ইরান-ইসরায়েলের পারমাণবিক যুদ্ধ কেবল বাগযুদ্ধ
ইরানের নীতি কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র অজনের পক্ষপাতি নয়, যদিও পশ্চিমারা সবদাই এই আশঙ্কায় থাকে। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ্ খোমেনির একজন উপদেষ্টা কামাল খারাজী সম্প্রতি তার বক্তব্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা প্রবল করে দিয়েছেন। তিনি পরিষ্কার করেই বলেছেন, যে ইসরায়েলের কারণে যদি ইরানের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে, তাহলে ইরান তার পারমাণবিক অস্ত্র নীতি অবশ্যই পরিবর্তন করবে।
সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা চরমে পৌঁছায় যখন দুই চির শত্রু পরস্পর পরস্পরের ওপর আঘাত হানে। ইসরায়েলে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের দূতাবাসে আক্রমণের জবাবে ইরান সরাসরি ইসরায়েলের ওপর মিসাইল ও ড্রোন হামলা করে।
প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, ইরানের আয়াতুল্লাহ্ এখনো তার পুরোনো পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী ফতোয়া বজায় রেখেছেন। তবে, ইরানি কর্মকর্তারা এর আগেও ইরানের পারমাণবিক নীতি পরিবতনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ২০২১ সালে তৎকালীন ইরানি গোয়েন্দা প্রধান বলেছিলেন পশ্চিমা চাপের কারণে ইরান হয়তো তার পারমাণবিক নীতি পরিবর্তনে বাধ্য হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে যে পারমাণবিক সংঘাতের একটি ভয়াল কালো মেঘ ঘুরঘুর করে, সেটাই যেন মনে করিয়ে দিয়েছে ইরানি কর্মকর্তাদের বক্তব্যগুলো। ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রধারী শক্তি। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তারা কখনোই সেটা স্বীকার করেনি। ইসরায়েলের কাছে যে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে এবং সেটা যে কোনো আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই, সেটাও সবার জানা। অবশ্য, ইসরায়েলের প্রায় সবকিছুই যেন একরকম আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের তোয়াক্কাবিহীন। ১৯৪৫ সালে প্রথমবার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পর জায়নিস্টরা পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহের প্রয়াস শুরু করে। ১৯৫৭ সালে ফ্রান্সের সহায়তায় নেগেভ মরুভূমিতে তারা প্লুটোনিয়াম ভিত্তিক একটি পারমাণবিক কমসূচি স্থাপন করে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিক্লাসিফাইড নথি অনুযায়ী, ১৯৬০ সালে ওয়াশিংটন নিশ্চিত হয় যে ইসরায়েলের পারমাণবিক কমসূচি চলমান এবং তৎকালীন নিক্সন প্রশাসন সেটা অনিচ্ছাকৃত হলেও গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তবে, এই শতে যে কমসূচির বিষয়টি গোপন রাখা হবে। তা ইসরায়েল করেছে। কমসূচি গোপন রেখেছে, তবে সেটা সবাইকে অবগত করেই।
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক আচরণ ও গতিবিধি বিচারে ইরানের নিজ পারমাণবিক নীতি পরিবর্তন বিবেচনা করাটা অযৌক্তিক নয়। তারা যে গণহত্যা চালাচ্ছে সেটা নিয়ে তো ইসরায়েলের কোনো অনুশোচনাই নেই। আন্তজাতিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে কোনো তোয়াক্কা নেই তাদের। তাছাড়া আশঙ্কা রয়েছে যে তারা ইরানের সঙ্গে সংঘাত বাঁধিয়ে ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্রদের সংঘাতে জড়াতে বাধ্য করতে যে কোনো পর্যায়ে নামতে পারে।
সুতরাং, ইরানের পারমাণবিক নীতি পরিবর্তনের কথা যৌক্তিক, যদিও অন্তত ভয় সঞ্চারক। কারণ এরকম কোনো বাস্তবতা প্রণীত হলে ফলাফল অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক হবে। তবে, মনে হয় না যে ইসরায়েল অযাচিতভাবে ইরানের ওপর পারমাণবিক হামলা করে বসবে। ইসরায়েলের জায়নিস্ট নেতৃবৃন্দ এখনো হয়তো এতটা বুদ্ধিহীন হয়ে যায়নি। আর ইরানও খুব সম্ভব ইসরায়েলকে খোঁচাবে না, যদিও গাজায় চলমান গণহত্যার বিরুদ্ধে ইরান জোরালোভাবেই সমালোচনা অব্যাহত রেখেছে। তাছাড়া, ইরানের কর্মকর্তার পারমাণবিক নীতি পরিবর্তনের বক্তব্য সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তরে আসে। তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে বিধাই তিনি এমনটা বলেছেন। যদি তেহরান আসলেই দৃঢ় ও স্বাধীনচিত্তে এই নীতির পরিবর্তন করতে কাজ শুরু করত, তাহলে সেটার ঘোষণা, কোনো উপদেষ্টার কাছ থেকে নয় বরং আরও আনুষ্ঠানিকভাবে ও আরও সতর্কতার সঙ্গে লিখিত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আসতো। একই সঙ্গে আয়াতুল্লাহ্ খোমেনি যে তার ফতোয়া পরিবর্তন করছেন, সে ঘোষণাও আসত।
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করে আমার বিশ্বাস এটা আপাত শব্দযুদ্ধই কেবল যা ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান। প্রকৃতপক্ষে এমন পরিস্থিতি উদ্রেকের কোনো কারণ নেই আপাতত। আপাতত এটা গণমাধ্যম, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, ও সংশ্লিষ্টদের জন্য ধারণা, পযালোচনা, ও পূর্বাভাস নিয়ে কথা বলা, আলোচনা করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে