ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ?
ডিমোনাসহ ইসরায়েলের পারমাণবিক ও সামরিক অস্ত্র স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে ইরান। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী স্বীকার করেছে যে, ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তাদের কয়েকটি বিমানঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; কিন্তু জোর দিয়ে বলেছে যে বিমানবাহিনী সক্রিয় রয়েছে। এখন খবর আসছে যে, একটি ইসরায়েলি স্কুলেও আঘাত হানা হয়েছে। এটি দুঃখজনক এবং অগ্রহণযোগ্য। তবে একই সঙ্গে এটিও বলতে হয় যে, ইসরায়েলি শিশুদের এই বিপদে বিশ্বশক্তি যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে সেটি ফিলিস্তিনি শিশুদের চলমান মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে আপাতবিরোধী।
এ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যখন মাঝ আকাশে ছিল, ইরান সরকার প্রধান শহরগুলোর বাসিন্দাদের কাছে মোবাইল বার্তা পাঠিয়ে তাদের আহ্বান জানায় তারা যেন এই আক্রমণকে সমর্থন করে রাষ্ট্র-সংগঠিত সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। ফলে হাজার হাজার ইরানি এই হামলার ঘটনা সমর্থন করে উল্লাস প্রকাশ করে, তাদের সঙ্গে পশ্চিম তীর এবং গাজার জনগণও যুক্ত হয়। যেহেতু ইসরায়েল এর মধ্যেই ফিলিস্তিনের ওপর হামলার তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছিল, এই উদযাপন ফিলিস্তিনে ক্ষণস্থায়ী হলেও ইরানিদের জন্য এটি একটি কৌশলগত অভ্যন্তরীণ বিজয় ছিল।
কৌশলগত মিত্র হিজবুল্লাহর ওপর চলমান আঘাতের প্রতি-উত্তরে ইসরায়েলের ওপর এই হামলা চালানো ইরানের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় ইরান নিষ্ক্রিয় থাকলে তাদের ওপরে আঞ্চলিক মিত্রদের যে আস্থা রয়েছে সেটি নষ্ট হবার সম্ভাবনা ছিল। তবে বেশিরভাগ আরব দেশ যখন নীরব ভূমিকা পালন করছে, ইরানের সাধারণ জনগণ রাষ্ট্রের এই শক্তি প্রদর্শনের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে। অন্যদিকে হিজবুল্লাহর ডিভাইস বিস্ফোরণ এবং এবং পরবর্তী সময়ে লেবাননের জনগণের ওপর বোমাবর্ষণের ঘটনার পরে, লেবাননের সাধারণ জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য হলেও ইরানের এরকম সামরিক শক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন ছিল।
গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যাকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক উত্তেজনা এখন পর্যন্ত না বাড়ার একটি প্রধান কারণ হলো ইরানের সংযম; কিন্তু ইরানকে কোনো না কোনোভাবে লেবাননে ইসরায়েলি হামলার জবাব দিতেই হতো। আবার এই আক্রমণের ফল বিবেচনা করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বাত্মক সংঘাতময় অবস্থার কথা ভেবেই ইরানকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল বেছে নিতে হয়েছে৷ তবে নিঃসন্দেহে এটা বলা যায় যে, এখন যে হামলার ঘটনা ঘটেছে সেটি তেহরানের ঠিক করে রাখা স্থান এবং কালের ভিত্তিতেই হয়েছে। ইসরায়েলের জন্য নতুন যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবে ইরান কৌশলগত কারণেই বিষয়টিকে একটি দীর্ঘায়িত যুদ্ধের আকারে রাখতে পছন্দ করবে।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই পরিস্থিতিতে কিছুটা ঢিলেঢালা ভাব বজায় রেখে চলছে কারণ এ মুহূর্তে তারা সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়াতে ইচ্ছুক নয়, বিশেষ করে নির্বাচনের আগে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুটি উপায়ে ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষে নিজেকে টেনে নিয়ে আসতে পারে। প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মিত্র ইসরায়েলের বিপদে সরাসরি সম্পৃক্ত হবার জন্য ওয়াশিংটনকে চাপ প্রয়োগ। অন্য উপায় হলো, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিশোধের মাত্রা বাড়তে দেয়া সেটা যতক্ষণ না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত না করে। আপাতত এটির সম্ভাব্যতা কম।
বলা হয় যে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন আঞ্চলিক যুদ্ধ ঠেকানোর নামে গত এক বছরে ৪০ হাজার মার্কিন সামরিক কর্মী ও সম্পদ ওই অঞ্চলে মোতায়েন করেছে। তবে আপাতত এটি নিশ্চিত করে যে ইরান এমন কোনো সীমা অতিক্রম করবে না, যাতে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হবে। বাইডেন প্রশাসন যুদ্ধবিরতির জন্য কাজ করার ভান করে যাচ্ছে, যেখানে গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ চলমান এবং লেবাননেও চলছে অবিচ্ছিন্ন আগ্রাসন। আবার মানবসম্পদ ও সরঞ্জামের পেছনে সরাসরি ব্যয় বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাতসহ অনেক কারণেই ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ মার্কিন স্বার্থের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে।
অন্যদিকে আত্মরক্ষার অধিকার সংরক্ষণের নামে ইসরায়েলের গাজায় বারংবার হামলার ব্যাপারটি তাদের ক্রমবর্ধমান মূল কৌশল যা দিয়ে তারা গাজার হত্যাযজ্ঞকে নিজেদের আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে প্রচার করতে পারে। মূলত নিজেদের এই কৌশলগত অবস্থান ধরে রাখতে ইসরায়েল চাইবে যুক্তরাষ্ট্র যেন সরাসরি ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। যদি তা হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধকে শুধু ইসরায়েলের ফিলিস্তিনিদের আঘাত করার বিষয় হিসেবে দেখা হবে না বরং ইসরায়েলের পরাশক্তির পৃষ্ঠপোষকদের সমতাও জড়িত হবে।
ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে একটি ‘ছায়া যুদ্ধ’ সম্পর্কে ঘন ঘন, প্রতিসম উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও, সেই যুদ্ধের ঘটনাগুলোর একটি সংকলন দেখায় যে, ইসরায়েল বেশিরভাগ সহিংসতার সূচনা করে এবং ইরান প্রাথমিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। তবে যাই হোক, এই প্যাটার্ন থেকে নিজেদের দূরে রাখা আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ফলপ্রসূ হবে। ইসরায়েল এবং ইরান একে-অপরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি জারি করেছে, যা আঞ্চলিক যুদ্ধকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগকে ঠেলে দিয়েছে।
ইসরায়েল, মার্কিন সমর্থনসহ, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাব দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং এখানেই পরিস্থিতি কিছুটা ঘোলাটে হয়ে গেছে। কারণ ইসরায়েল ইরানের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে ইসরায়েল তা করা থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে না। এদিকে মার্কিন নীতিনির্ধারণী যন্ত্রের সমর্থকরা পাল্টা আক্রমণের জন্য চাপ দিচ্ছে। সুতরাং, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল অনুসরণ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তিনি ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিক্রিয়ায় তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত স্থাপনাগুলোতে ইসরায়েলি হামলাকে সমর্থন করবেন না। প্রশ্ন হলো, ইসরায়েল কী শুনবে? এমনকি যদি তা করেও, তাহলে কি ইরানকে এতটা তীব্রভাবে আক্রমণ করবে যে ইরানের জন্য আরও জোরালোভাবে জড়িত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না, নাকি ইসরায়েল লেবাননে তার হামলা অব্যাহত রেখে ইরানের সঙ্গে উসকানিমূলক আচরণ চালিয়ে যাবে?
যে কোনো পরিস্থিতিতে, ফিলিস্তিনিরা এবং এখন লেবাননের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইসরায়েল চারদিকে যে সংঘাত সৃষ্টি করছে এবং ঘটাচ্ছে, তার কারণে এই অঞ্চলটি ক্রমাগত চাপের মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় সারাবিশ্ব সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, তারা আন্তরিকভাবে চায় পরিস্থিতি শান্ত হোক এবং সংঘাত যেন আর না বাড়ে।
সাইমন মোহসিন: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে