Views Bangladesh Logo

মব ভায়োলেন্স ও জননিরাপত্তা

সরকারের কাজ কি শুধু জনতাকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানানো!

হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রতিশোধমূলক হামলার আশঙ্কা ছিল প্রবল। অনেকেই ভেবেছিলেন, ক্ষমতার পালাবদলের পর রাজনৈতিক প্রতিশোধ অনিবার্য। ইতিহাসও সে কথাই বলে। অতীতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় দেশে সহিংসতা, সম্পদ ধ্বংস ও প্রতিপক্ষের ওপর হামলার নজির কম নেই; কিন্তু ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন এক নজিরবিহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের বিদায় ঘটে, যার ফলে তৃণমূল পর্যায়ের সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের পালিয়ে যেতে হয়, আর যারা পারেনি, তাদের ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়। তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়, এমনকি পুলিশ বাহিনীকেও তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়, যার ফলে সেনাবাহিনীর ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায় বর্তায়।

তবে প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিশোধমূলক হামলার মাত্রা কমবে; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সরকার মুখে হামলা বন্ধের আহ্বান জানালেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি ভারত থেকে শেখ হাসিনার ‘ছাত্রসমাজের উদ্দেশ্যে’ বক্তব্য রাখার খবর ছড়ানোর পর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক ভবনটিও কিছু মানুষের আক্রোশে ধ্বংস হয়। শুধু এই ভবন নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে একই ধরনের ঘটনা ঘটে, যেখানে বুলডোজার পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। হাসিনা সরকার পতনের ৬ মাস পরও এ ধরনের সহিংসতা থামেনি বরং সরকারের ব্যর্থতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

এখনো বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘরে হামলা হচ্ছে। অনেকের লাশ মিলছে বাড়ির আশপাশে। এসবই মব-ভায়োলেন্সের ফল। বইমেলার একটি স্টলে হামলা, একটি জেলায় হুমকির মুখে লালন উৎসব বন্ধ করে দেয়া, ফুলের দোকানে হামলা, নাট্য উৎসব বন্ধ করে দেয়া, খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রামদা, ছুরি নিয়ে ছাত্রদের দুগ্রুপের ফ্রিস্টাইলে মারামারি ইত্যাদি ঘটনা জনমনে উদ্বেগকে বাড়িয়ে তুলছে। এখন শুরু হয়েছে দেশব্যাপী চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের মহোৎসব। যেসব মানুষ মৌলিক পরিবর্তন চেয়েছে, শান্তি ও নিরাপত্তা খুঁজেছে, তারা হতাশ হয়ে পড়েছে। এখানেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।

আসলে অনেক রকম এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নামা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরুতে মব ভায়োলেন্স বন্ধের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেয়নি বরং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বদলে কেবল মৌখিক আহ্বান জানিয়েছে। সরকারের কাজ কি শুধু জনতাকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানানো, নাকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ? এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন। প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানের পরও মব ভায়েলেন্স বন্ধ হয়নি। এমনকি সরকারে থাকা এক তরুণ উপদেষ্টার কঠোর বক্তব্যের পরও না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া শক্তিগুলো মব ভায়োলেন্সের সঙ্গে জড়িত কি না, সেই প্রশ্নও ওঠে।

গণ-অভ্যুত্থানের পর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে, এটি স্বাভাবিক; কিন্তু ৩২ নম্বরের বাড়ি ধ্বংস করা বা মুক্তিযুদ্ধের স্মারক গুঁড়িয়ে দেয়াকে কতটা ‘স্বাভাবিক’ বলা যায়? এর পেছনে যুক্তি ছিল, অপরাধীদের ছাড় দেয়া হলেও ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেয়া হবে না; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। মব ভায়োলেন্সের প্রবণতা সরকারের পুনর্গঠনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধুই প্রতিশোধ, নাকি বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিস্তার- এ প্রশ্নও এখন সামনে আসছে।

মব ভায়োলেন্সের শিকার শুধু ক্ষমতাচ্যুত সরকারের লোকজনই হয়নি, বরং সন্দেহের ভিত্তিতে নিরীহ মানুষকেও হত্যা করা হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে, মাজার ও কিছু গণমাধ্যমও আক্রান্ত হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব ঘটনার ওপর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

সাংবাদিকতার মতো একটি পেশায় থাকা ব্যক্তিদের মবের হাতে আক্রান্ত হওয়াও উদ্বেগজনক। স্বৈরাচারী সরকারের দোসরদের বিচার হওয়া উচিত; কিন্তু আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া বাছ-বিচারহীন প্রতিশোধ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথকে বাধাগ্রস্ত করবে। এর ফলে সরকারের সংস্কার উদ্যোগ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের প্রচেষ্টাও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

প্রথম থেকেই সরকারের উচিত ছিল মব ভায়োলেন্স নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকার সময় সেনাবাহিনীও যথাযথ ভূমিকা নেয়নি। যদিও সেনাসদস্যরা মাঠে রয়েছে এবং তাদের হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তবু কেন তারা কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি, সেই প্রশ্নও উঠছে।

সরকারের ছয় মাস পূর্তির সময় একটি বিশেষ অভিযান চালু করা হলেও মব নিয়ন্ত্রণে তা কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকত, তবে এ ধরনের অভিযানের প্রয়োজন পড়ত না। বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে, দেশে একটি ‘সমান্তরাল প্রশাসন’ কার্যকর হয়ে উঠছে, যা সাধারণ জনগণকে হতাশ করে তুলছে।

বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও মব ভায়োলেন্স নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনকি তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা করেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও মব সহিংসতার বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছে। সরকার এই প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছে; কিন্তু এখন প্রয়োজন বাস্তব পদক্ষেপ। ক্ষমতাচ্যুত অপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি মবের তৎপরতা বন্ধ করাও জরুরি।

গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেক প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি, তবে তাদের সুযোগও সীমিত ছিল। বিপুল বাধা-বিপত্তির মধ্যে দিয়ে এগোতে হয়েছে তাদের। কিন্তু মব ভায়োলেন্স নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা সরকারের সামগ্রিক সক্ষমতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

পণ্যবাজার নিয়ন্ত্রণের মতোই সরকার যদি মব নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ হয়, তবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হবে। আন্তর্জাতিক মহলেও সরকারের ভাবমূর্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য ন্যূনতম সংস্কার অপরিহার্য, আর সেই লক্ষ্যে সরকারকে এখনই মবের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচারহীনতা ও প্রতিশোধের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মবের হাতে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের সুযোগ তৈরি হলে, এটি শুধু সরকার নয়, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকেও সংকটে ফেলে দেবে।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ