Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ব্রিকস তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পরবে?

Simon Mohsin

সাইমন মোহসিন

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের সফল সমাপ্তি ঘোষণা করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রাশিয়ার অর্থনীতিকে বৈশ্বিক বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে দেশটির ওপর অনেক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। এরই মধ্যে গত কয়েক দশকের মধ্যে রাশিয়ায় বিশ্বনেতাদের সবচেয়ে বড় সমাবেশটি হয় এই ব্রিকসেই। ৩৬টি দেশের শীর্ষ নেতাদের অংশগ্রহণে তিন দিনের সম্মেলনে রাশিয়া এবং পুতিনকে বিশ্বজুড়ে বিচ্ছিন্ন করতে পশ্চিমাদের চেষ্টা ব্যর্থই হয়েছে।

সম্মেলনে অংশ নেয়া দেশগুলো পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি ক্রমেই ভরসা হারিয়ে এই ব্রিকস ব্লকে যুক্ত হওয়ার কথা বলছে এবং এর নেপথ্যে রাশিয়ার ভূমিকার পরোক্ষভাবে প্রশংসাও করেছে। রাশিয়ার গণমাধ্যমগুলোও এই শীর্ষ সম্মেলনকে পশ্চিমাদের চাপ ও আধিপত্যের বিকৃত পদ্ধতির বিরুদ্ধে ঐকমত্যের বিশাল শোডাউন হিসাবে উল্লেখ করেছে। তবে পশ্চিমারা ব্রিকস় শীর্ষ সম্মেলন এবং এর ফলাফলকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি থেকে শুরু করে মার্কিন ডলারের আধিপত্যকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করেছে।

শীর্ষ সম্মেলনে পশ্চিমা-আধিপত্যে চলমান বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থার বিকল্প, আঞ্চলিক বিরোধ নিষ্পত্তির প্রচেষ্টা এবং ব্রিকস গোষ্ঠীর দেশগুলোর সম্প্রসারণসহ আরও গভীরতর আর্থিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। রাশিয়া, চীন এবং অন্য দেশগুলো বৈশ্বিক ব্যাঙ্ক মেসেজিং নেটওয়ার্ক সুইফট-এর বিকল্প হিসেবে নতুন অর্থ আদান-প্রদানের ব্যবস্থা তৈরি করতে সম্মত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং বিশ্বের অন্য দেশগুলোর বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্য ব্যাহত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র হয়ে উঠেছে সুইফট। সম্মেলনের যৌথ ঘোষণাপত্রে অংশগ্রহণকারীরা বিশেষভাবে অবৈধ নিষেধাজ্ঞাসহ বেআইনি একতরফা জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপের বিপজ্জনক প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছে। তারা দ্রুত, কম খরচে, আরও দক্ষ, স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্রস-বর্ডার পেমেন্ট সুবিধা পদ্ধতি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে, যেন বাণিজ্যে বাধা কমানোর নীতিতে কাজ করা যায় এবং পদ্ধতিতে বৈষম্যহীন প্রবেশাধিকার থাকে।

বলা যায়, ব্রিকস এমন একটি ফোরাম তৈরি করেছে, যা উদীয়মান বাজারগুলোকে বৈশ্বিক বিষয়গুলোতে সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ দেয়। এটি পারস্পরিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বৃদ্ধির নতুন সুযোগ দেয়। এটি রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং লেনদেন সম্পাদনের আর্থিক পদ্ধতি গড়ে তোলার কাজ করছে। যাতে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা, মুদ্রানীতি, শক্তি বাণিজ্য, বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন এবং প্রযুক্তিগত গবেষণার ভবিষ্যতের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। ফলে বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোকে তাদের বিনিয়োগ কৌশলের সঙ্গে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার মূল্যায়ন করতে হবে। অংশগ্রহণকারী নেতারা আন্তঃসীমান্ত আর্থিক ব্যবস্থার উন্নতি এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করার গুরুত্বে জোর দেন। তারা বিশ্বজুড়ে আর্থিক ব্যবস্থাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত সংস্কারের জরুরি পদক্ষেপেও জোর দিয়েছেন। তাদের জন্য বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেনে স্থানীয় মুদ্রার গ্রহণযোগ্যতার দুর্বলতা হ্রাস এবং উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বাহ্যিক অর্থনৈতিক ধাক্কার প্রভাব কমানো অপরিহার্য।

১৩টি নতুন দেশকে ব্রিকস উদ্যোগে অংশীদার দেশ হিসেবে যোগদানে গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আলজেরিয়া, বেলারুশ, বলিভিয়া, কিউবা, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, উগান্ডা, উজবেকিস্তান এবং ভিয়েতনাম।

গত বছর ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মিশর, ইথিওপিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। সৌদি আরব এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয়নি, তবে অন্যরা যোগ দিয়েছে। আর্জেন্টিনাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তবে রাষ্ট্রপতি জাভিয়ের মিলির নতুন সরকার গত বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচিত হয়ে পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী। ব্রিকস সদস্যদের চুক্তির কেন্দ্রীয় বিষয় হলো বৈশ্বিক শাসনে পশ্চিমা-নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তাদের অসন্তোষ, বিশেষ করে বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামোর বিষয়ে।

ব্রিকসে ভেনিজুয়েলার সম্ভাব্য যোগদান নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এজন্য সমস্ত সদস্য দেশের সম্মতি প্রয়োজন এবং ব্রাজিল এর বিরোধিতা করবে। ব্রিকস প্রধানত আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়, যা একভাবে পশ্চিমাদের প্রক্সি। ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এ প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু। অবকাঠামো এবং টেকসই প্রকল্পে অর্থায়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে সংস্থাটি। এটি ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রাথমিক মূলধন দিয়ে শুরু হলেও ব্রিকস সদস্যদের বাইরে অন্য উদীয়মান অর্থনীতিতে অর্থসহায়তা দিয়েছে। ব্রিকস জি-২০-এর প্রাসঙ্গিকতাকে আরও দুর্বল করেছে। জি-২০ বৃহত্তম শিল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির মধ্যে অর্থনৈতিক নীতির সমন্বয় করতে চায়। নীতি সারিবদ্ধকরণে জি২০-এর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও জি২০-এর সাতটি বৃহত্তম অর্থনীতির নিজস্ব ক্লাব রয়েছে, যার নাম জি৭। এরপর এখন জি২০-এর ছয়টি বড় উন্নয়নশীল অর্থনীতি ব্রিকস+-এর মধ্য দিয়ে তাদের প্রভাব প্রভাব বিস্তার করছে।

মার্কিন ডলারের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার আগে উদীয়মান অর্থনীতিগুলোকে আরও অনেক কিছু করতে হবে। দেশগুলোর এই ব্রিকস ব্লকে যোগদানের ক্রমবর্ধমান ইচ্ছা এবং নতুন সদস্যদের সঙ্গে শীর্ষ সম্মেলনে তাদের প্রদর্শিত উৎসাহ এর গুরুত্ব বহন করে। সাম্প্রতিক সম্মেলন কিছু উল্লেখযোগ্য ভূ-রাজনৈতিক বিষয়কে গুরুত্বারোপ করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের উপস্থিতি ছিল ব্রিকসের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের আরেকটি প্রদর্শনী। ন্যাটো সদস্য তুরস্কের এরদোয়ান ব্রিকস গ্রুপে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ এবং সম্মেলনে উপস্থিত হওয়া উল্লেখযোগ্য। ভারত ও চীন এই শীর্ষ সম্মেলনেই সম্পর্কের নতুন সূত্রপাত করেছে, যা ব্রিকস ঐক্যের ক্রমবর্ধমান সুসংহততা এবং ইচ্ছার ইঙ্গিত দেয়।

ব্রিকস সম্মেলনে পুতিনের সঙ্গে বিশ্বনেতাদের ছবি পশ্চিমের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। এ সম্মেলনে রাশিয়া দেখায় যে, ভারত, চীন এবং অন্য উদীয়মান শক্তির মতো অপরিহার্য অংশীদার রাশিয়ার সঙ্গে রয়েছে। সম্প্রসারিত ব্রিকস বিশ্বের জনসংখ্যা এবং জিডিপির যথাক্রমে প্রায় ৪৫ শতাংশ এবং ২৫ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে। ব্রিকস প্রসারিত হতে থাকবে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এই ব্লকে যোগ দিতে চায়। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সুস্পষ্টভাবে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং ন্যাটো সদস্য তুরস্কও সম্প্রতি যোগ দিতে চেয়েছে।

যদি ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশের মতো আরও এক ডজন দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় যারা সদস্যপদের আবেদন করেছে, তাহলে ব্রিকস বিশ্ব জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব করবে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, রাশিয়া বিচ্ছিন্ন নয়,দ এবং ব্রিকসে আগ্রহী দেশগুলো পশ্চিমাদের নির্ধারিত দলাদলিতে অনিচ্ছুক। পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হওয়ায় বৈশ্বিক শৃঙ্খলা একটি কাঠামোগত পরিবর্তন দেখে বৃহৎ উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্ব অর্থনৈতিক বিষয়ে আরো প্রভাব বিস্তার করতে এবং পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প গড়ে তুলতে ইচ্ছুক।

বেশিরভাগ নতুন ব্রিকস সদস্যদের সঙ্গে ভারত গভীর সম্পর্ক উপভোগ করে। মিশর ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ও নিরাপত্তার অংশীদার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ইথিওপিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও অসাধারণ। পশ্চিমাদের রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা সত্বেও দিল্লি ব্রিকসকে মস্কোর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা অব্যাহত রাখতে সুবিধা দেয়। ব্রিকস ভারতকে নিজ পররাষ্ট্রনীতির অগ্রগতি এবং তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন নীতির রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধাও দেয়। এটি ভারতকে প্রধান ভূ-রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার সুযোগ দেয়। পশ্চিমের অভ্যন্তরে এবং বাইরে দিল্লির অপরিহার্য দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক অংশীদারিত্বের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দেয় ব্রিকস। ক্রমবর্ধমান প্রভাবশালী ব্রিকস এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিক কোয়াডে অংশগ্রহণ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার সুবিধা দেয়।

শীর্ষ সম্মেলনের যৌথ বিবৃতি একই নীতি ও লক্ষ্য প্রতিফলিত করে, যা দিল্লি তার বার্তা এবং নীতিতে আগেও স্পষ্ট করেছে। এর মধ্যে রয়েছে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর সঙ্গে সংঘবদ্ধ হওয়া, বহুপাক্ষীয়বাদ এবং বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থার উন্নয়ন, জাতিসংঘের সংস্কারের জন্য চাপ দেয়া এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন লাভ করা। দিল্লি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞারও সমালোচনা করে যা রাশিয়ার সঙ্গে তার বাণিজ্য এবং ইরানে তার অবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে প্রভাবিত করে।

ব্রিকস গ্রুপ নতুন সদস্যদের স্বাগত জানায়। ইরান, বেলারুশ ও কিউবার অন্তর্ভুক্তি গ্রুপটিকে আরও পশ্চিমাবিরোধী অবস্থানের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা। ভারত পশ্চিমা দেশ এবং পশ্চিমের সঙ্গে তার সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। পশ্চিমা স্বার্থের বিরোধিতা করে এমন কোনো জোটে যোগ না দিতেও ভারত সতর্ক।

ব্রিকস, বিশেষ করে এর নতুন সদস্যদের সঙ্গে পশ্চিমাবিরোধী হওয়ার সম্ভাবনা কম। ইরান ছাড়া নতুন সদস্যদের পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। অনেক দেশ ভবিষ্যতে যোগদানের গুজব, যেমন তুরস্ক, ন্যাটো সদস্য এবং ভিয়েতনাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এদের অন্তর্ভুক্তি পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধিতার ইঙ্গিত দেয় না। চীন ও ভারত ব্রিকসের প্রধান অর্থনৈতিক ইঞ্জিন হিসেবে রয়েছে। রাশিয়া তার বিশাল জ্বালানি সম্পদের সুবিধা দিয়ে তাদের পরিপূরক। ব্রাজিল গ্রুপটিকে উল্লেখযোগ্য কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে সম্পূরক করে আর দক্ষিণ আফ্রিকা আফ্রিকা মহাদেশে গ্রুপের সংযোগের সুবিধা দেয়। এই কৌশলগত বৈচিত্র্য ব্রিকসকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এজেন্ডা গঠনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারেরসক্ষম করে।

ব্রিকস গ্রুপে চীনের সঙ্গে সহযোগিতা ভারতকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করে। শীর্ষ সম্মেলনের ঠিক আগে ভারতের নতুন সীমান্ত টহল চুক্তির সাম্প্রতিক ঘোষণার পরে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিকস সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ভারত-চীন সম্পর্কের সম্ভাব্য সুরাহার ইঙ্গিত দেয়। ভবিষ্যতে গঠনমূলক সংলাপ ও সহযোগিতার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন দুই নেতা। চীন ও ভারতের সম্পর্কের সাম্প্রতিক উন্নতিও ব্রিকসের ইতিবাচক লক্ষণ। তবে, তাদের সীমান্তে নতুন চুক্তি সত্বেও চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখনও উত্তেজনাপূর্ণ। চলমান সীমান্ত বিরোধ, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের দৃঢ় সম্পর্ক, এই দুই দেশ শিগগিরই অভিন্ন দিক-নিদেশনা খুঁজে পাবে- এমন সম্ভাবনাও কম।

১৬তম ব্রিকস সম্মেলন ‘কাজান ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করেছে, যা জাতিসংঘে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পূর্ণ সদস্যপদের পক্ষে কথা বলেছে। দুই রাষ্ট্র বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের কথাও বলেছে। ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব স্পষ্ট করেছে যে ব্রিকসের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা আরও ন্যায়সঙ্গত এবং ভারসাম্যপূর্ণ বৈশ্বিক ব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষায় চালিত। অধিকন্তু, তারা যুদ্ধবিরতি, মানবিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাজা থেকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তায় জোর দিয়েছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, ব্রিকসের মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্রিকসে যোগদানে ফিলিস্তিনের অভিপ্রায় ঘোষণা করেন।

চীন-ভারত উত্তেজনা মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক ভূমিকাকে শক্তিশালী করে। সীমান্ত নিয়ে বিরোধ, হিংসাত্মক সংঘর্ষ, এবং ভারতে কিছু চীনা রপ্তানির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা- এ দুটি প্রধান বিষয় ব্রিকস দেশগুলোর পক্ষে সাধারণ মুদ্রায় একমত হওয়া কঠিন করে তোলে, যাতে ডলারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারা কঠিন হয়ে ওঠে। ডলারের বৈশ্বিক শক্তিতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটবে যখন তেল ও গ্যাসের দাম আর মার্কিন ডলারে ভিত্তি করে থাকবে না। এটি অনেক ব্রিকস দেশগুলোর মতো বড় উৎপাদক এবং রপ্তানিকারকদের উপকৃত করবে।

যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রার রিজার্ভে ডলারের অংশীদারত্ব কমে গেছে, তবে মার্কিন মুদ্রার ব্যবহার বাণিজ্য, ঋণ প্রদান এবং সাধারণত বিশ্বজুড়ে মুদ্রা বাজারের ব্যবহার এখনো অনেক। বিকল্প মুদ্রার ক্রমবর্ধমান ব্যবহার বর্তমানে ডলারের জন্য হুমকি নয়। বরং, এটি বাণিজ্য এবং পুঁজিপ্রবাহের বিভক্তির কারণে আঞ্চলিক মুদ্রার মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ায়। ডি-ডলারাইজেশন সম্ভবত একক মুদ্রা পদ্ধতি গড়ে তোলার পরিবর্তে আরও বৈচিত্র্যময় বাজারের দিকে নিয়ে যাবে। সবশেষে, ব্রিকস ডি-ডলারাইজেশন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার আরেকটি কারণ হল আঞ্চলিক বাণিজ্য, মূলধন প্রবাহ এবং মুদ্রা বাজারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। ব্রিকস গ্রুপের সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সহযোগিতায় অর্থ আদান-প্রদানের ব্যবস্থা চালু করতে চায়। ব্রিকস পেমেন্ট সিস্টেম চালুর আগে এবং এটাকে বিকল্প হিসাবে বিবেচনার আগে অনেক পথ অতিক্রম করা বাকি।

কাজান ঘোষণাটি ব্রিকস ক্রস-বর্ডার পেমেন্ট ইনিশিয়েটিভ সম্পর্কে স্পষ্ট প্রত্যয় জ্ঞাপন করেছে। যা ব্রিকসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকিং নেটওয়ার্কগুলোকে শক্তিশালী এবং ব্রিকস সদস্যদের স্থানীয় মুদ্রায় আদান-প্রদানে সক্ষম করবে বলে মনে করা হয়। ব্যাংকাররা নিশ্চিত নন যে, ব্রিকস সুইফট সিস্টেমের বিকল্প তৈরি এবং টিকিয়ে রাখতে প্রযুক্তিগত সহায়তা ব্যবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হবে কি না। ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলের কোম্পানিগুলি ব্রিকস ক্লাবের বাইরের দেশগুলোতে ব্যবসায়িক অংশীদারদের কাছ থেকে অর্থ প্রদান এবং গ্রহণ চ্যালেঞ্জিং মনে করতে পারে। যদিও ব্রিকস ধারণাটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে না। তবে ওয়াশিংটনে বিশ্বের কয়েকটি দেশের সুক্ষ্ম ডি-ডলারাইজেশন অভিযান নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।

ডি-ডলারাইজেশন উদ্যোগটি শীর্ষ সম্মেলন থেকে উঠে আসা সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব। ব্রিকস মুদ্রার জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজন হবে, যার মধ্যে ব্যাংকিং ইউনিয়ন, আর্থিক ইউনিয়ন এবং সাধারণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক অভিসরণ রয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ সন্দেহ করেন যে, নতুন ব্রিকস রিজার্ভ মুদ্রা স্থিতিশীল বা বিশ্বজুড়ে লেনদেনে ব্যাপকভাবে বিশ্বাসযোগ্য ও যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য হবে। এই পর্যায়ে বিশ্বব্যাপী ব্রিকস আর্থিক সরঞ্জামের ব্যাপক উন্নয়ন এবং গ্রহণ কল্পনা করা কঠিন। বৈশ্বিক মুদ্রার ল্যান্ডস্কেপে মার্কিন ডলারের আধিপত্য বাণিজ্য লেনদেন এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নিহিত; বিশ্বজুড়ে ৮০ শতাংশেরও বেশি বাণিজ্য লেনদেন মার্কিন ডলারে চালান করা হয়, যা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের রিজার্ভের প্রায় ৬০ শতাংশ।

এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার অনেক মানুষ এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সারিবদ্ধ না হওয়া পছন্দ করে এবং গাজায় গণহত্যার পৃষ্ঠপোষকতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখে অনীহা বাড়ছে। ব্রিকস গ্রুপে এই আগ্রহ পশ্চিমা জোট থেকে ভিন্ন বিকল্পের প্রস্তাব দেয়। যদিও ব্রিকস সদস্যরা বেশ ভিন্ন, তাদের নেতাদের একত্রিত করা প্রভাব ফেলতে পারে। কাজান বৈঠকটিও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কারণ দুই বছরের মধ্যে এটিতেই প্রথমবারের মতো চীনা প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিং এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করেছেন। এই বৈঠক তাদের সম্পর্কের উন্নতিতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু তাদের সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান করে না। এবং মার্কিন ডলারের আধিপত্য ভাঙার প্রাথমিক আকাঙ্ক্ষার জন্য সমস্ত ব্রিকস সদস্যদের কাছ থেকে আরও অনেক কিছু প্রয়োজন।

সাইমন মোহসিন: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ