইহলৌকিকতার জয়গান নয়- এ রেনেসাঁ জাতীয় মুক্তির চেতনায় আলোকিত একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রেনেসাঁ। এ নবউন্মেষ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের এক সম্মিলিত অঙ্গীকার। এ নবজাগরণ একটি জাতিকে নব-উদ্বোধনের চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমার বহু লালিত এ রেনেসাঁ বাংলাদেশের সামগ্রিক জাতীয় চেতনা, আবেগ ও প্রত্যাশার এক উজ্জ্বল অগ্রদূত। এ দেশের ছাত্রসমাজ এ রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে। তারা সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছে রেনেসাঁর চিরাচরিত ধারণা। তারা ভাবমানসের অতীন্দ্রিয় কুহক থেকে রেনেসাঁকে সরিয়ে এনেছেন স্বৈরতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের মুক্তি। গভীর আনন্দের কথা যে, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানের দায়িত্ব।

অধ্যাপক ইউনূস আজ বিশ্বব্যাপী নন্দিত, নোবেল কমিটি তাকে শান্তি পুরস্কার প্রদানের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী শান্তি, সংহতি ও উন্নয়নের ধারায় তার অবদানের প্রতি শ্রদ্ধাবনত সম্মান দেখিয়েছেন। এজন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে অহঙ্কার বোধ করি। ড. ইউনূস একটি দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সে মহতী প্রয়াসের অভিযাত্রাকে সাফল্যের দিকে নিয়ে গেছেন, তার কর্মপ্রয়াসের ফল হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে যে সামাজিক প্রগতি ও স্থিতিশীলতার ধারা, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় তিনি যে একটি প্রখ্যাত উদাহরণ- শান্তি কমিটি তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের নজির হিসেবে তাকে পুরস্কৃত করেছেন।

আমি বিশ্বাস করি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন এবং অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ- এ দুটি অর্জন আমাদের জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের গর্বের পাশাপাশি আরও একটি অহঙ্কারভূষণ হয়েছে অধ্যাপক ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তি। তার নোবেল প্রাপ্তির সম্মান কেবল তার ও তার পরিবারের নয়- এ সম্মান দেশ ও জাতির।

একবার আমার সুযোগ হয়েছিল তার গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মসূচি প্রত্যক্ষ করার। আমার সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া এবং ড. ইব্রাহিম। সেটা ছিল একটি সমাবেশ। অধ্যাপক ইউনূস সেই বিশাল সমাবেশে যে ভাষণ দেন তা আমি আজও গভীরভাবে স্মরণ করি। সেই ভাষণ ছিল নিপীড়িত, বঞ্চিত, ভাগ্যাহত দরিদ্র মানুষকে জাগিয়ে তোলার, অনুপ্রাণিত এবং উদ্বুদ্ধ করার এক আশ্চর্য জাদুমন্ত্র।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস চিন্তা-চেতনা, আদর্শ ও জীবনাভাবনার ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও দ্বিধাহীন। একবার কোনো লক্ষ্য স্থির করলে তিনি সেই লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকেন। ড. ইউনূস সন্দেহাতীতভাবে এক মহান ও অসাধারণ দেশপ্রেমিক। এখানেই তার সাহস ও শক্তি পুঞ্জীভূত।

তার উদ্ভাবিত সামাজিক ব্যবসা (Social Business) আজ বিশ্বের বহু দেশে বহু প্রতিষ্ঠানে চালু হয়েছে। এর সুফল লাভ করছে বিশ্বের বিপুলসংখ্যক মেহনতি মানুষ। গ্রামীণ ব্যাংক মডেল যেমন অনেক দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে, তেমনি সামাজিক ব্যবসা ও অধস্তন শ্রেণির সামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে। তার ‘তিন শূন্যের’ ধারণা বাস্তবায়িত হলে, বিশ্ব ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এবং সুন্দর পৃথিবী হবে দূষণমুক্ত ও বাসযোগ্য; কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এক বন্ধুরপথ অতিক্রম করতে হবে। একটি স্থিতিশীল শৃঙ্খলাপূর্ণ সরকার ব্যবস্থা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিলুপ্ত গণতান্ত্রিক কাঠামো ফিরিয়ে আনা সময়সাপেক্ষ হলেও অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলাকে এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। স্বৈরাচার পতনের অব্যবহিত পরই এমনকিছু অনভিপ্রেত ঘটনা দেখেছি যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি এত বড় একটি ঐতিহাসিক অর্জনের গুরুত্বকে ম্লান করে দিতে পারে। সরকারের স্বাভাবিক প্রশাসনিক তৎপরতা নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে- এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার তেমন প্রয়োজন নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কয়েকটি আশু দায়িত্ব নির্ধারণ করতে হবে, যেমন:

১. অনতিবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় জীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
২. জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে।
৩. সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া হত্যা, লুটপাটসহ সব ধরনের অপরাধের তদন্ত ও বিচার করতে হবে। বিচারহীনতার ও জবাবদিহির অনুপস্থিতি জাতিকে সর্বদিক থেকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়ে একে সম্পূর্ণরূপে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে। সুতরাং, সরকারকে এ বিষয়ে গভীর মনোযোগ দিতে হবে।
৪. বিদ্যমান প্রশাসন কাঠামোতে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যতীত এ মুহূর্তে হস্তক্ষেপ করলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত করা বা পুরস্কৃত করা- উভয় বিষয়েই বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে।
৫. যে কোনো প্রকার বা যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে। বিগত পনের বছরের সীমাহীন দুর্নীতিই আজ বাংলাদেশকে নিঃস্ব-রিক্ত করছে।
৬. গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। গণতন্ত্রহীনতার অবাধ ও উলঙ্গ চর্চার প্রতিফলন ঘটেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সুস্থ বিকাশ না ঘটলে এই গণবিপ্লবের সাফল্য অর্জিত হবে না।
৭. শিক্ষাব্যবস্থা বলতে বাংলাদেশে আজ কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিগত ফ্যাসিস্টরা শিক্ষা নামক বিষয়টাকে হত্যা করেছে। সুতরাং এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি একটি সর্বজনীন গণমুখী শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।

বর্ণিত দায়িত্বগুলো সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন সময়, সদিচ্ছা, পরিকল্পনা ও আন্তরিকতা। আমি জানি যে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার এগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারবে। জনমানুষের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রদূত।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ