Views Bangladesh Logo

সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব কি শুধুই নির্বাচন প্রশ্নে?

Amin Al  Rasheed

আমীন আল রশীদ

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এবং মির্জা আব্বাস সম্প্রতি এমন কিছু কথা বলেছেন, যাতে মনে হচ্ছে বিএনপি বুঝি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান বিরোধী দল। যদিও অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পরে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় বিএনপিও বড় ভূমিকা রেখেছে। বিএনপি শুরু থেকেই বলছে যে, এই সরকার তাদের সরকার; কিন্তু দেখা গেল, গত বছরের ৮ আগস্ট এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মাস কয়েক পর থেকেই বিএনপির সঙ্গে তাদের দূরত্ব বা টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। তাতে প্রশ্ন উঠছে, সরকারের সঙ্গে বিএনপির এই দূরত্ব কী শুধুই নির্বাচন প্রশ্নে নাকি এর পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে?

কে কী বলছেন?
১. গত ১৫ মে বিকেলে কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বিএনপির সদস্য ফরম বিতরণ ও সদস্য নবায়ন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বর্তমান সরকারের কাছে নিরাপদ নয়, দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা আজ হুমকির মুখে। আগে আমরা কুকুরের মুখে ছিলাম, আজ কুকুর থেকে বাঘের মুখে পড়েছি।’

২. গত ১৭ মে রাতে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘করিডোর কিংবা বিদেশিদের হাতে চট্টগ্রাম বন্দর দেয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেই। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার রাজনৈতিক সরকারের।’ তারেক রহমান বলেন, ‘সরকারের ভেতরে অস্থিরতা দৃশ্যমান হচ্ছে। তাদের সক্ষমতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠছে। উপরন্তু তারা সংস্কারের কথা বলে নানা কৌশলে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে।’

৩. একই দিন দুপুরে খুলনার সার্কিট হাউস মাঠে এক সমাবেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আপনার সরকারে একজন বিদেশি নাগরিককে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করেছেন। আপনার কি সেই আক্কেলজ্ঞান নেই- একজন বিদেশি নাগরিকের কাছে এই দেশের সেনাবাহিনী কীভাবে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রদান করবে! তিনি রোহিঙ্গা করিডোরের নামে, মানবিক করিডোরের নামে বাংলাদেশকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে চান। সেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে বিদায় করুন।’ সালাহউদ্দিন আরও বলেন, ‘বিদেশে আপনি কী কন্ট্রাক্ট করে এসেছেন জানি না। আপনি অবলীলাক্রমে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর, নদীবন্দর, করিডোর সব বিদেশিদের কাছে হস্তান্তর করবেন- কী চুক্তি করে এসেছেন? কী এখতিয়ার আছে আপনার? কী ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছেন।’ (ডেইলি স্টার অনলাইন, ১৭ মে ২০২৫)।

৪. গত ১২ মে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘দেশে অনেক সন্দেহভাজন বিদেশির আগমন ঘটেছে। বিভিন্ন সময় তারা বিভিন্ন মিশন নিয়ে আসছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কারও পারপাস সার্ভ করছে। এই সরকার কোনো পরিস্থিতিতেই জনগণবান্ধব কিংবা দেশপ্রেমিক সরকার নয়। সরকারের অনেক উপদেষ্টা বাংলাদেশের নাগরিক নন। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা কি ঔপনিবেশিক শাসনে আছি?’

বিএনপির ভাষা কেন বদলে যাচ্ছে?
সম্প্রতি বিএনপির আরও একাধিক সিনিয়র নেতা মোটামুটি একই ভাষায় ও ভঙ্গিতে কথা বলেছেন। সরকারকে লক্ষ্য করে তাদের সমালোচনা তথা বাক্য ও শব্দচয়ন ক্রমেই আক্রমণাত্মক হচ্ছে। শুরুর দিকে সরকারকে সমর্থন দেয়া, বিচার ও সংস্কারের পাশাপাশি একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া তথা গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরুর জন্য বিএনপির যে অবস্থান ছিল, সেখানে ক্রমেই পরিবর্তন আসছে। দলটি হয়তো বুঝতে শুরু করেছে বা আগে বুঝতে পারলেও এখন হয়তো তাদের ধারণা শক্ত হচ্ছে যে, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুত সময় তথা আগামী ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে না। তারা হয়তো ধারণা করছে যে, জাতীয় নাগরিক পার্টি এমনকি তাদের সঙ্গে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো ধর্মভিত্তিক দলগুলোও এমন সব এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নামবে এবং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে, যাতে নির্বাচন আরও পিছিয়ে যাবে।

শুরুর দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারে বিএনপির ইতিবাচক টোনের প্রধান কারণ ছিল সম্ভবত এই যে, তারা ভেবেছিল অথবা তারা বিশ্বাস করেছিল যে, সরকার দ্রুতই কিছু জায়গায় সংস্কার এবং জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার অভিযোগে দায়েকৃত মামলাগুলোর বিচারের প্রক্রিয়াটি শুরু করে দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবে। বৃহত্তর সংস্কার এবং বিচারের প্রক্রিয়াটি নির্বাচিত সরকার এসে শেষ করবে। বিএনপির তরফে এই ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছিল যে, তারা যদি সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভও করে, তারপরও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে একটি জাতীয় সরকার গঠন করবে এবং সবার মতামতের ভিত্তিতে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।

কিন্তু বিএনপি হয়তো এখন মনে করছে বা বিশ্বাস করছে যে, সরকার এবং তাদের প্রধান স্টেকহোল্ডার বলে পরিচিতি (বিবেচিত) জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) যা বলবে, যা চাইবে, তার বাইরে যাবে না। অথবা সরকার যা করতে চায়, সেটি এনসিপিকে দিয়ে করাবে কিংবা এনসিপির মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করাবে। এ কারণেই হয়তো সালাহউদ্দিন আহমদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানকে উদ্দেশ করে বলেছেন,‘ আপনার সরকারকে লোকজন বলছে এনসিপি মার্কা সরকার। আপনার সরকারে এনসিপির দুজন প্রতিনিধি বিদ্যমান। তারা উপদেষ্টা এবং এনসিপি করে। আপনি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে চাইলে এনসিপি মার্কা দুজনকে পদত্যাগ করতে বলুন। পদত্যাগ না করলে আপনি বিদায় করুন।’

এনসিপি একেবারেই নতুন একটি দল- যারা এখনো নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিতই হয়নি; কিন্তু তারপরও বিএনপি হয়তো মনে করছে বা দেশের রাজনীতিসচেতন মানুষেরও অনেকে মনে করেন যে, আগামী নির্বাচনের বিএনপির জন্য এই দলটিই হয়তো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এনসিপি হয়তো এককভাবে তিনশ আসনে প্রার্থী দেবে না; কিন্তু তারা যদি বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াত এবং চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে নির্বাচনি জোট করে; যদি হেফাজতে ইসলামও ওই জোটকে সমর্থন দেয় তাহলে বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়বে কি না- এমন আলোচনাও আছে। যেহেতু আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, অতএব, আগামী নির্বাচনে তারা যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত।

তাহলে আওয়ামী লীগের ভোটগুলো কারা পাবে, তা নিয়েও নানারকম আলোচনা আছে। এটা ঠিক যে, আওয়ামী লীগের ভোট এনসিপি বা ইসলামপন্থি দলগুলো পাবে না। তাহলে কি আওয়ামী লীগের ভোটও বিএনপি পাবে? যদি তাই হয়, তাহলে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাই প্রবল। এই অঙ্কটি এনসিপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম- সবারই আছে। সুতরাং বিএনপিকে যদি তারা ক্ষমতায় আসতে দিতে না চায়, তাহলে তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা হবে নির্বাচনটি পিছিয়ে দেয়া এবং এমন সব ইস্যু সামনে নিয়ে আসা বা এমন সব পরিস্থিতি তৈরি করা, যাতে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব না হয়। প্রশ্ন হলো, বিএনপির বাইরের দলগুলো কেন এটা চাইবে বা বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাদের অসুবিধা কী?

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একজন সিনিয়র নেতাকে এই প্রশ্নটি করেছিলাম। তিনি বলেছেন, নির্বাচিত সরকার এলেই যে দেশ সঠিক পথে চলবে বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে, সেটি তারা মনে করেন না। কেননা, অতীতেও নির্বাচিত সরকার ছিল এবং জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেই তারা স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট ও গণবিরোধী হয়ে উঠেছে। সুতরাং, নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই একমাত্র সমাধান নয় বলে তারা মনে করেন। সে কারণে তারা রাজনীতিতেই কিছু মৌলিক সংস্কার চান এবং সেই সংস্কারগুলো নিশ্চিত হওয়ার আগে নির্বাচন হলে দেশ আগের ধারাতেই চলবে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

তার মানে এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সতীর্থ দলগুলোর মধ্যেও এখন আগামী জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি নিয়ে ঐক্য স্থাপিত হয়নি। এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি ও হেফাজত নির্বাচনের রোডম্যাপ ইস্যুতে একই সুরে কথা না বলছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সরকার হয়তো নির্বাচনের সুষ্ঠু তারিখ ঘোষণা করবে না। এখানে আরেকটি জটিলতা হলো, আগামী জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে বললেও সেটি কী নির্বাচন হবে, সেটি কি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, সেটি কি গণপরিষদ নির্বাচন হবে, সেটি কি ইউনূস সরকারের বৈধতার প্রশ্নে হ্যাঁ-না ভোট হবে নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে- তা এখনো পরিষ্কার নয়। ফলে বিএনপির সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরির পেছনে নির্বাচন নিয়ে এই ধরনের ক্যামোফ্লাজ বা ধোঁয়াশাও একটি বড় কারণ বলে মনে হয়। যেরকম ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর, উপদেষ্টা পরিষদে বিদেশি কিংবা দ্বৈত নাগরিক, বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিদেশি নাগরিকত্বের বিষয়টি নিয়ে।

বিএনপি যদি সত্যিই মনে করে যে, ড. ইউনূসের সরকার ‘অন্য কোনো দেশের পারপাস সার্ভ’ করছে; বিএনপি যদি মনে করে যে, করিডোর ও চট্টগ্রাম বন্দর ইস্যুতে সরকার ‘হাইড অ্যান্ড সিক’ করছে- তাহলে এটি একটি বিষয়। আর যদি বিষয়টি এমন হয় যে, তারা দ্রুত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নানারকম নেতিবাচক ন্যারেটিভ তৈরি করে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছে- সেটি আরেকটা দিক। এমতাবস্থায় সরকারের উচিত হবে, যেসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বা বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করা। তারা যে সত্যিই কোনো বিদেশি কোম্পানি বা অন্য কোনো দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে না; তাদের উপদেষ্টা পরিষদে যে সত্যিই কোনো বিদেশি বা দ্বৈত নাগরিক নেই- সেটির তথ্যপ্রমাণ জনসমক্ষে উপস্থাপন করা উচিত। তাহলে বিএনপির অভিযোগগুলো যে নিতান্তই রাজনৈতিক বক্তব্য, সেটি যেমন মানুষ বুঝতে পারবে, তেমনি সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সংশয় থাকলে সেটিও দূর হবে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ