আন্তর্জাতিকতাবাদ জাতীয়তাবাদের বিরোধী নয়, সম্পূরক
আবুল কাসেম ফজলুল হক। শিক্ষাবিদ, চিন্তক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে কথা বলেছেন, দেশের মব কালচার, শিক্ষাব্যবস্থার অবনতি ও জাতীয়তাবাদ বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর সহযোগী সম্পাদক গিরীশ গৈরিক।
ভিউজ বাংলাদেশ: সম্প্রতি দেশে মব কালচার জেঁকে বসেছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার সময়ও এটা ছিল, এখন আরও বেড়েছে। অনেকে বিচার হাতে তুলে নিচ্ছে। এটা আমাদের সংস্কৃতির এক ধরনের অবক্ষয়। এই মব কালচার থেকে আমরা কীভাবে ঘুরে দাঁড়াব, আমাদের এখন কী করা উচিত বলে মনে করেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: এ কথা সত্য, এখন যেটা চলছে এটা ডেমোক্রেসি না, মবোক্রেসি। একটা কথা আছে, বিশেষ করে মার্কসবাদীরা বলেন, মানুষের ইতিহাস মানুষেরই সৃষ্টি। কোনো অলৌকিক শক্তির দ্বারা না। মানুষ যে সভ্যতা সৃষ্টি করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, ধীরে ধীরে উন্নত চিন্তা-চেতনার দিকে গেছে, এটা মানুষের উন্নত বিবেককে কাজে লাগিয়ে। বিবেক ও বুদ্ধির বিরুদ্ধে কাজ করেন এমন মানুষও আছেন। তারা যদি প্রাধান্য বিস্তার করেন কোনো সমাজ, কোনো জাতির মধ্যে তখন সবটাই অবক্ষয় হয়ে যায়। বিকার শুরু হয়। আমাদের দেশে সেরকমটা আছে। ব্যাপকভাবে না থাকলেও বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আছে।
এখন এর সমাধান কী? একেবারে রাতারাতি সমাধান করতে হলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জোরদার করতে হবে; কিন্তু এটা কোনো উৎকৃষ্ট পদ্ধতি না। আইন দ্বারা এর সমাধান সাময়িক। এটাও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এক সময় এর বিরুদ্ধে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে যায়। যেভাবে এটা সম্ভব হতে পারে সেটা হলো, গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব যদি উন্নত হয়, তাহলে সেই নেতৃত্ব মানুষকে বুঝিয়ে অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে। কিছু লোক বুঝতে না চাইলে তাদের আইনগত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে; কিন্তু শাস্তি যারা দেবেন, তাদের নিজেদের স্বভাব-চরিত্র, চিন্তা-ভাবনাও তো আগে উন্নত হতে হবে। এই যে একটি নিয়ম, সরকারি অফিসে উচ্চপদস্থ যারা তাদের নিম্নপদস্থদের সম্মান করতে হবে, এটার ব্যতিক্রম ১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশে হচ্ছে। কেন হচ্ছে? মুক্তিযুদ্ধের পরে অনেক লোক ধাক্কা-ধাক্কি, ঠেলাঠেলি করে অনেক উচ্চপদে চলে গেছে। যারা যোগ্য কিন্তু ক্ষমতাহীন তারা নিচের দিকে পড়ে গেছে। রাজানীতি যে একটা জনগোষ্ঠীর উন্নতির প্রধান শর্ত, অপরিহার্য- এটা বঙ্গবন্ধু বলি, মাওলানা ভাসানী বলি, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বলি, কেউ সেভাবে দেখার চেষ্টা করেননি। এসব দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, আমাদের আধুনিক রাজনীতিও দুর্বল। আমাদের নেতৃত্ব অনেক ত্রুটিপূর্ণ। ত্রুটিপূর্ণ হলেও এরাই আমাদের নেতা ছিলেন, কিছু অগ্রগতি সাধন করেছেন। নতুন যারা নেতৃত্বে আসবেন তারা পুরোনো চিন্তা বাদ দিয়ে নতুন রাজনৈতিক চিন্তা আনবেন, যা আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য দরকার।
ভিউজ বাংলাদেশ: অনেক শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলেছে। এখন এই জায়গা থেকে শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে এটা ঘটেছে। এই রাষ্ট্রে প্রশাসন বলি, শিক্ষাব্যবস্থা বলি, বিচার বিভাগ এবং রাষ্ট্রের অন্য যেসব জায়গা আছে, সব ক্ষেত্রেই এমন সব কর্মকাণ্ড হচ্ছে, যেগুলো কোনোভাবেই আইনসম্মত না, ন্যায়সঙ্গতও না। এই যে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা, গোটা সমাজব্যবস্থার বিকৃতি, তার মধ্যেই শিক্ষকরা অপদস্ত হচ্ছেন, সম্মান হারাচ্ছেন এবং নানাভাবে নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছেন। এর প্রতিকার কীভাবে হবে? প্রতিকার আইনগত ব্যবস্থা দ্বারা করা যায়; কিন্তু সেটাও সুষ্ঠু প্রতিকার না। সুষ্ঠু সমাধানের জন্য দেশে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব দরকার। কেবল ভোটের মাধ্যমেই সরকার গঠন হলে গণতন্ত্র হয় এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। গণতন্ত্রের মধ্যে জনগণের অর্থনীতি, জনগণের রাজনীতি, জনগণের সংস্কৃতি- এসব কিছু ক্রমাগত উন্নতির দিকে যাওয়ার একটা উপায় করতে হয়। একদম অল্প সময়ের মধ্যে করে ফেলা যাবে, খুব দ্রুত করে ফেলা যাবে তা না। ধীরে অগ্রগতি হবে; কিন্তু অগ্রগতিটা উন্নতির দিকে, প্রগতির দিকে হওয়া উচিত। সেরকম নেতৃত্ব তৈরি করার জন্য যারা লেখেন, লেখকদের চেষ্টা করতে হবে। যারা শিল্পী তারা চেষ্টা করবে। সমাজের সর্বোচ্চ স্তরেই পলিটিক্যাল লিডারশিপ গড়ে তোলা দরকার।
এটাও বুঝতে হবে মানুষের সভ্যতা তো পরিবর্তন হচ্ছে। বিজ্ঞান এক জায়গায় আটকে নেই। নতুন নতুন উদ্ভাবনী হচ্ছে। ঠিক একইভাবে সমাজতাত্ত্বিক চিন্তা-ভাবনাও অগ্রসর হচ্ছে। মানুষের জীবনও অগ্রসর হচ্ছে। এই অগ্রসর মানসিকতার সঙ্গে আমাদের জাতির সংযোগ অত্যন্ত কম। আমাদের যারা বিশিষ্ট লেখক বলে পরিচিত, কারও কারও থাকতে পারে বিশিষ্টতা; কিন্তু তাদের লেখা পড়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি হবে এটা তৈরি হয়নি। তৈরি করার কোনো মানসিকতাও নেই। এগুলো হলো আমাদের বর্তমান সময়ের রাজনীতির দুর্বলতার কারণ। রাজনৈতিক চিন্তাকে শক্তিশালী করতে হবে, রাজনীতিকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। আমাদের জাতীয় দায়িত্বগুলো আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বগুলো সম্পাদন করবেন এমনটিই আমরা আশা করি। সেইসঙ্গে বাংলাদেশকে একটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে অবস্থান করতে হচ্ছে। সেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কও বিবেচনা করতে হবে।
গোটা দুনিয়ার মানুষ অনুভব করে জাতিসংঘের পরিবর্তন দরকার। কেন? এই যে যুদ্ধবিগ্রহ হচ্ছে, নানারকম বিরোধ হচ্ছে, লোকক্ষয় হচ্ছে, সম্পত্তি ধ্বংস হচ্ছে, যে মবোক্রেসির কথা একটু আগে আমরা বললাম, এই বিষয়গুলো যে মাথাচাড়া না দেয় সেই ব্যবস্থা করাই ছিল জাতিসংঘের প্রথম কর্তব্য। এ জন্য মিলিটাারি পাওয়ার তাদের হাতে থাকা দরকার ছিল। কিছু কিছু মিলিটারি পাওয়ার এখনো আছে, যেমন মধ্যপ্রাচ্যে সৈন্য পাঠিয়ে শান্তিরক্ষার চেষ্টা করে। এখন এমন একটা সেনাবাহিনী দরকার, যাদের দিয়ে সব দেশের শান্তিরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। এরকম চিন্তা-ভাবনা নিয়ে জাতিসংঘের পুনর্গঠন করতে হবে। যেগুলো পশ্চিমা বৃহৎ শক্তি- যেমন, আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি- জাপানও আছে এর মধ্যে, বড় শক্তিগুলো কিন্তু এই চেষ্টা এই চিন্তা করে না। সাধারণ মানুষকেই চিন্তা করতে হবে, এই জাতিসংঘ দিয়ে কল্যাণ হচ্ছে না, আরও কার্যকর পদক্ষেপ জাতিসংঘের কাছ থেকে আমরা চাই।
রাষ্ট্র থাকবে, জাতিরাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ থাকবে; সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদ থাকবে, এবং আন্তর্জাতিকতাবাদ জাতীয়তাবাদের বিরোধী নয়, সম্পূরক। যখন জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়, সংঘর্ষ দেখা দেয়, যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন এগুলো দমন করার জন্য জাতিসংঘের দরকার। জাতিসংঘের হাতে অনেক আইনগত ক্ষমতাও থাকা দরকার।
ভিউজ বাংলাদেশ: মার্কিন নাগরিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এরকম একুশটি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামও এসেছে। এই অবস্থায় আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কী হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল গতি মার্কিনমুখী হওয়া উচিত নয়। আমাদের মূল গতি হওয়া উচিত চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে। ভারতের সঙ্গেও। চীন-রাশিয়া-ভারত যা বলছে, তার সবটাই আমরা মান্য করে চলব না। একটা সাধারণ বন্ধুত্ব আমাদের এই তিন রাষ্ট্রের প্রতি থাকা উচিত। এই রাষ্ট্রগুলো যে ধারায় চলছে সেটা আমাদের জন্য বেশি ভালো হবে। রাশিয়া যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ইউক্রেনও বিধ্বস্ত হচ্ছে- এটা অত্যন্ত খারাপ ব্যাপার। জাতিসংঘের উচিত এটা মীমাংসা করা। এই যুদ্ধ বন্ধ করা; কিন্তু জাতিসংঘ সেটা করতে পারছে না।
ভিউজ বাংলাদেশ: শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। আমাদের ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের ভাস্কর্যসহ ১৫শর বেশি ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা এ বিষয়ে নীরব কেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রদের যে কোটা সংস্কার আন্দোলন এটা এর আগেও হয়েছিল। তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এর সমাধান আমরা করে দেব। সমাধান করে দেয়ার কথা বলে কীভাবে এটা হাইকোর্টে নিয়ে গেলেন। হাইকোর্ট থেকে সিদ্ধান্ত দিল এটা করা যাবে না। সংবিধান অনুযায়ী আগের অবস্থায় চলে যেতে হবে। এই যে হাইকোর্ট পর্যন্ত এটা গেল, এটা তো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছা অনুযায়ী গেছে। যে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত আনলে এটা নিয়ে আর কোনো প্রতিবাদ হবে না। হাইকোর্ট যে নির্ভুল এবং হাইকোর্ট যে পরম সত্য এরকম মনে করার তো কোনো কারণ নেই। হাইকোর্টের যারা বিচারপতি তারাও তো মানুষ। তাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের দেশে যারা সরকারে আসে তারাও হাইকোর্টকে হাতে রাখে। রাজনৈতিক নেতৃত্বেই হাইকোর্ট পরিচালিত হয়। এটা শুধু হাসিনা সরকারের আমলেই না, আগের সরকারগুলোও এরকম করে এসেছে।
এই বাস্তবতার মধ্যে আমাদের জাতির ইতিহাসগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। বেগম রোকেয়ার স্মৃতিচিহ্নও তারা ভেঙেছে। আরও নানান কিছু তারা ভেঙেছে। ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম করা হয়েছিল, এটাকে সম্পূর্ণ চুর্ণ-বিচুর্ণ করে দিয়েছে। আমি পত্রিকায় দেখলাম বঙ্গবন্ধুর একটি বড় মুর্যাল তিন-চার দিন ধরে হাতুড়ি-শাবল দিয়ে ভেঙেছে। এই ভাঙার কাজ যারা করেছে, ধ্বংসের কাজ যারা করেছে তারা কারা? শেখ হাসিনা বলেছেন, এটা জামায়াত-বিএনপির কাজ। পরে অবশ্য এ ব্যাপারে তিনি আর কথা বলেননি। প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর তিনি বলেছিলেন, এটা আমেরিকার কাজ। আমেরিকাই আমাকে উৎখাত করল। জামায়াত-বিএনপি করছে এটা তো আওয়ামী লীগ সব সময় বলত। আমেরিকাই এটা করছে এটা বুঝতে পারলে গোটা জাতিকে আগে থেকেই তার ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল। যেটা ভারত ও অন্যান্য রাষ্ট্র করে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আমাদের সময় দেয়ার জন্য ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে