‘জুলাই গণহত্যার’ বিচার কি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সম্ভব?
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বুধবার (১৪ আগস্ট) বলেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় জুলাই গণহত্যা ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে বিচার করা সম্ভব। তিনি বলেন, ‘জুলাই গণহত্যা বলতে আমরা অগাস্টের প্রথম পাঁচ দিনের গণহত্যাও বোঝাচ্ছি, এটার জন্য দায়ী যে ব্যক্তিবর্গ আছেন, তাদের বিচারের জন্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচারের জন্য আমরা ইতোমধ্যে একটা ছোটখাটো গবেষণার মতো করেছি।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ এমন বিচার করা কি সম্ভব?
একাত্তরে গণহত্যা, ধর্ষণের মতো অপরাধের বিচারে ১৯৭৩ সালের ২১ জুলাই ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস’ আইন তৈরি করা হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান এ আইন বাতিল করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ১৯৭৩ সালের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ আইনের আওতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে ২০০৯ ও গঠনের পরে ২০১৩ সালে আইনের সংশোধন হয়েছে। পরে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইন (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্স) অনুযায়ী বিভিন্ন সময় দেশে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, দেশান্তরিতকরণের মতো গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটানো হলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের সব কাঠামো ঠিক রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হয়। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই দেশে সংঘটিত যেকোনো হত্যা বা গণহত্যার বিচার করা সম্ভব।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, রোম সনদ অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ যেই দেশে সংঘটিত হয়, সেই দেশ যদি বিচারের আয়োজনে অপারগ, ব্যর্থ ও অনিচ্ছুক থাকে; তাহলে অন্য কোনো দেশ জাতিসংঘে আবেদন করলে এই অপরাধগুলোর বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে হবে। তবে বাংলাদেশ নিজস্ব আদালত গঠনের মাধ্যমে এসব অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। সংবিধান অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গড়ে তোলে বাংলাদেশ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে এই ট্রাইবুনাল করেছে। তিনি বলেন, ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড যাকে জুলাই গণহত্যা বলা হচ্ছে তার বিচারও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা সম্ভব। তবে এটি যে হত্যা বা গণহত্যা তা প্রমাণ করতে হবে।
উল্লেখ্য, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে। ১৪ আগস্ট বুধবার আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম এ অভিযোগ দায়ের করেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত বাগেরহাটের আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা মো. বুলবুল কবিরের পক্ষে অ্যাডভোকেট গাজী এম এইচ তামিম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় এ আবেদন করেন। একই অপরাধে ব্যক্তির পাশাপাশি দল এবং সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে আবেদনে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে অন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, তারা হলেন- সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
এছাড়া রয়েছেন— পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশিদ। এসব আসামির পাশাপাশি নাম উল্লেখ না করে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা চাওয়া হয়েছে আবেদনে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে