Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বাংলাদেশ কি জ্বালনি নিয়ে চিন্তিত!

Mamun–Or–Rashid

মামুন–অর–রশিদ

মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশের প্রধান জ্বালানি গ্যাস। সব শেষে সরকারি হিসাব বলছে, দেশে এখন গ্যাসের অবশিষ্ট মজুতের পরিমাণ সাড়ে ৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। প্রতি মাসে দেশের খনিগুলো থেকে ৬৫ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ) গ্যাস তোলা হচ্ছে। একেবারে সরল অঙ্কে যদি হিসাব করা হয়, তাহলে অবশিষ্ট গ্যাসে চলবে আর ১৪৬ মাস অর্থাৎ ১২ বছরের কিছুটা বেশি সময়। তবে গ্যাস তোলার হিসাবটি এভাবে সরল অঙ্কে করার কোনো সুযোগ নেই। হিসাব যাই হোক, দ্রুত মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার খবরটি শঙ্কার। সরকার বিকল্প হিসেবে গ্যাস আমদানি বৃদ্ধির চেষ্টা করছে; কিন্তু দেশের অর্থনীতি আমদানি গ্যাসের চাপ সহ্য করতে পারবে কি না, তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে।

বাংলাদেশের ২৬টি খনি থেকে এখনো গ্যাস তোলা হয়। পেট্রোবাংলার হিসাব বলছে, গত ৫ নভেম্বর দেশের খনিগুলো থেকে ২ হাজার ৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। এখন অভ্যন্তরীণ খনিগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসই তোলা হচ্ছে। গত চার বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ খনি থেকে গ্যাস তোলার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে ৭০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট কমেছে। কোনো কোনো খনির গ্যাসের মজুত কমে আসাতে আগামী বছরগুলোতে গ্যাসের উৎপাদন আরও কমবে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় গ্যাসের আমদানি বাড়াতে হবে। এখন দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ ক্ষমতা রয়েছে দুটি ভাসমান টার্মিনালের। পেট্রোবাংলা যে পরিমাণ গ্যাস আমদানি করে, ওই পরিমাণই টার্মিনাল দুটি সরবরাহ করে। মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ মাতারবাড়ীতে টার্মিনাল দুটি নির্মাণ করেছে।

সরকারি হিসাব বলছে, ২০২০ সালে ৪২ লাখ টনের জন্য ১৩১ কোটি ডলার খরচ হলেও ২ বছর পর একই পরিমাণ এলএনজির জন্য গুনতে হয় সাড়ে ৩০০ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে গেল সাড়ে ৩ বছরে তেল ও গ্যাস কিনতে খরচ হয়েছে আড়াই বিলিয়ন ডলার। জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়াতে চলতি বছর দেড় বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ হওয়ার আশঙ্কা করছে সরকার। বিপুল এই ব্যয় জোগাতে গিয়ে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। সরকার এই প্রক্রিয়ার বাইরেও মাতারবাড়ীতে আরও একটি ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানির জন্য ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণের কাজ দিয়েছে সামিটকে। পরিকল্পনার মধ্যে পায়রা বন্দর এলাকায় আরও একটি ৫০০ মিলিয়ন সরবরাহ ক্ষমতার এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। এর বাইরে মাতারবাড়ীতে আরও একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ ক্ষমতার এই টার্মিনালটি স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা হবে, যা ল্যান্ডবেইজড এলএনজি টার্মিনাল নামেও পরিচিত।

অভ্যন্তরীণ গ্যাসখনির অবস্থা
জ্বালানি বিভাগের নীতি এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাইড্রোকার্ন ইউনিট জুলাই মাসের সর্বশেষ যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেখানে দেখা যায়, দেশে এখন মোট মজুত গ্যাসের পরিমাণ ৯ দশমিক ৫০৮ টিসিএফ। এখন দেশীয় তিন কোম্পানির পাশাপাশি বহুজাতিক দুটি কোম্পানি গ্যাস তুলছে।

বাপেক্স
দেশের তিন কোম্পানির মধ্যে বাপেক্সের হাতে রয়েছে আটটি খনি। তবে বাপেক্সের সব খনি মিলিয়েও এক টিসিএফ মজুত নেই। আবার সব খনি থেকেও বাপেক্স এখন গ্যাস তুলছে না। বাপেক্সের মোট মজুতের পরিমাণ ৮৪৯ বিসিএফ। গত জুলাই মাসে বাপেক্সের খনিগুলো থেকে মাত্র ৪ দশমিক ৩৯ বিসিএফ গ্যাস তোলা হয়েছে। অন্যান্য মাসেও প্রায় একই পরিমাণ গ্যাস তোলা হচ্ছে। অর্থাৎ বছরে বাপেক্সের খনিগুলো থেকে গ্যাস তোলার পরিমাণ ৫২ দশমিক ৬৮ বিসিএফ।

বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড
দেশের সব থেকে বড় মজুতের খনি তিতাস গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) হাতে। খনির মজুতের হিসাব বলছে তিতাসে ৭ দশমিক ৫৮২ টিসিএফ মজুত রয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস থেকে এখন পর্যন্ত ৫ দশমিক ৩৩৭ টিসিএফ গ্যাস তোলা হয়েছে। অবশিষ্ট রয়েছে ২ দশমিক ২৪৪ টিসিএফ। এখানে যদি আর নতুন গ্যাস না পাওয়া যায় তাহলেও একই হারে গ্যাস তোলা সম্ভব হলে তিতাস থেকে ১৫ বছর গ্যাস পাওয়া যাবে। তবে বিজিএফসিএলের বাকি ৫টি খনির অবশিষ্ট মজুতের পরিমাণ ৭৩৯ বিসিএফ। এই পাঁচ খনি থেকে মাসে গড়ে গ্যাস তোলা হচ্ছে ৬ দশমিক ০৩ বিসিএফ।

সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেড
এখন দেশে সব থেকে বেশি গ্যাসের মজুত রয়েছে সিলেট গ্যাস ফিল্ডের (এসজিএফসিএল) হাতে। গ্যাস কোম্পানির ৫টি খনির অবশিষ্ট মজুতের পরিমাণ পাঁচ দশমিক ১৭৪ টিসিএফ। কৈলাসটিলা, সিলেট, রশিদপুর, ছাতক, বিয়ানীবাজার এই খনিগুলোতে মোট মজুত ছিল ৭ দশমিক ০৩৩ টিসিএফ। তবে এখান থেকে গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণ খুব বেশি নয়। এখান থেকে প্রতি মাসে মাত্র ২ দশমিক ৮২ বিসিএফ গ্যাস তোলা হয়। চাইলে এখান থেকে আরও গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। নতুন কূপ খনন করার উদ্যোগও নেয় হয়েছে। সিলেট গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে দেশের জ্বালানির আপাত সংকটের অনেকটা নিরসন হতো বলে মনে করা হয়।

শেভরন বাংলাদেশ
মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিটি দেশের সবচেয়ে বেশি গ্যাস উত্তোলন করে। কোম্পানিটির হাতে তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে। এর মধ্যে বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিদিন যে গ্যাস তোলা হয় তার অর্ধেক আসে একটি বিবিয়ানা থেকে। তবে খনিটির মজুত দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ৩ বছর আগে ২০২০ সালের জানুয়রি মাসে দৈনিক বিবিয়ানা খনি থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তোলা হতো। এখন খনিটি থেকে দৈনিক ১ হাজার ৬৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তোলা হয়। অর্থাৎ খনিটির দৈনিক ২৬৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন কমেছে।

যদিও হাইড্রোকার্বন ইউনিট খনিটির মজুতের যে তথ্য দিয়েছে, তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে পেট্রোবাংলার। হাইড্রোকার্বন ইউনিটের জুলাই এর রিপোর্টে বলা হয়েছে বিবিয়ানাতে অবশিষ্ট মজুতের পরিমাণ ১২৪ বিসিএফ। এ বিষয়ে ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমরা শেভরনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, হাইড্রোকার্বন ইউনিটের জুনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিনিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রে ১৫৭ বিসিএফের অবশিষ্ট মজুত রয়েছে। গত মে মাসে এখান থেকে ৩১ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়। তাহলে কি চার-পাঁচ মাস পর বিবিয়ানা থেকে গ্যাস পাওয়া যাবে না?

শেভরনের পক্ষ থেকে লিখিত ভাবে জানানো হয়, ‘ শেভরন বাংলাদেশ নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য এবং সাশ্রয়ী মূল্যের প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করতে বাংলাদেশ সরকার এবং পেট্রোবাংলার সঙ্গে অংশীদারিত্বে পরিচালনা এবং বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে, যা দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এখন এবং ভবিষ্যতে সহায়তা করার জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের জন্য বৈশ্বিক দক্ষতা প্রয়োগ করে যা বর্তমান চাহিদায় অবদান রাখছে আরও উৎপাদনের সম্ভাবনা বাড়ায় এবং বিবিয়ানা, জালালাবাদ এবং মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রে আরও বেশি পরিমাণ গ্যাস উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।’ তবে শেভরনের হাতে মৌলভীবাজার এবং জালালাবাদ আরও দুটি ক্ষেত্র রয়েছে। যদিও এই ক্ষেত্রর মজুতের পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়। পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা জানান, বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রে আরও এক থেকে দেড় টিসিএফ মজুত রয়েছে। তবে এখন আবার রিজার্ভটি নতুন করে ঠিক করতে হবে। যা এখনো শেভরন করেনি।

তাল্লো অয়েল পিএলসি
মার্কিন এবং আফ্রিকার একটি স্বতন্ত্র তেল-গ্যাসে কোম্পানি। বাংলাদেশে বাঙ্গুরা নামে একটি খনি রয়েছে তাল্লোর কাছে। মোট মজুত ৬২১ বিসিএফ থেকে ৫৪৭ বিসিএফ ইতোমধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে। খনিটিতে অবশিষ্ট মজুতের পরিমাণ ৭৩ দশমিক ৬ বিসিএফ। প্রতি মাসে এখান থেকে ১ দশমিক ৩৯ বিসিএফ গ্যাস তোলা হচ্ছে।

নতুন সম্ভাবনা জাগাতে পারে ভোলা
এক সময় ধারণা করা হতো বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলেই কেবলমাত্র খনিজসম্পদ মজুত রয়েছে; কিন্তু ভোলায় গ্যাস পাওয়ার পর এই ধারণা বদলে গেছে। ভোলাতেই দুটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। ভোলার শাহজাদপুর, ভোলা নর্থ ও ইলিশা মিলিয়ে প্রায় ২ দশমিক ২৩ টিসিএফ গ্যাস মজুত রয়েছে। প্রতিদিন উত্তোলন করা যেতে পারে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে ভোলার সঙ্গে কোন সরাসারি গ্রিড লাইন না থাকার কারণে ভোলা থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস আনা সম্ভব হচ্ছে না। এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দৈনিক ৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এলএনজি করে আনা হচ্ছে। তবে সরাসরি গ্রিডে না এনে এই গ্যাস দিয়ে ভোলাতেই সার কারখানা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণও করা যেতে পারে। ভোলা থেকে গ্রিড লাইন নির্মাণ করা আপাত দৃষ্টিতে লাভজনক মনে করছে না সরকার। এজন্য কিছুটা ধীরে চলার নীতি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ