ট্রাম্প যুগের শুরু কি নিউ ওয়ার্লড অর্ডার?
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বর্তমান যুগে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের সঙ্গে প্রতিটি দেশের সম্পর্ক রয়েছে। আর এই সম্পর্ক কোনো দেশের সঙ্গে কোনো দেশের ভালো, আবার কোনো দেশের সঙ্গে কোনো দেশের বৈরী। অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে প্রতিটি দেশেরই, বিশেষ করে বড় দেশগুলোর সঙ্গে স্বার্থ জড়িয়ে আছে। সেই অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রায় প্রতিটি দেশের বাণিজ্যিক, সামরিক এমনকি আদর্শিক সম্পর্ক বা বিরোধিতা রয়েছে। এই সম্পর্কে আবার জোয়ার-ভাটাও দেখা যায়। মাঝখানে একটু বলে রাখা ভালো, যারা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে বিশেষ পরিবর্তন আসে না, তারা সেকেলে চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত। এমন চিন্তা পুরোনো, শীতল যুদ্ধের সময়ের। তখন যুক্তরাষ্ট্রে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, তাদের সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক বলয়ের দেশগুলোর ব্যাপারে কোনো নীতির পরিবর্তন হতো না। কিন্তু বর্তমানে সেই বলয় ভেঙে গেছে। এমনকি চীনের মতো বিশাল সমাজতান্ত্রিক দেশও মুক্তবাজারের নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে।
আরও একটি নতুন বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে। কোনো দেশে দেখা যায় সরকার যুক্তরাষ্ট্রপন্থি কিন্তু জনগণ যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী, আবার কোথাও এর উল্টোটা। যেমন ইউরোপের কয়েকটি দেশের সরকার যুক্তরাষ্ট্রপন্থি এবং জনগণের বড় অংশ বিরোধী, আবার কয়েকটি দেশে তার উল্টো। এ ব্যাপারে হাঙ্গেরি বা সার্বিয়ার কথা বলা যেতে পারে। অন্যদিকে এই মুহূর্তে বিশ্বের অনেকগুলো দেশ যুদ্ধ ও সংঘাতে জড়িয়ে আছে ইউক্রেন-রাশিয়া, ইসরায়েল-হামাস এবং সুদানের গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেও প্রায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে এই তিনটি সংঘাতেই। সুতরাং সামনে খুবই স্পর্শকাতর একটি সময় অপেক্ষা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রে কে প্রেসিডেন্ট হলেন, তার পররাষ্ট্র নীতি কী, তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোন দেশের প্রতি সদয় এবং কোন দেশের প্রতি বৈরী- এই বিষয়গুলো বর্তমানে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়ে থাকে যা পূর্বে ছিল না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রাজনৈতিক মতপার্থক্য, রাজনৈতিক সংঘাত এতটা তীব্র হয়ে উঠেছে যে, দেশটির রাজনীতিবিদ ও দলীয় সমর্থকদের মধ্যে সব বিষয়ে দূরত্ব পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এক সরকারের নীতি যুক্তি ছাড়াই আরেক সরকার উল্টে দিচ্ছে। এ যেন তৃতীয় বিশ্বের দেশ!
এসব কারণে ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিতভাবে নির্বাচনে জয়লাভের পর গোটা পৃথিবী নড়েচড়ে বসেছে। হ্যাঁ, অপ্রত্যাশিতই বটে! ২০ জানুয়ারি তিনি দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। এটি তার দ্বিতীয় টার্ম। প্রথমবার তিনি রিপাবলিকান দলের হয়ে ২০১৬ সালে নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০২০ সালের নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হয়ে বিদায় নেন। এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। পরাজয়ের পর প্রথমেই তার বিরুদ্ধে আঙুল ওঠে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে আক্রমণের। বলা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা এ হামলা চালায় তারই উস্কানিতে। এ অভিযোগ মোকাবিলা করতে হয় তাকে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একজন পর্নো তারকাকে মুখ বন্ধ রাখতে ঘুষ দেয়ার মামলা হয় যা নিয়ে আলোড়ন ওঠে, তাকে কঠিন বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। তিনি আয়কর ফাঁকির মামলায়ও জড়িয়ে পড়েন। এসব নানাবিধ কারণে এবং তার খোলামেলা, অপ্রচলিত বক্তব্যের জন্যও তাকে বহু সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়।
এক সময় ট্রাম্পের নোমিনেশন পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে হয়েছিল। সবাইকে টপকে নোমিনেশন পাওয়ার পর তার নির্বাচনী প্রচারণায় গুলির ঘটনা ঘটে। আহত হলেও তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। এবং শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের ম্যান্ডেট নিয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট হিবেবে আবার আবির্ভূত হন, যা শুধু তার বিরোধী পক্ষকেই না, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনগণকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে। ট্রাম্প শুধু নির্বাচিতই হননি, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট এবং কংগ্রেসেও পেয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন। ফলে কী হবে ট্রাম্প সরকারের সমরনীতি, বাণিজ্যনীতি তাই নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। অনেকগুলো দেশ তো রীতিমতো ভাগ্য পরিবর্তনের আশা অথবা শঙ্কা নিয়ে অপেক্ষা করছে ২০ জানুয়ারি ট্রাম্পের শপথ ঘিরে।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়ার পর কী হতে পারে বিশ্ব রাজনীতি, কোন দিকে যাবে সেটা এই মুহূর্তে তার নতুন কেবিনেট দেখে খানিকটা অনুমান করা যায়। অন্তত তার কিছু কিছু ক্ষেত্রে পলিসি কী হবে তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ট্রাম্পের সেক্রেটারি অব স্টেট হতে চলেছেন মার্কো রুবিও। তিনি বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সব অর্থে বড় হুমকি হচ্ছে চীন। তিনি ন্যাটো জোটকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেও ট্রাম্পের মতোই মনে করেন ন্যাটো জোটের অন্য সদস্যদের ন্যাটোর ব্যয়ভার বাড়ানো উচিত। কেন যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে অন্যদের নিরাপত্তা দেবে! উল্লেখ্য, ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, ইউরোপের দেশগুলোর ন্যাটো জোটের ব্যয়ভার মেটাতে বাজেটের ৫ শতাংশ ব্যয় করা উচিত। তিনি ইউরোপ বাজেট না বাড়ালে ন্যাটো জোট থেকে পিছুটান দেয়ার একাধিক হুমকিও দিয়েছেন। এ ব্যাপারে মার্কো রুবিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে একমত। অন্যদিকে ইউরোপীয় নেতারা একটা শঙ্কার মধ্যেই আছেন। কারণ ইউরোপের বড় দেশগুলোর নেতারা মনেপ্রাণে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করেছিলেন। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো পরোক্ষভাবে। মার্কো রুবিও ট্রাম্পের আমেরিকান ফার্স্ট পলিসিতে বিশ্বাস করেন। আর এই আমেরিকা ফার্স্ট ইউরোপকে খানিকটা বেকায়দায় ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী সেক্রেটারি অব ডিফেন্স হিসেবে ট্রাম্প বেছে নিয়েছেন পিটার ব্রায়ান হেগসেথকে, যিনি পিট হেগসেথ নামে পরিচিত। তিনি বিশ্বাস করেন, ইসলাম চলে গেছে ইসলামিস্টদের হাতে, যারা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধ্বংস করতে চায়। চীনের ব্যাপারেও তার দৃষ্টিভঙ্গি সেক্রেটারি অব স্টেট মার্ক রুবিওর মতোই। হেগসেথ বিশ্বাস করেন, ২০২০ সালে নির্বাচনে ট্রাম্পের কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল।
ট্রেজারি সেক্রেটারি হিসেবে ট্রাম্প বেছে নিয়েছেন স্কট বেসেন্টকে। স্কট বিভিন্ন দেশের ওপর ট্যারিফ আরোপের পক্ষপাতি। বিশ্বাস করেন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে পৃথিবীর সব দেশের জন্য বাজার উন্মুক্ত করেছে, সেখানে চীনের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর একমাত্র প্রতিকার হলো উচ্চহারে ট্যারিফ নির্ধারণ করা। ট্রাম্প ন্যাশনাল সিকিউরিটি হিসেবে বেছে নিয়েছেন মাইকেল ওয়ালৎসকে। তিনি একজন চীন ও আফগানিস্তান এক্সপার্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন, আফগানিস্তানের মানুষকে শক্তি প্রয়োগ না করে ধীরে ধীরে কালচারালি পরিবর্তন সম্ভব। তবে তিনি প্রচণ্ড চীনবিরোধী। তিনি কংগ্রেসম্যান হিসেবে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে একটি নতুন শীতল যুদ্ধে আছি। এরকম আরও অনেকের নাম রয়েছে যারা সরাসরি চীনের প্রতি বৈরী। অর্থাৎ চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ যে ট্রাম্পযুগে আরও তীব্র হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর তা করতে গেলে দু-একটি যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট খুলে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ইউরোপের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাটোর অ্যাম্বাসাডর হিসেবে বেছে নিয়েছেন ম্যাথিউ জি. হোয়াইটেকারকে। হোয়াইটেকার বিশ্বাস করতেন যে ২০১৬ সালে এবং ২০১৮ সালে রাশিয়া ট্রাম্পকে জেতানোর জন্য মার্কিন নির্বাচনে নাক গলিয়েছিল। তিনি এখন রাশিয়া তথা ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি যথেষ্ট নমনীয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়োজিত ন্যাটোর অ্যাম্বাসাডর ইউরোপের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাওয়া নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুসারি। এটা পরিষ্কার যে, তিনি তার পূর্বসূরি ডেমোক্র্যাট দলের মনোনীত জুলিয়ান স্মিথ বা স্কট অডকির্কের মতো অতটা ইউক্রেন ভক্ত হবেন না।
এ বিষয়গুলো পরিষ্কার হলেও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভারত, পাকিস্তান নীতিগুলো এখনো বোঝা যাচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যাদের মনোনীত করেছেন তাদের মধ্যে ভারতের বর্তমান সরকার সমর্থকও যেমন আছেন তেমনি বর্তমান সরকারবিরোধীও আছেন। সুতরাং এ নিয়ে মন্তব্য না করাই ভালো। তবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তিনটি বিষয়, এক. চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ বড় হবে, অভিবাসন কড়াকড়ি হবে, ইউক্রেন যুদ্ধে ইউরোপকে আরও এগিয়ে আসতে চাপ দেয়া হবে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়ে। যতই তিনি বলুক যে ইউক্রেন যুদ্ধ থামিয়ে দেবেন, সেটা কতটা সফল হবেন বলা মুশকিল। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে হলে যে অঞ্চল রাশিয়া দখল করেছে তা পুতিনকে ছেড়ে দিতে হবে। আর তা করতে গেলে ইউরোপের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে পৌঁছবে। সেটা ট্রাম্প কতটা বিবেচনায় নেবেন তা নিকট ভবিষ্যৎ বলতে পারবে।
আমরা শুধু দেশটির প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাই দেখি কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চালানো এবং সার্বিকভাবে ভারসাম্য রাখা যে কত কঠিন তা আমাদের কল্পনায়ও আসবে না। দেখা যাক চিরাচরিত বৈশিষ্ট্যের বাইরে চরিত্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন।
মহসীন হাবিব: সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে