Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

টেলিভিশনের ভবিষ্যৎ কি ফিকে হয়ে আসছে!

Mamun–Or–Rashid

মামুন–অর–রশিদ

বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ছর চল্লিশ আগের কথা একদিন মায়ের সঙ্গে এক অভিজাত পরিবারে বেড়াতে গেছি। তখনো আমাদের গ্রামে কিম্বা তার আশপাশে কোথাও টেলিভিশন ছিল না। শুধু এতটুকু কেবল জানতাম একই সঙ্গে শব্দ ও ছবি দেখা যায়, টেলিভিশন এমন এক ধরনের যন্ত্র। তখন আমরা রেডিও শুনতাম গ্রামের তাও প্রতিটি ঘরে রেডিও ছিল না। যেসব বাড়িতে রেডিও ছিল বিশেষ অনুষ্ঠান শুনতে সেখানেই মানুষ ভিড় করত। স্পষ্ট মনে আছে শুক্রবার বিকেলে খুলনা বেতারে এক ঘণ্টার নাটক প্রচার করত। সবাই আগ্রহ নিয়ে শুক্রবার বিকেলে নাটক শুনতে বসতেন। অনেক সময় পাশের বাড়ি কিম্বা তার পাশের বাড়ির মানুষও বসে যেতেন। খুলনাঞ্চল থেকে কলকাতা বেতার শোনা যেত। নিজস্ব অনুষ্ঠানের পর ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠানও সম্প্রচার করত খুলনা বেতার। সেই বেতার শোনা মানুষের হঠাৎই টেলিভিশন দেখতে আগ্রহ জন্মাল। আমি আগে থেকে শুনে গেছি সেই অভিজাত বাড়িতে টেলিভিশন আছে। তখন দিনেরবেলা, টেলিভিশনে কোনো অনুষ্ঠান হয় না; কিন্তু টেলিভিশন দেখতে কেমন হয়? আমি তাই দেখতে চাইলাম। পাশেই সুন্দর সাদা কাপড়ে ঢাকা একটি যন্ত্রকে দেখিয়ে মা বলল এইতো টেলিভিশন দেখ। আমার সেই কাপড় তুলতে সাহস হয়নি। ছুয়েও দেখতে পারেনি। তবে মনের মধ্যে একটা ধারণা ছিল। দেড় হাত লম্বা আর আধা হাত চওড়া একটি যন্ত্রই হলো টেলিভিশন। যারা আশির দশকের শেষের দিকের মানুষ তারা ধরতে পারছেন এটি আসলে ক্যাসেট প্লেয়ার। প্রথম যেদিন আমি ন্যাশনাল ব্র্যান্ডের ক্যাসেট প্লেয়ার দেখলাম, বহুদিন আগে দেখা সেই টেলিভিশনের কথা মনে পড়ল। আরে ওটাতো টেলিভিশন ছিল না। এই হচ্ছে আমার ছোটবেলায় টেলিভিশন দেখার গল্প।

এখনের মতো তখনো বিশ্বকাপ ফুটবলের উত্তেজনা ছিল। বরং এখনের চাইতে অনেক বেশিই ছিল। সালটা ১৯৮৬ ম্যারাডোনা তখন তুমুল জনপ্রিয়। আমাদের গ্রাম নড়াইলে আমাদের বাড়ি প্রথম টেলিভিশন গেল। আমাদের নওয়াগ্রামে সেই প্রথম টেলিভিশন গেল। এখনো কোনো কোনো পুরোনো মানুষ সেই গল্প বলেন। তখন হেমন্ত নতুন ধান উঠেছে। আমার স্মৃতিতে এখনো আবছা সেই স্মৃতি। তখন বিশ্বকাপ চলছিল। বেশ রাতে বিশ্বকাপের খেলাগুলো শুরু হতো। সেই খেলা শুরুর আগে হতো সিনেমার গানের অনুষ্ঠান ছায়াছন্দ। আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রতি তিন মাস পর পর একবার ছায়াছন্দ হতো। টেলিভিশনে তখন সারা বছর কবে কি অনুষ্ঠান হবে এমন বই কিনতে পাওয়া যেত। প্রতি তিন মাস কিম্বা চার মাস অন্তর একটি প্রান্তিক ভাগ করা হতো। ম্যারাডোনার সেই বিশ্বকাপ খেলা দেখে অনেকে নতুন ধানের খড় বিছিয়ে উঠানেই ঘুমিয়ে যেতেন। আমি ভোরে ঘুম থেকে উঠে তাদের অনেককেই ডেকে তুলতাম। টেলিভিশন দেখতে কয়েকশ মানুষ এক জায়গায় জড়ো হয় এখনকার কেউ হয়তো এটি বিশ্বাসই করবে না। আমি নিজের চোখে কয়েক কিলোমিটার দূরে থেকে হেঁটে টেলিভিশন দেখতে আসা সেই মানুষগুলোকে দেখেছি। প্রথম প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনে অনুষ্ঠান শুরু হতো সেই সন্ধ্যাবেলা। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম তখন টেলিভিশন খুলবে সেই প্রত্যাশায়। তখন তিন মাসে একবার রাত ১০টার ইংরেজি সংবাদের পর একবার বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্র প্রচার হতো। গভীর রাতে সেই অনুষ্ঠান শেষ হতো। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ সিনেমা দেখতে আসতো। এরপর যখন শুক্রবার বিকেলে চলচ্চিত্র প্রচার শুরু হলো এই সেদিনের কথা। তখনও ঘর থেকে উঠানে টেলিভিশন নামিয়ে দিতে হতো। অনেকের মনে থাকার কথা, ১৯৯০ সালে যখন ইরাক কুয়েত দখলের চেষ্টা করে, কখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা করে। আমি তখন চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার একটি গ্রামে থাকি রোজ রাত ৮টার ইউনিয়ন পরিষদে থাকা একমাত্র টেলিভিশনে একসঙ্গে বসে কয়েক শত মানুষ খবর দেখতো। টেলিভিশনের শব্দ একেবারে পেছন পর্যন্ত পৌঁছাতো না। একেবারে শেষে থাকা মানুষ সামনের মানুষের কাছে শুনতে চাইতো খবরে কি বলল। তখন সাদ্দাম হোসেন বাঙালি মুসলমানের কাছে হিরো হয়ে ওঠেন।

গ্রামে গ্রামে যখন দ্রুত বিদ্যুৎ যেতে শুরু করে টেলিভিশন দ্রুত মানুষের ঘরে ঢুকতে শুরু করে। একসময় সাদা-কালো টেলিভিশনের ওপর রঙিন স্বচ্ছ এক ধরনের প্লাস্টিকের কাগজ লাগিয়ে অনেকে রঙিন টেলিভিশনের আক্ষেপ মেটাতেন। রঙিন টিভি দাম কত? কারা এসব দেখেন? তা নিয়েও মানুষের মধ্যে আগ্রহের কমতি ছিল না। দেশে রঙিন টিভি বলতে ছিল পুরোনো জাপানি ব্র্যান্ড সনি। তখনো সাদা-কালোতে ন্যাশনালই সেরা ছিল। এরপর নিপ্পন, নিক্কন এসব কোম্পানিগুলো তুলনামূলক কম দামে টেলিভিশন বিক্রি করতে শুরু করে। এভাবে টেলিভিশনের বিস্তার হয়। ধীরে ধীরে বাণিজ্যিক যাত্রায় টেলিভিশন হয়ে ওঠে সব চাইতে শক্তিশালী গণমাধ্যম।

বাংলাদেশে নব্বই দশকের শুরু থেকে পরবর্তী প্রায় পঁচিশ বছর টেলিভিশন এক চেটিয়া রাজত্ব করেছে। স্মার্ট ফোনের বিকাশ ইন্টারনেটের দ্রুত সম্প্রসারণ এই ধারাকে যেন হুট করে কোথায় আটকে দিয়েছে। একটি ঘটনা বলি, আরটিভিতে ২০১২ সালে আমার লেখা প্রথম টেলিভিশন নাটক ‘অলসপুর‘ প্রচার শুরু হয়। নাটকটি টানা ১ হাজার ৭৪ পর্ব প্রচারিত হয়। এরপরও আরটিভি, বাংলাভিশন, চ্যানেল আই, এনটিভি, এটিএন বাংলাসহ বিভিন্ন টেলিভিশনে আমার লেখা ২ হাজার পর্বের বেশি নাটক প্রচারিত হয়েছে। প্রথম দিকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট (টিআরপি) দেখতো। কোনো কারণে টিআরপি ফল করলে টিভি চ্যনেল ডেকে মিটিং করতো। নানা নির্দেশনা দিতো; কিন্তু এক সময় টেলিভিশনের নাটকগুলো টেলিভিশনের পাশাপাশি ইউটিউবে প্রচার শুরু হলো। শুরুতে টেলিভিশনগুলো হয়তো বুঝতেই পারেনি অনলাইন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। এখন টেলিভিশন নাটকে আর টিআরপির প্রভাব নেই। এখন আলোচনা হয় ভিউ নিয়ে। নাটকটি টেলিভিশনে গেলেও ইউটিউবে কত ভিউ সেটি দিয়েই নাটকের জনপ্রিয়তা পরিমাপ করা হয়। প্রত্যেকটি টেলিভিশনের এখন ইউটিউবে আলাদা চ্যানেল রয়েছে। শুধু অনুষ্ঠান নয়। খবর প্রচারের জন্যও পৃথক ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।

রেডিও এবং টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের যে বিস্তৃত ইতিহাস সেখানে দেখা যায় ১৯৫০-এর দশকে জাতীয় গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন রেডিওর স্থান দখল করে। তবে টেলিভিশনে অর্থের বিনিময়ে প্রথম বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় নিউইয়র্কে ১৯৪১ সালের ১ জুলাই। এটি ছিল বুলোভা ওয়াচ কোম্পানির একটি ঘড়ির বিজ্ঞাপন। বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদন মতে, মাত্র ১০ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের এই বিজ্ঞাপনটি প্রচারে খরচ হয়েছিল ৪-৯ ডলার। একটি বেজবল খেলার শুরুতে এই বিজ্ঞাপন প্রচার হয়েছিল, যা দেখেছিল নিউইয়র্কের প্রায় ৪ হাজার মানুষ। ১৮৪০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও অন্যান্য শহরে একদল মানুষ ছিলেন যারা সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনের স্থান কেনাবেচা করতেন। ১৮৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বিজ্ঞাপনী সংস্থা গঠিত হয়। ১৮৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বিজ্ঞাপনী সংস্থা ক্রিয়েটিভ সার্ভিস প্রদান শুরু করে। তবে এই পেশার গোড়াপত্তনে এগিয়ে রয়েছে ব্রিটিশরা। যুক্তরাজ্যে প্রথম বিজ্ঞাপনী এজেন্ট ছিলেন সম্ভবত উইলিয়াম টেইলার নামে এক ব্যক্তি, যিনি লন্ডনের ওয়ারউইক চত্বরে ১৭৮৬ সালে একটি অফিস খুলেছিলেন।

গুগল, ফেসবুক এবং ইউটিউব বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করলে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের পন্য এবং সেবা প্রস্তুত কারকদের আগ্রহ কমতে শুরু করে। এখন বাংলাদেশে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের বাজার পড়ে গেছে কোনো কোনো টেলিভিশন প্রতি মিনিট বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য মাত্র দুই থেকে চার হাজার টাকা নিয়ে থাকে। এই সংকটে তাদের আয় কমে গেছে। আয় কমে যাওয়াতে অনুষ্ঠান নির্মাণের খরচ কমিয়েছে। তবে এর মধ্যে যারা ব্যবসাকে সম্প্রসারণের চিন্তা করেছে তারা নিজস্ব অ্যাপস তৈরি করেছে। যেখানে নিজেদের অনুষ্ঠান আপলোড করছে, যারা বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় টেলিভিশনগুলো দেখতেই চাইতো না তারা এখন বিকল্প হিসেবে এসব অ্যাপসে ঢুঁ মারছে। এই অ্যাপসের সব চাইতে বড় সুবিধা হচ্ছে যখন ইচ্ছা তখন দেখা যায়। নির্দিষ্ট সময় ধরে টিভির সামনে বসতে হয় না। যান্ত্রিক জীবনে যেহেতু মনুষ সব চাইতে সময়কে মূল্য দেয় তাই টেলিভিশনের প্রতি আগ্রহ কমছে; কিন্তু একই অনুষ্ঠান সে অ্যাপসে দেখছে। নব্বই দশকের কথা নিশ্চয় মনে আছে। কোথাও কেউ নেই নাটক দেখতে আমরা অপেক্ষা করতাম সপ্তাহজুড়ে। বাকের ভাই এর ফাঁসি হলো আর আবেগী বাঙালি রাস্তায় মিছিল করেছে। অয়োময়, বহুব্রিহি, শংসপ্তক, জোকাকি জ্বলে, লাট ভাই- এসব নাটক এখনো চোখে লেগে আছে।

খুলনা বেতারে প্রতি শুক্রবার সকাল ৮টায় আয়না প্রচার হতো। রেডিও টেলিভিশনে সরকার বা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদের আর কোনো অনুষ্ঠানের কথা আমার জানানেই। আয়নার সুরত আমার এক সময়ের সহকর্মী ছিল। সেই শের আলী মারা গেছেন বহু আগে। এখন আয়না প্রচার হয় কি, না সে কথা জানি না। তবে যারা শুনেছেন তারা এখনো আয়নাকে মনে রেখেছে; কিন্তু সেই রেডিও অনেকটাই হারিয়ে গেছে। ক্যাসেট প্লেয়ারতো আরও আগেই হারিয়ে গেছে। আসলে নতুন প্রযুক্তির উত্থান পুরোনোকে পেছনে ফেলে দেয়।

সম্প্রতি ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’ গানের গীতিকার জাহিদুল হক মৃত্যুবরণ করেছেন। কবির মৃত্যুর পর রংপুর বেতার থেকে তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি অনুষ্ঠান করেছে। এই গানটি কয়েকশবার শুনেছি। জাহিদুল হক সম্পর্কে জানতে গুগলে সার্চ করলাম। বেতারের অনুষ্ঠানটি এলো।

ঘটনাটি এ জন্যই বলছি রেডিওর অনুষ্ঠান এখন ইউটিউবে শুনতে হয়। টেলিভিশনের নাটক, খবর কিম্বা প্রচারিত অন্যান্য অনুষ্ঠানও ইউটিউবে দেখতে হবে। তাহলে কি টেলিভিশনের ভবিষ্যৎ ফিকে হয়ে আসছে!

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ