নারী ফুটবলে গ্ল্যামারের অন্তরালে আঁধারও কি নেই?
কিছু কিছু সূচক আছে, যা অনুসরণ করলে মোটামুটিভাবে বুঝতে পারা যায় কতটা পরিবর্তন হয়েছে সমাজ-সংসারে। তার মধ্যে অন্যতম নারীর জীবন ও জীবিকা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমূল বদল এসেছে নারীর জীবনযাপনে। চারপাশে তাকালেই সহজেই অনুধাবন করা যায় পরিবর্তনের হাওয়া। অতীতের সঙ্গে এর মিল পাওয়া যাবে না। অবশ্য সব সূচক একই রকম ঈঙ্গিত বহন করে না। কিছু দিন আগে তো বটেই এমনকি পাকিস্তানের রক্ষণশীল আমলেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েদের পোশাক-আশাকে যে ফ্যাশন সচেতনতা ও স্মার্টনেস ফুটে উঠেছে, হাল আমলে তার বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। এতে মনে হওয়ার সংগত কারণ আছে যে, সময় বুঝি পেছনে ফিরে গেছে।
আসলে যুগের ঘূর্ণন বলতে একটা কথা আছে। যে কারণেই হোক, কোনো কোনো বিষয় আবার ফিরে ফিরে আসে। অবগুণ্ঠনকে বেছে নিলেও মানসিকভাবে নারীদের তেমন একটা বদল ঘটেছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না৷ সব ক্ষেত্রেই তারা সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তাঘাটে দুরন্ত গতিতে দিব্যি ছুটে চলেছেন। জাঁকিয়ে বসেছেন অফিস-আদালতে। এটাও তো ঠিক, স্মার্টনেস আর সৌন্দর্য শুধু পোশাক দিয়ে নিরূপণ করা যাবে না, তা অনেকটাই নির্ভর করে মনমানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষদের টেক্কা দিচ্ছেন। বাংলাদেশের নারীরা যে ফুটবল মাঠে দাপটের সঙ্গে বিচরণ করবেন, এমনটা কে ভেবেছিলেন? শর্টস আর শর্ট স্লিভ শার্ট পরে যেভাবে দেশ-বিদেশে ফুটবলশৈলী দিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন মুগ্ধতার আবেশ, তা কি কল্পনাকে হার মানিয়ে দিচ্ছে না?
যদিও অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে নারী ফুটবলারদের এগিয়ে আসতে হয়েছে। সত্তর দশকের শেষার্ধে ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুলের আগ্রহী কয়েকজন ছাত্রীকে নিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথিতযশা ক্রীড়াবিদ ও কোচ শেখ মোহাম্মদ সাহেব আলী ফুটবলে দীক্ষা দেয়া শুরু করেন; কিন্তু নানান কারণে সেই উদ্যোগ বেশি দূর গড়াতে পারেনি। মূলত এ শতাব্দীর গোড়াতে ঘটা করে নারী ফুটবলের যাত্রা শুরু হয়েছে। সমাজের চিরকালীন ধারা অনুসারে রক্ষণশীলদের পক্ষ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। নারীদের ফুটবল খেলার বিপক্ষে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। স্বাভাবিক কারণেই সে সময় নারীদের ফুটবল খেলতে নামাও অনেক কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়; কিন্ত ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’ এমন দৃঢ়চেতা মনোভাব নিয়ে নারীরা আত্মবিশ্বাস আর সাহসিকতাকে সঙ্গে ফুটবল মাঠে গেয়েছেন জীবনের জয়গান। সমস্ত প্রতিকূলতাকে তুড়ি মেরে দিয়ে উড়িয়ে চলেছেন সাফল্যের নিশান। এখনো যে বাধাবিঘ্ন নেই, তা বোধকরি জোর গলায় বলা যাবে না। নারী ফুটবলারদের মানসিক তো বটেই এমনকি শারীরিকভাবেও আঘাত ও নিগ্রহ সইতে হয়। ইতিউতি বাধা দেয়া কিংবা নানাভাবে নিরুৎসাহিত করার ছোটখাটো প্রচেষ্টা নিয়তই চলছে। তবে এই বাধাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো অপরিসীম আত্মবিশ্বাস, অদম্য মনোবল ও দৃঢ়প্রত্যয় অন্তত নারীরা সঞ্চয় করতে পেরেছেন। বিরোধিতাকারীরা ঘাপটি মেরে থাকলেও এখন আর খুব বেশি উচ্চবাচ্য করার সাহস পায় না।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে চলেছেন নারীরা। একটা সময় নারী ক্রীড়াবিদদের সাফল্য তেমনভাবে অনুভূত হতো না। কালেভদ্রে দেখা মিলতো সাফল্য। অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের সাফল্য বলার মতো নয়। সীমিত পরিসরে যেটুকু সাফল্য, তাতে একচেটিয়া প্রাধান্য পুরুষদের। সাম্প্রতিককালে সেই ধারা থেকে বের হয়ে আসছেন নারীরা। বিভিন্ন খেলায় নারীদের সাবলীল বিচরণ এবং সাফল্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে দেশের ক্রীড়াঙ্গন। বিশেষ করে ফুটবলে একের পর এক সাফল্য দিয়ে মাতিয়ে দিচ্ছেন। যদিও এর সীমানা মূলত দক্ষিণ এশিয়া, তদুপরি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ সাফল্য নিঃসন্দেহে গৌরব করার মতো। নারী ফুটবলাররাই এখন দারুণভাবে আলোচিত। বয়সভিত্তিক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে চমকপ্রদ ও নান্দনিক ক্রীড়াশৈলী দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করার পাশাপাশি একের পর এক সাফল্য অর্জন করছেন। সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করে যেভাবে শিরোপা জয় করেছে, তা দারুণভাবে রাঙিয়ে দেয় মন। স্বাগতিক নেপালের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচের আগে দলের ফুটবলার সানজিদা আখতার নিজের ফেসবুক পেজে আবেগাপ্লুত হয়ে লেখেন, 'যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই।
আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরো নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছু হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই। তার হৃদয়নিঃসৃত এই পোস্টটি দেশবাসীকে দারুণভাবে নাড়িয়ে দেয়। এ যেন নারী ফুটবলারদের এগিয়ে যাওয়ার একটি এপিটাফ। তা হয়ে উঠেছে প্রতিটি নারী ফুটবলারের হৃদয়ের অন্তর্গত নির্যাস। সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে কাঠমান্ডু থেকে দেশে ফিরলে দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের বরণ করে নেয়া হয় ছাদখোলা দোতলা বাসে। এই সংবর্ধনায় বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবন পর্যন্ত দীর্ঘ বাসযাত্রা যোগ করে নতুন এক মাত্রা।
নারী ফুটবলের জাগরণে মাঠের বাইরের ভূমিকা তো নিশ্চয়ই আছে; কিন্তু খেলার মাঠে যে মেয়েরা সমস্ত রক্তচক্ষু ও প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে খেলেছেন বা খেলছেন, তাদের ইচ্ছাশক্তি, লড়াকু মানসিকতা ও সাহসের তারিফ সবার আগে করতে হয়। সবচেয়ে বিস্ময়কর, এই মেয়েদের বেশিরভাগ গ্রামীণ সমাজের যে স্তর থেকে উঠে এসেছেন, সেখানে প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা ও নারীকে চার দেয়ালের মাঝে আটকে রাখার চল রয়েছে। বিয়ে দেয়া হয় অল্প বয়সেই। আর্থিকভাবেও এই ফুটবলারদের পরিবারকে বিত্তহীন বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রকৃত অর্থেই তাদের প্রায় সবারই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। একদিকে ক্ষুধা, অন্যদিকে সামাজিক বিধিনিষেধ-এমন অবস্থায় কোনো মেয়ের পক্ষে শারীরিক শক্তি, সক্ষমতা ও কৌশলের খেলায় আত্মনিয়োগ করা চাট্টিখানি কথা নয়। বুকে কতটা হিম্মত, কতটা স্পর্ধা, কতটা উদ্যম থাকলে এমনটা সম্ভব, তা সমাজবিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করতে পারবেন। একে তো নারীদের ফুটবল খেলা সমাজে তেমনভাবে সমাদৃত নয়, তদুপরি এ খেলায় টিকে থাকতে হলে শারীরিক ফিটনেস, পুষ্টিকর খাবার ও নিয়মিত প্রশিক্ষণ অবশ্যম্ভাবী। অথচ যাদের সংসার চলে দিন আনি দিন খাই নিয়মে, সেই তারাই কি না আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচে দাপটের সঙ্গে খেলে সাফল্যের হাসি হাসছেন। কীভাবে তা সম্ভব? এটা কি মিরাকল নয়?
প্রতিকূল পরিবেশ এবং নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে উঠে এসে নারী ফুটবলাররা দীপ্তি ছড়িয়ে নিজেদের ভাগ্যের খানিকটা পরিবর্তন আনতে পেরেছেন, জাতীয়ভাবেও সমাদৃতা ও স্বীকৃতি পাচ্ছেন, সেই কারণে অনেক মেয়েই এখন ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। ফুটবল খেলে যদি পেট ভরে খাওয়া ও শান্তিতে থাকা যায়, দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের কাছে সেটার আকর্ষণ নেহাত কম নয়। স্বাচ্ছন্দ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করতে পারলে নারী ফুটবলারের প্রবাহ অবিরাম বইতে থাকবে; কিন্তু নারী ফুটবল যতটা ঝলমল করে, তার সবটাই কি আসলে ঝকমকে? এর অন্তরালে আঁধারও কি নেই? নারী ফুটবলারদের সবাই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে নেই। হয়তো ফুটবল খেলায় গ্ল্যামার আছে, দেশ-বিদেশে ঘোরার আকর্ষণ আছে এবং ভক্ত-অনুরাগীদের ভালোবাসা আছে; কিন্তু পুরোপুরিভাবে আর্থিক নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। তা না পেলে সংসার চলবে কীভাবে? একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, জীবন একটি কেন্দ্রে থেমে থাকে না। সে নিয়ত পরিবর্তনশীল। পেটের ক্ষুধা মিটলে, মাথা গোঁজার ঠাঁই মিললে, আনুপাতিক হারে তার চাহিদাও বাড়তে থাকে। সে ক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজনীয়তা বাড়বেই। এটাই তো জীবনের নিয়ম। যে কারণে নারী ফুটবলারদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে জাতীয় দলের অনুশীলন বর্জনের ঘটনাও ঘটেছে। ঘরোয়া লিগটা তেমন জমজমাট হতে পারছে না। তাতে খেলে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যায় না। এবার মাল্টি-বিলিয়নার বিজনেস হাউজ হিসেবে পরিচিত বসুন্ধরা কিংস সরে দাঁড়ানোর কারণে ফুটবলারদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়। শেষমেষ নাসরিন স্পোর্টস একাডেমি দল গঠনে এগিয়ে আসায় খানিকটা স্বস্তি ফিরে আসে; কিন্তু এ রকম অনিশ্চয়তার মধ্যে খেলায় মনোনিবেশ করা কি সহজ? সামগ্রিকভাবে ভবিষ্যৎ নিয়েও নারী ফুটবলারদের রয়েছে অনিশ্চয়তা। এ কারণে ইতোমধ্যে কেউ কেউ ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়েছেন। এটা মোটেও আশার কথা নয়।
নারী ফুটবলাররা খেলার মাঠে শুধু দেশের সুনাম বয়ে আনছেন না, সামাজিক প্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। সমাজের অনভ্যস্ত, অসহিষ্ণু ও রক্ষণশীল মনোভাবকে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত, সহিষ্ণু ও প্রগতিশীল করে তোলার ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা রাখছেন। এর গুরুত্বকে মোটেও হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে নারী ফুটবলারদের পথচলাকে সুগম, সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আর্থিক ও মানসিকভাবে তারা যাতে নির্ভার থাকতে পারেন, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হলে বাংলাদেশের নারী ফুটবলের এগিয়ে যাওয়াকে রুখে দেয়া সম্ভব হবে না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে