Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

সব আলো নিভিয়ে দিল ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যু

Mohshin  Habib

মহসীন হাবিব

রবিবার, ৪ আগস্ট ২০২৪

রানের স্থানীয় সময় বুধবার রাত ২টায় হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করা হয়। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। তাকে হত্যা করার কয়েক ঘণ্টা আগেই ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বৈরুতে হামলা চালিয়েছিল। সেই হামলায় হিজবুল্লাহ কমান্ডার ফুয়াদ শুকর মারা যান। গোলান হাইটসের মাজদাল শামস শহরে সম্প্রতি ১১ শিশু এবং ১ ব্যক্তি মারা গেছে হিজবুল্লাহর আক্রমণে। ইসরায়েলের বিশ্বাস, এর জন্য ফুয়াদ শুকরই দায়ী। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা হিজবুল্লাহ নেতাকে লক্ষ্য করে সুনির্দিষ্টভাবেই হামলা চালিয়েছিল। এ হামলায় একজন ইরানি সামরিক উপদেষ্টাসহ ৭ জনের প্রাণহানি হয়। ৭৮ জন আহত হন।

তবে ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করেনি ইসরায়েল; কিন্তু কে হানিয়াকে হত্যা করেছে, তা নিয়ে বিশ্বের কারও সন্দেহ নেই। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এর মধ্যেই জানিয়েছেন, ইসরায়েল ছাড়া এই কাজ আর কেউ করেনি এবং ইরান অবশ্যই এর প্রতিশোধ নেবে। কারণ, ইরানে অতিথি থাকার সময় হানিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বুধবার সন্ধ্যায় লেবাননে ধর্মঘট উদযাপন করেছেন। এবং গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিবাদী ভাষণ দিয়েছেন।

২০২৪ সালের ১ এপ্রিল সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেটে হামলা চালায় ইসরায়েল। সেই হামলায় নিহত হন ইরানের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ রেজা জাহেদি। সেই হামলায় কমপক্ষে আরও ১১ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি ইরাকের রাজধানী বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছিলেন কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানি। সোলায়মানিকে হত্যার পর থেকে রেজা জাহেদি ছিলেন নিহত হওয়া সর্বোচ্চ পদস্থ ইরানি সামরিক কর্মকর্তা। প্রতিশোধ নিতে ২০২৪ সালের ১৩ এপ্রিল ইরান ইসরায়েলে শত শত ড্রোন এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইরান ও ইসরায়েলের শত্রুতা প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে; কিন্তু এই প্রথম ইরান সরাসরি ইসরায়েলে আক্রমণ করল। এর আগে ইসরায়েল ও ইরান একে অপরের সম্পদের ওপর হামলা চালিয়ে ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। অনেক হামলার দায়ই তারা স্বীকার করেনি।

ইরান জানত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া কঠিন হবে; কিন্তু ইরানের জনগণের কাছে নিজের শক্তি প্রদর্শন করা ইরানের মর্যাদার জন্যও দরকার। আধাসামারিক বাহিনী হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতিদের সমর্থন করেছিল ইরান। তাই শত শত ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের আগে ইরান পশ্চিমাদের জানিয়ে দেয়, ইরান এবার ইসরায়েলে হামলা চালাতে যাবে, যাতে ইসরায়েল এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ যেমন সৌদি আরব, জর্ডান- ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং রকেট প্রতিরোধ করতে পারে। ইরানের মনে ভয় ছিল যদি এই আক্রমণের ফল মারাত্মক হয় তাহলে ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ছাড়া আর পথ থাকবে না। হামলার পর ইসরায়েল ইরানের কিছু অংশ ধ্বংস করে প্রতিশোধ নিয়েছে।

প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ইরান এবার বদ্ধপরিকর। তার মানে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেছেন, ইসরায়েল নিজের জন্য কঠোর শাস্তির ভিত্তি তৈরি করেছে। হানিয়ার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়া তেহরানের দায়িত্ব। আমরা জানি ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের একটি ছায়াযুদ্ধ আগে থেকেই চলছে। ইরান সমর্থিত তিনটি বাহিনীর সঙ্গে ইসরায়েল যুদ্ধে লিপ্ত- হামাস হুতি এবং হিজবুল্লাহ। এসব নিয়ে যুদ্ধবিরতির কথাবার্তা চলছিল; কিন্তু হানিয়াহকে হত্যার পর সেই প্রস্তাবকেও হত্যা করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

গাজায় যুদ্ধ থামানোর লক্ষ্যে আলোচনার মধ্যস্থতা করছে কাতার এবং মিশর। কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি এক্স-এ বলেছেন, ‘এক পক্ষ যখন অন্য পক্ষের আলোচককে হত্যা করে, তখন মধ্যস্থতা কীভাবে সফল হতে পারে?’ হামাসের হামলার পর থেকে, গাজায় ইসরায়েলের অভিযানে ৩৯ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি লোক মারা গেছেন। গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, ২০ লাখের বেশি মানুষ মানবিক সংকটে পড়েছে। লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বেশ কয়েকবার হামাসকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘হামাস সবাই মারা গেছে, মৃতরাই এখন হাঁটছে কেবল।’

যদিও ইসরায়েলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র গাজা যুদ্ধ শেষ করার পরিকল্পনা করেছে; কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, হামাসের সামরিক ও সরকারি সক্ষমতা সম্পূর্ণ নির্মূল করার আগ পর্যন্ত তিনি যুদ্ধ শেষ করবেন না। সব দিক বিবেচেনা করে মনে হচ্ছে, ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী হামাস নেতাকে হত্যার পর যুদ্ধের ডামাডোল এখন ভয়ংকরভাবে বেজে উঠেছে। এটা বাড়বে না কি কমবে, এখনই বলা যাচ্ছে না। আর এই যুদ্ধের ফলে এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের মানবিক সংকট তীব্রতর হয়েছে। অসংখ্য মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছেন।

যুদ্ধে জড়িত দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। রাজনৈতিক উত্তেজনা গভীর বিভাজনের দিকে নিয়ে যেতে পারে দেশগুলোকে। তাতে অভ্যন্তরীণ শান্তি যেমন ক্ষুণ্ন হয়েছে আন্তর্জাতিক শান্তিও বিনষ্ট হবে। দ্বন্দ্ব নিসরন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবিক সহায়তা ও সম্পর্কের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলো নানাভাবে চেষ্টা করছে, কিন্তু এ মুহূর্তে টানেলের শেষ প্রান্তে আমরা কোনো আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছি না।

মহসীন হাবিব: লেখক ও সাংবাদিক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ