Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ক্রিকেট খেলা কী বাঙালিদের কাছে আবেগ নাকি হুজুগ?

Dulal Mahmud

দুলাল মাহমুদ

সোমবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৩

হুজুগে বাঙালি কথাটির যেভাবেই প্রচলন হয়ে থাকুক না কেন, তার যে যথেষ্ট সারবত্তা রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। কারণে তা করা যেতে পারে, কিন্তু অকারণেই যে কোনো বিষয় নিয়ে মাতামাতি করা গড়পড়তা বাঙালির চিরাচরিত স্বভাব। অধিকাংশ ক্ষেত্রে না বুঝেই দাপাদাপি করা হয়। আর এখন তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠেছে বাঙালির পরচর্চা, পরনিন্দা আর পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের বিশাল প্ল্যাটফর্ম। জানলে তো কথা নেই, না জেনেই হেন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে অভিমত ব্যক্ত করা হয় না।

বাঙালির সাম্প্রতিক প্রধান চর্চার বিষয় ক্রিকেট। বোধকরি ঠোক্কর খেতে খেতে দিশেহারা বাঙালির পরম ভালোবাসা হয়ে উঠেছে ব্রিটিশদের প্রবর্তিত এ খেলা। খেলাটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় তা সমাজ জীবনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান মোটেও হেলাফেলার নয়। যে কোনো বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাথা গলানোর তেমন একটা সুযোগ মেলে না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে পরিসর সীমিত হলেও চমৎকার একটা মাধ্যম হয়ে উঠেছে ক্রিকেট। এ খেলা নিয়ে সবার মধ্যে বয়ে যায় অন্তহীন ভাবোচ্ছ্বাস। ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে জ্ঞান, বিদ্যা ও মনীষা জাহির করার এমন সুযোগ কে আর ছাড়ে? এটা কি বাঙালির আবেগ না কি হুজুগ, সেটা অবশ্য ভাবনার বিষয় বৈকি। দৃশ্যত ক্রিকেট নিয়ে উত্তেজনা বা প্রবল উচ্ছ্বাসেরও কমতি নেই। তা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তাতে খেলাটির প্রতি এক রকম আবেগ প্রকাশিত হয়। ক্রিকেটকে যাঁরা ভালোবাসেন এবং এর সাফল্য-ব্যর্থতায় উদ্বেলিত হন, তাঁদের বহিঃপ্রকাশের মধ্যে যৌক্তিকতা, সৃজনশীলতা ও এক ধরনের সৌন্দর্য থাকে।

আমার মতো অনেকেই আছেন, শুধু ক্রিকেট নয় যে কোনো খেলার টেকনিক্যাল বিষয় কম জানেন। তা বোঝার জন্য সংশ্লিষ্ট খেলার বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুধাবন করার একটা অন্তর্গত তাগিদ থাকে। বিশেষ করে, যে কোনো খেলার আগে যাঁরা বিশ্লেষণ করেন কিংবা মতামত দেন, তাঁদের অভিমত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে না হওয়ার কারণ নেই। খেলা চলাকালে তাঁদের বিশ্লেষণ কিংবা মতামত মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ হয়। খেলা তো আর সরল অঙ্ক নয়। সঙ্গত কারণেই সবটাই মিলে যাওয়ার কথা নয়। তবে তাঁদের দেওয়া সূত্রগুলোর সঙ্গে খেলার অনেকটা সামঞ্জস্য থাকলে বুঝতে পারা যায়, আসলেই তিনি খেলাটা বোঝেন কিংবা বোঝাতে পারেন। তাঁর বা তাঁদের সঙ্গে এক ধরনের আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে। কিন্তু খেলার পরে যাঁরা যুক্তিহীনভাবে পাণ্ডিত্য দেখান কিংবা অকারণেই মনের ঝাল মেটান, তাঁদেরকে ক্রীড়াঙ্গনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর মনে হয়। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট খেলাটি খেলেছেন কিংবা সেই খেলার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন, তাঁর বা তাঁদের বালখিল্য অভিমতগুলো দারুণভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। যেন এমনটা ঘটবে, তাঁরা আগেই জানতেন। তখন জানানোর তাগিদ অনুভব করেননি। এমন মনোভাব কোনো বিবেচকের হতে পারে না। অথচ তাঁর বা তাঁদের কাছে যৌক্তিক ও গঠনমূলক বিশ্লেষণ বা মতামত প্রত্যাশা করাটা অযৌক্তিক নয়।

অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁর বা তাঁদের অভিমত আমরা যাঁরা খেলাটা কম বুঝি, তাঁদের বুঝতে সহায়তা করতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হতাশ হতে হয়। ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এমনটা যে বা যাঁরা করেন, তাঁরা সুযোগসন্ধানী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। সম্ভবত তাঁদের ধান্দাটা অন্য। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বা ব্যক্তিগত কোনো বিষয়কে ক্রিকেটের মাধ্যমে হাতিয়ার করে তোলেন। কৌশলে ক্রিকেটকে পুঁজি করে অনেকের কাছেই নিজের মনোভাব বা বার্তা চাউর করার সুযোগ পেয়ে যান। সেটা কাজে লাগিয়ে ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেন। আবার কেউ কেউ আবেগ নয়, পরিচালিত হন হুজুগ দিয়ে। ‘কান নিয়ে গেল চিলে’ শুনে কোনো কিছুই যাচাই না করেই চিলের পেছনে ছুটতে থাকেন। নিজের চিন্তা, বিবেক ও বিবেচনা বোধ কাজে না লাগিয়ে যা খুশি তাই মন্তব্য করেন। এই হুজুগপ্রিয়তাও ক্রিকেটের জন্য মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। সম্মিলিতভাবে যদি ক্রিকেট নিয়ে অবিবেচনাপ্রসূত ও নেতিবাচক মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হয়, তা ক্রিকেটারদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়।

ভারতে আয়োজিত ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স এখন হট টপিকস। এ নিয়ে তুমুলভাবে আলোড়িত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসরে বাংলাদেশ দল টপ ফেবারিট নয়। তবে বিগত চারটি বিশ্বকাপে টাইগারদের পারফরম্যান্স যথেষ্ট আশাবাদী করে তোলে। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ডের মতো দলকে হারিয়ে সাড়া জাগায়। এ ছাড়া প্রতিটি আসরেই জয়ী হয় তিনটি করে ম্যাচে। সে আলোকে এবারের সেমিফাইনালে খেলার প্রত্যাশা করা হয়েছিল। প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে, নাও পারে। না হলে নিরাশ হওয়া যেতেই পারে। তবে পূরণ না হলে ক্রিকেটার তামিম ইকবালের ভাষায়, তাতে দুনিয়া শেষ হয়ে যায় না।

এবারের দলগঠন থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক অনেক বিষয় প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য দল যেভাবেই গঠন করা হোক না কেন, সমালোচকদের কাছ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মুশকিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে অযৌক্তিক সমালোচনা হয়, তা কিন্তু বলা যাবে না। যা হোক, প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে হারানোর পর থেকে কোনো কিছুই ঠিকঠাক মতো হচ্ছিল না। কঠিন ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে দল হারতেই পারে। কিন্তু যেভাবে একের পর এক প্রতিরোধহীনভাবে হারতে থাকে, তা একদমই স্বাভাবিক ছিল না। যেন দুষ্টু কোনো এক জাদুকরের কুমন্ত্রণায় ক্রিকেটাররা খেলতে ভুলে যান। খানিকটা ব্যতিক্রম ছিলেন বয়সের দিক দিয়ে দলের সবচেয়ে সিনিয়র ক্রিকেটার মাহমুদউল্লাহ। যাঁদের ঘিরে অনেক বেশি প্রত্যাশা করা হয়, সেই সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস, নাজমুল হোসেন শান্ত, তাসকিন আহমেদরা নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। কী কারণে দল পথ হারিয়ে ফেলে, ক্রিকেটাররা তো বটেই, টিম ম্যানেজমেন্ট তার সদুত্তর দিতে পারেনি। সবাই একরকম অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে। ব্যর্থতার দায় মেনে নিয়েছেন কোচ, ক্রিকেটাররা। দলের ব্যর্থতায় গঠনমূলক সমালোচনা হওয়াটা অমূলক নয়। তাতে দলকে পরিশুদ্ধ বা সঠিকভাবে পরিচালনা করার একটা দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। সমালোচকদের মনোভাব তো তেমনই হওয়া উচিত। কিন্তু যেভাবে শুরু থেকে ব্যক্তিকে টার্গেট করে তুলোধুনো করা হয়, তা মোটেও ক্রিকেটীয় ছিল না। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের পরও সমালোচনার তীব্রতা হ্রাস পায়নি। সমালোচনার নামে রুচিহীনতার চরম প্রকাশ দেখা যায়। ক্রিকেটাররা খেলতে এসে বোধকরি মহা অন্যায় করে ফেলেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই যেন এক একজন রোবট, সমালোচকদের মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী খেলতে হবে, চলতে হবে। এ মনোভাব কি সুস্থ মানসিকতার প্রতিফলন?

ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। অবশ্য এবারে তাঁর পারফরম্যান্স নিয়ে সমালোচনা না হওয়ার কোনো কারণ নেই। এজন্য তিনি নিজেই বোধকরি দায়ী। তিনি প্রত্যাশার যে মানদণ্ড গড়ে দিয়েছেন, তার কমতি হওয়ায় অনেকেই মানতে পারছেন না। ২০১৯ বিশ্বকাপে তৃতীয় সর্বাধিক ৬০৬ রানের পাশাপাশি নিয়েছেন ১১ উইকেট। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন সেরা অলরাউন্ডার। এবারো তেমনটাই আশা করা হয়েছিল। তিনি তা পূরণ করতে পারেননি। তবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অলরাউন্ড নৈপুণ্য দিয়ে দলকে জয় এনে দেন। সব মিলিয়ে ১৮৬ রান আর ৯ উইকেট পাওয়া তাঁর মতো ক্রিকেটারের জন্য সন্তোষজনক নয়। তিনি মূলত সমালোচকদের টার্গেটে পরিণত হন দল থেকে তামিম ইকবালের বাদ পড়ার কারণে। সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু ক্রিকেটার হিসেবে সাকিবের বিকল্প কেউ কি আছেন? তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সেরা ক্রিকেটার হিসেবে মেনে না নেওয়ার কারণ নেই। কেননা, আইসিসির র্যাকিংয়ে তিনি নিজেকে সেরা প্রমাণ করেছেন। শুধু তিনি কেন, দলের অন্যান্য ক্রিকেটার, টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচক, কর্মকর্তারাও সমালোচকদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গঠনমূলক সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু সমালোচনার নামে গালাগালি এবং তাঁদের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করা কী ধরনের মনোবৃত্তি?

ক্রিকেটের একজন তাত্ত্বিক হিসেবে সুপরিচিত ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর সন্তান সি এল আর জেমস গভীর উপলব্ধি থেকে তাঁর বিখ্যাত ‘বিয়ন্ড অ্যা বাউন্ডারি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যারা শুধু ক্রিকেটকেই জানে, তারা ক্রিকেটের কতটুকুই আর জানে?’ আসলে তাঁর মতো করে সবার পক্ষে জানা সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু আনন্দ, বিনোদন ও উন্মাদনার অংশ হিসেবে ক্রিকেটের প্রতি যাঁরা আকৃষ্ট হয়েছেন, তাঁদের তো এ খেলার প্রতি আবেগ থাকবে। আন্তরিকতা থাকবে। ভালোবাসা থাকবে। তার একটা নান্দনিক প্রকাশও থাকবে। কিন্তু বড় একটা অংশ মর্ম ও মর্যাদা বুঝতে না পেরে হুজুগে ক্রিকেট খেলায় ঝুঁকেছেন। সেটা হয়তো খারাপ কিছু নয়। তবে এ খেলা সম্পর্কে কিছু না বুঝে তীব্র সমালোচক হয়ে উঠা, বিপত্তি সৃষ্টি করে। অবশ্য তাঁদের চেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা খেলাটি বুঝেও অবুঝের মতো আচরণ করেন।

লেখক: সম্পাদক, পাক্ষিক ক্রীড়াজগত

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ