ঢাকা কি পরিত্যক্ত শহরের দ্বারপ্রান্তে
২০২২ সালের আদমশুমারি থেকে জানা যায় ঢাকায় প্রায় ১ কোটি ২ লাখের অধিক মানুষ বাস করে। আর ঢাকা বিভাগের লোকসংখ্যা ৪ কোটি ৪২ লাখেরও বেশি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ ভাগ। জাতিসংঘের হ্যাবিটেট প্রতিবেদনে ২০১৭ সালে ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ২ মার্চ আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে রেখেছে রাজধানী ঢাকাকে।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির ২০২২ সালের এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বায়ুদূষণের পর শব্দদূষণেও বিশ্বের শীর্ষ স্থানটি দখল করেছে ঢাকা। এতটুকু পরিসংখ্যান জানলেই সিদ্ধান্ত নেয়া যায় ঢাকা আর বসবাসযোগ্য নেই। ঢাকার যেদিকেই যাওয়া হোক, দেখা যাবে মানুষের মাথা মানুষে খায়। চারদিকে নোংরা। প্রতিটি রাস্তার মোড়ে আবর্জনার স্তূপ। হাইরাইজ বিল্ডিং উঠছে সমানে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নও হচ্ছে সমানতালে। নেই কোনো পুকুর, খাল, জলাশয়। গাছ কেটে সাফ করে ফেলা হয়েছে।
ঢাকার মাঝখানে রমনা পার্ক আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কিছু গাছ ছাড়া পুরো শহরে কোনো গাছগাছালি নেই। এই ঢাকা শহরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে কোনো পরিসংখ্যানেরও প্রয়োজন নেই। দিব্যচোখেই তা দেখা যায়। এর মধ্যে দুঃসংবাদ হয়ে এলো এমন একটি খবর, যা আমাদের ঢাকাবাসের জীবনকে আরও তিক্ত করে তুলবে। গতকাল সোমবার (২২ এপ্রিল) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দীর্ঘমেয়াদি সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, ঢাকার বাতাসে পাঁচ ধরনের গ্যাস জমা হচ্ছে, যা শহরবাসীর নানা রোগবালাই এবং সমস্যা বাড়ানোর পাশাপাশি বাতাসকে আরও উত্তপ্ত করে তুলছে।
পাঁচ ধরনের গ্যাস হচ্ছে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড ও ওজোন। এসব গ্যাস ১০ থেকে ৪০০ বছর পর্যন্ত শহরের বাতাসে রয়ে যেতে পারে। আরেকটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, এ ধরনের গ্যাস ও অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে ঢাকার ময়লার ভাগাড়গুলোতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে ওই গবেষণা করা হয়েছে। এতে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০টি ময়লার ভাগাড় এবং রমনা পার্কের ময়লা ফেলার জায়গাগুলোর ওপর সমীক্ষা করা হয়েছে।
সমীক্ষায় রমনা পার্ক ছাড়া বাকি সব জায়গায় গ্যাসের পরিমাণ বিপজ্জনক পর্যায়ে পাওয়া গেছে। সেখানকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম ২ দশমিক ৫ ও পিএম ১০ এবং ওই গ্যাসগুলোর পরিমাণ ক্ষতিকর মাত্রায় পাওয়া গেছে। গবেষণার এই ফলাফল গত বছরের নভেম্বরে বিজ্ঞান সাময়িকী স্প্রিঞ্জার নেচার-এ প্রকাশিত হয়েছে। ‘ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় ময়লার ভাগাড়ে গ্যাস নিঃসরণ’ শীর্ষক গবেষণাটিতে বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাসের উপস্থিতির বিষয়টি উঠে আসে।
কদিন ধরে সারা দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। ঢাকায় গরম অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে। যথেষ্ট গাছপালা ও জলাধার না থাকায় ঢাকায় জলীয়বাষ্পের পরিমাণও কম। খোলামেলা জায়গার অভাবে মানুষ কোথাও গিয়ে স্বস্তিতে বসতেও পারছে না। যাদের বাড়িতে এসি নেই এবং হঠাৎ যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায়, তাদের জন্য এই তাপদাহ নারকীয়।
এখন তাহলে করণীয় কী? কর্মসংস্থান, সন্তানের ভালো লেখাপড়া, সুচিকিৎসাসহ নানা নাগরিক সুবিধাপ্রাপ্তির আশায় অনেকে রাজধানী ঢাকায় থাকতে বাধ্য হন। ঢাকায় ঘনবসতির একটা বড় কারণ বিকেন্দ্রীকরণের অভাব। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানসহ দেশের বেশির ভাগ ভালো-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল সবই ঢাকায় অবস্থিত। ফলে ঢাকায় যারা স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, তারা ছাড়াও প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ ঢাকায় আসতে বাধ্য হন। অনেক বছর ধরেই বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে কথা বলছেন দেশের নীতিনির্ধারক, বুদ্ধিজীবীরা; কিন্তু তাতে কোনো ফল হচ্ছে না।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে আমাদের গণসচেতনতার অভাব। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় যারা আসেন তাদের নাগরিক সচেতনতা নেই। ঢাকার প্রতি তাদের ভালোবাসাও নেই। ফলে ঢাকার পরিবেশ-প্রকৃতির প্রতিও তাদের যত্ন নেই। আরও হাজারটা কারণ উল্লেখ করা যায়। কারণ যা-ই হোক, ফল যে দিন দিন ভয়াবহ আকারে প্রকাশ পাচ্ছে, তা তো আমরা চোখেই সামনেই দেখছি। তাহলে কি ঢাকাকে পরিত্যক্ত শহর ঘোষণা ছাড়া উপায় নেই?
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে