Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের টেস্ট বিজয়

এটা কি ‘স্বাধীন’ ক্রিকেট দলের সুফল!

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের টেস্ট হার দেশটির সাবেক ক্রিকেটারদের এতটাই ধাক্কা দিয়েছে যে, কারান্তরীণ ইমরান খানও এ নিয়ে আওয়াজ তুললেন। এক্স হ্যান্ডলে বিশ্বকাপজয়ী সাবেক অধিনায়ক যা লিখেছেন, তার মর্মার্থ ছিল এমন- ‘দেশের মানুষ টিভির সামনে গভীর মনোযোগ নিয়ে একমাত্র ক্রিকেট খেলাটাই দেখে। কিন্তু এ খেলাও শক্তিশালী মহলের দ্বারা ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীনরা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে নিজেদের পছন্দের অযোগ্য কর্মকর্তাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।’ ক্রিকেট প্রশাসনে রাজনীতির ছায়া যদি পাকিস্তানের ক্রিকেটকে পেছনে ঠেলে দিয়ে থাকে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নৈপুণ্যের নিয়ামকও কি রাজনীতি!

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের শীর্ষ পদে। নতুন বোর্ডপ্রধানকে এখনো ক্রিকেটের টেকনিক্যাল বিষয়াদি নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়নি; বিগত দিনে ধারাবাহিকভাবেই এ নিয়ে কথা বলে গেছেন নাজমুল হাসান পাপন। দল নির্বাচন, একাদশ ঠিক করা, ব্যাটিং অর্ডার, বোলিং ডিপার্টমেন্ট- এমন টেকনিক্যাল জায়গাগুলোয় অবাধ বিচরণ ছিল সাবেক বোর্ডপ্রধানের। এটা বুঝতে তো আর পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, এভাবে বোর্ড থেকে হস্তক্ষেপ করা হলে তা দলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ক্রিকেট প্রশাসকদের অযাচিত হস্তক্ষেপ দলের কোচিং স্টাফদের স্বাধীনতা লুণ্ঠনের শামিল। ক্রিকেট প্রশাসন থেকে নাজমুল হাসান পাপনের বিদায়ে স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছেন দলের কোচিং স্টাফরা। সে স্বাধীনতাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের দৃশ্যপট আমূল বদলে দিল কি না- এখনই বলা কঠিন। বিষয়টি যে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশকে বদলে দেয়ার নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে- এটা জোর দিয়েই বলা যায়। দলের পেস বোলিংয়ে বৈচিত্র্য এবং ঘরে-বাইরে ভালো প্রস্তুতিও হয়তো নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। বোদ্ধাদের মতে, সাকিব আল হাসান ইস্যুও দলের সদস্যদের ভালো করার তাড়না দিয়েছে।

সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক পবিত্র কুন্ডু কিন্তু সে কথাই বললেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশ দলকে ফলকেন্দ্রিক সাফল্যের দিকে ঠেলে দেয়া ভূমিকা রেখেছে সাকিব-ইস্যু। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে দেয়া হয়েছে উকিল নোটিশ। একজন খেলোয়াড়কে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল করার সব চেষ্টাই করা হয়েছে। অন্তহীন এই চাপ নিয়ে মাঠে নেমেও সাকিব পারফর্ম করছেন। এই মানসিক শক্তি সংক্রমিত হয়েছে তার সতীর্থদের মধ্যে। সবাই দাঁড়িয়েছে সাকিবের পাশে।’

রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের পতনে দেশটির সাবেকরা যে হায়... হায়... রব তুলছেন, সেটা কি আদৌ বাস্তবসম্মত? চলুন দেখে আসি পরিসংখ্যান কী বলে। ২০২০ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের আগে টেস্ট ক্রিকেটে পাকিস্তানের পথচলায় ছিল উত্থান-পতন। এ সময় খেলা ২৮ টেস্টের মধ্যে দেশটি জিতেছে ১০ ম্যাচ, হার সংখ্যা ১২; বাকি ৬ ম্যাচ ড্র হয়েছে। সে হিসেবে এ হারটা মোটেও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো বিষয় নয়। এ সময়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার লজ্জা ছিল। ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুই ম্যাচ সিরিজে ২-০ ব্যবধানে জয়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের কাছে হার মোটেও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো কিছু নয়; বরং নিকট অতীতে সাদা পোশাকের ক্রিকেটে পাকিস্তানের পথচলায় নিয়মিত দেখা গেছে এমন উত্থান-পতন।

পাকিস্তানের দুরবস্থার ফিরিস্তি দিয়ে অবশ্য বাংলাদেশের কৃতিত্বকে খাটো করার সুযোগ নেই। সদ্যসমাপ্ত সিরিজে টেস্ট ক্রিকেটের প্রত্যাশিত দৃঢ়তা ছিল সব ডিপার্টমেন্টেই। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুন্ডু বলছিলেন, ‘এ টেস্ট সিরিজের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি হয়েছে যথেষ্ট পরিকল্পিতভাবে। সিলেট-চট্টগ্রামে ক্যাম্প হয়েছে। চট্টগ্রামে হয়েছে প্রস্তুতি ম্যাচ। হাইপারফরম্যান্স ইউনিটকে অস্ট্রেলিয়া সফরে পাঠিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলানো হয়েছে। সেখানে দুর্দান্ত একটা ইনিংস খেলে সাদমান ইসলাম ফিরে পেয়েছেন আত্মবিশ্বাস। হাথুরুসিংহে আগের চেয়ে ড্রেসিংরুম সামলাচ্ছেন অনেক বেশি দরদ দিয়ে। সবার সঙ্গে কথা বলছেন, উদ্বুদ্ধ করছেন খেলোয়াড়দের। হয়তো বোর্ডে পরিবর্তনের হাওয়া তাকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করে থাকবে।’ অভিজ্ঞ এ ক্রীড়া সাংবাদিক আরও বলছিলেন, ‘পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৩ টেস্ট খেলে ১২-০, লজ্জার এই পরিসংখ্যান বদলে দিতে পুরো দলটাই ছিল একাট্টা। পাকিস্তানযাত্রার সময় অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত নিজেই সেটা বলে গেছেন। ওদিকে পাকিস্তানের প্রস্তুতি-ঘাটতি ছিল। ওয়ানডে বিশ্বকাপ এবং টি-২০ বিশ্বকাপে টানা ব্যর্থতায় তাদের আত্মবিশ্বাস নেমে গেছে তলানিতে। এর মধ্যে কোচ বদল, নির্বাচক বদল, বাবর আজমদের সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করা- পাকিস্তান দলকে মোটেই ভালো কিছু করতে অনুপ্রাণিত করেনি।’

দারুণ সব ব্যাটার ও বোলার সমৃদ্ধ পাকিস্তান দলকে নিকট অতীতে সংঘবদ্ধ ইউনিট হতে খুব একটা দেখা যায়নি। যার প্রতিফলন দেখা গেছে নিকট অতীতে ঘরে-বাইরে নানা সিরিজে। ২০২০ সালে ইংল্যান্ড সফরে তিন টেস্ট সিরিজে পাকিস্তান হেরেছে ১-০ ব্যবধানে। ২০২০-২১ মৌসুমে নিউজিল্যান্ড সফরে দুই ম্যাচে সিরিজে হার ২-০ ব্যবধানে। একই মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকার পাকিস্তান সফরে দুই ম্যাচের সিরিজ স্বাগতিকরা জিতেছিল ২-০ ব্যবধানে। ২০২১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও দুই ম্যাচ সিরিজে একই ব্যবধানে জিতেছে পাকিস্তান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে দুই ম্যাচ সিরিজে ১-১ সমতা ছিল। ২০২১-২২ মৌসুমে পাকিস্তান দলের বাংলাদেশ সফরে অতিথিরা দুই ম্যাচের সিরিজ জিতেছে ২-০ ব্যবধানে। একই মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া দলের পাকিস্তান সফরে অতিথি দল তিন ম্যাচের সিরিজ জিতেছে ১-০ ব্যবধানে। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে দুই ম্যাচ সিরিজে ১-১ ড্র করে আসে পাকিস্তান। ২০২২-২৩ মৌসুমে ইংল্যান্ডের কাছে ঘরের মাঠে তিন ম্যাচ সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে পাকিস্তান। পরে নিউজিল্যান্ড দলের পাকিস্তান সফরে দুই ম্যাচ সিরিজ শেষ হয়েছিল ০-০ সমতায়। ২০২৩ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে দুই ম্যাচ সিরিজে পাকিস্তান ২-০ ব্যবধানে জিতে আসে। ২০২৩-২৪ মৌসুমে পাকিস্তানের অস্ট্রেলিয়া সফর ছিল হতাশাপূর্ণ- তিন ম্যাচ সিরিজে অতিথি দল হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল।

প্রতিপক্ষের এ পরিসংখ্যানের ফিরিস্তি দেখে যদি ভাবেন বাংলাদেশ জেতেনি, পাকিস্তানই হেরেছে- সেটা বাস্তব সম্মত হবে না। সিরিজের দুই টেস্টের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুনশিয়ানা স্পষ্ট হয়েছিল। প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক আরিফুর রহমান বাবু কিন্তু সে কথাই বলছিলেন, ‘নো ডাউট, বাংলাদেশ অনেক ভালো ক্রিকেট খেলেছে। বোলিং, বিশেষ করে পেস বোলিং ডিপার্টমেন্ট অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে শানিত হয়েছে। টেস্টে কীভাবে উইকেট নিতে হয়, সেটা শিখেছে পেসাররা। তাসকিন, হাসান মাহমুদ ও নাহিদ রানা- তিন পেসারের বলেই গতি আছে। গড়পড়তা ১৪০ কিলোমিটারের বল করেন তারা। সঙ্গে আছে কারুকাজ। তারা সবাই শিখেছেন, জেনেছেন টেস্টে ব্যাটসম্যানদের ধৈর্য পরীক্ষা নিতে হলে বেশির ভাগ সময় নির্দিষ্ট লাইন ও লেংথে বল করতে হবে। কখন ভেতরে ঢোকানো, আর কোন সময় বাইরে সুইং করাতে হবে- সবই। পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই টেস্টে পেসাররা সে কাজটি করেছেন। দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে তিন পেসার মিলে ১০ উইকেট ভাগ করে নিয়েছেন।

দুই স্পিনার- সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজ দেখিয়েছেন লম্বা স্পেলে কীভাবে এবং কোন লাইন-লেংথে বল করলে সফল হওয়া যায়। মুশফিক, মুমিনুল, লিটন ও মিরাজরা দৃঢ়তা দেখিয়েছেন ব্যাট হাতে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, একটা দল হয়ে খেলতে পেরেছে বাংলাদেশ, যা বিগত দিনে খুব কমই দেখা গেছে।’ সিরিজের বোলিং ও ব্যাটিংয়ের পরিসংখ্যানে চোখ রাখলে বাংলাদেশের দাপট স্পষ্ট হচ্ছে। উইকেটশিকারিদের তালিকার শীর্ষ ছয়ে পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিনিধি খুররম শাহজাদ। সর্বোচ্চ ১০ উইকেট নেওয়া মেহেদী হাসান মিরাজের পরই আছেন ৯ উইকেট নেওয়া এ পেসার। পরের জায়গায়গুলোয় আছেন হাসান মাহমুদ (৮), নাহিদ রানা (৬), সাকিব আল হাসান (৫) ও তাসকিন আহমেদ (৪)। সিরিজে সর্বোচ্চ (২৯৪) রান পাকিস্তানের মোহাম্মদ রিজওয়ানের। পরের দুটি স্থানে মুশফিকুর রহিম (২১৬) ও লিটন দাস (১৯৪)।

নব্বই দশক থেকে ক্রীড়া সাংবাদিকতায় যুক্ত আরিফুর রহমান বাবুর মতে, সিরিজ জয় এবং ব্যাটিং-বোলিংয়ে বাংলাদেশের দাপট ত্বরান্বিত করেছে ক্রিকেটে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক দুরবস্থাও, ‘ব্যাটিং ও বোলিংয়ে এটা আমার দেখার পাকিস্তানের সবচেয়ে দুর্বল দল। বিষয়টি বাংলাদেশের ভালো ক্রিকেট খেলার সহায়ক ছিল।’

মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক ও বিশ্লেষক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ