ইসরায়েলের যুদ্ধ বিস্তৃতির কারণে আরও যুদ্ধ অপেক্ষা করছে
গাজায় গণহত্যার রক্তে নেতানিয়াহুর পিপাসা মেটেনি, তাই তো লেবাননের রক্ত দিয়ে পিপাসা মেটাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আর তাইতো লেবাননে হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে যেতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি লেবাননে পূর্ণ শক্তি দিয়ে হামলা চালিয়ে যেতে ইসরায়েলি বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। লেবাননে ইসরায়েলের হামলাকে ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্র লেবাননে ২১ দিনের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। পাশাপাশি ফিলিস্তিনি ছিটমহল গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রতিও সমর্থন জানিয়েছে তারা।
লেবাননে ইসরায়েলি বাহিনী ব্যাপক হামলা শুরু করার পর এ পর্যন্ত ৫৫০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। লেবাননের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায়ও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার এক যৌথ বিবৃতিতে জানায়, লেবানন ও ইসরায়েল সীমান্তে বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে তাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিতে একটি কূটনৈতিক মীমাংসার সময় এসেছে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন-নোয়েল ব্যারোট লেবাননে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে বলেন, প্যারিস ও ওয়াশিংটন আলোচনা এবং আরও টেকসই যুদ্ধবিরতির অনুমতি দিতে তিন সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস লেবাননে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। ইসরায়েল লেবাননের কূটনীতিক ইস্যুকে স্বাগত জানালেও যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়নি। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেতানিয়াহুকে থামাতে হবে।
লেবাননে ভয়াবহ হামলার মধ্য দিয়ে তিনি আরেকটি অপরাধ করেছেন। ব্রিটেন, জাতিসংঘ এবং অন্যদের মধ্যে যারা বেসামরিক জীবন ও মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি যত্নশীল বলে মনে করা হয়, তারা কি সত্যিই মুখ ফিরিয়ে রাখবে যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আবার এই অপরাধ করেন? এমন ঘটনা বিশ্বাস করা যায় না। এ প্রেক্ষাপটে বলা যায়, নেতানিয়াহু হয়তো দক্ষিণ লেবানন, এমনকি পুরো লেবাননকে দ্বিতীয় গাজায় পরিণত করতে চলেছেন। গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের নৃশংসতার পর ৪১ সহস্রাধিক ফিলিস্তিনি মারা গেছেন, যার বেশির ভাগই সাধারণ নাগরিক। লেবাননে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে প্রায় ৫৫০-এর বেশি মানুষ নিহতের মধ্যে অনেকেই শিশু। হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন।
এ লোকটি দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার আগে আর কত নিরপরাধ ব্যক্তি হত্যা করবেন? নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘নিরাপত্তা ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের জন্য’ সর্বশেষ হত্যাযজ্ঞটির প্রয়োজন ছিল। বাস্তবতা হলো, নেতানিয়াহু নিজেই ভারসাম্যহীন। দক্ষিণ লেবানন থেকে একটি সার্বভৌম দেশের জনগণকে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেখানে ইসরায়েলের নজিরবিহীন বিমান হামলা আরও তীব্র হবে। লেবাননের ভূখণ্ডে একটি সামরিক অভিযানও হতে পারে। তার এ কৌশল ২০০৬ সালে কাজ করেনি এবং এখনো করবে না। নেতানিয়াহুর কৌশল বরাবরের মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যর্থ। সম্প্রতি ১ হাজার ৩০০টি ইসরায়েলি হামলার বিপরীতে হিজবুল্লাহ সেখানে আগের চেয়ে বেশি রকেট নিক্ষেপ করছে। তা ছাড়া তারা হামলা সম্প্রসারণ করেছে। বাস্তুচ্যুত ইসরায়েলি বাসিন্দারা যেন নিরাপদে ফিরে আসতে না পারে; আপাতত সেটাই তাদের লক্ষ্য। সহিংসতা থেকে সহিংসতার সৃষ্টি হয়। এটি নিরাপত্তা নিয়ে আসে না বরং শুধু ঘৃণা ও প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। যথারীতি নেতানিয়াহু মিশ্র বার্তা দিচ্ছেন। কোনটি বিশ্বাস করবেন?
নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, সামগ্রিকভাবে অভিযানটির একটি সীমিত উদ্দেশ্য রয়েছে-হিজবুল্লাহকে সংযত করা এবং তাদের লিটানি নদীর উত্তর সীমান্ত থেকে দূরে তাড়িয়ে দেয়া। তিনি লেবাননের বেসামরিক নাগরিকদের যত্ন নেয়ার দাবি করেন, যেমনভাবে ৭ অক্টোবর থেকে হামাসের কাছে ইসরায়েলি জিম্মিদের যত্ন নেয়ার দাবি করেছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই শোচনীয়ভাবে মারা গেছেন; কিন্তু সত্যিকার অর্থে হামাসকে ধ্বংস করতে তার ভ্রান্ত লক্ষ্যে ব্যর্থ হয়ে নেতানিয়াহু পরিকল্পিতভাবে হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘর্ষ বাড়িয়ে দ্বিতীয় সংঘাত বাধিয়েছেন, যা প্রতিরোধ করতে মার্কিন কূটনীতিকরা কয়েক মাস সময় ব্যয় করেছেন। গত সপ্তাহের ওয়াকিটকি ও পেজার হামলা এবং মূল কমান্ডারদের হত্যার মধ্য দিয়ে তা কেবল শুরু হলো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, শুধু নিরবচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়ে তিনি দাপ্তরিক দায়িত্ব ও ক্ষমতায় থাকতে চান।
হিজবুল্লাহ সবসময় স্পষ্ট কথা বলেছে। তারা বলেছে, গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হলে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ বন্ধ করবে, তার আগে নয়। জানা গেছে, নেতানিয়াহু বহুবার এ ধরনের চুক্তি বাধাগ্রস্ত করেছেন। এটি সত্ত্বেও যুক্তরাজ্যে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত বিবিসির টুডে প্রোগ্রামে জোর দিয়ে বলেছেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য হিজবুল্লাহ উত্তরাঞ্চলের জন্য হুমকিস্বরূপ। কাদের সন্ত্রাস? জিপি হটোভেলি? তাদের, না আপনার? ইসরায়েলি সরকারের অস্বীকার এবং ভুল নির্দেশনা অব্যাহত রয়েছে, যা ওপর থেকে নিচের দিকে ধাবিত হয়। নেতানিয়াহুকে থামাতে হবে; কিন্তু কে এ কাজ করবে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নন, যিনি এ সপ্তাহে জাতিসংঘে আবারও বলবেন, তার একটি পরিকল্পনা রয়েছে। বাস্তবে এই সংকট তিনি হতাশাজনকভাবে ভুল পথে পরিচালনা করেছেন। আর এ জন্য তিনি উদ্বিগ্ন যে, মধ্যপ্রাচ্যব্যাপী দাবানল নভেম্বরের নির্বাচনে কমলা হ্যারিস ও ডেমোক্র্যাটদের সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাহলে কেন তিনি পদক্ষেপ নিচ্ছেন না?
কারণ তিনি চিন্তিত, যদি ইসরায়েলের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া হয়ে যায়। আদালতের অবস্থা কোন পর্যায়ে? আন্তর্জাতিক আইন কী নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন আরও আগ্রাসন বন্ধ করবে? দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে না আপনাকে এর জবাব পেতে। কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের বিচারকরা এখনো গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেননি, যা মে মাসে প্রধান প্রসিকিউটর অনুরোধ করেছিলেন। এই দীর্ঘ ও ব্যাখ্যাহীন বিলম্ব সন্দেহ বাড়িয়ে তোলে। তাহলে স্বয়ং জাতিসংঘের অবস্থান কী? ইসরায়েলের দখলকৃত অঞ্চলগুলো খালি করার দাবি তারা তুলেছে, যেখানে ইসরায়েল ভয়াবহ নিপীড়ন চালাচ্ছে। সেইসঙ্গে তারা অসংখ্য উপেক্ষিত ফিলিস্তিনি প্রস্তাব চূড়ান্তভাবে কার্যকর করার কথাও তুলতে পারে। তবে এগুলোর চেয়ে তাদের ছিন্নভিন্ন কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের কাজে মনোযোগ দেয়াই ভালো হবে।
অবিশ্বাস্য হলেও নেতানিয়াহুর এ সপ্তাহের শেষে সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেয়ার কথা। জাতিসংঘের উচিত নেতানিয়াহুকে এ সুযোগ দেয়ার পরিবর্তে তাকে নিষিদ্ধ করা। যদি তিনি সেখানে আসেন তাহলে তার কূটনৈতিক সুবিধা উপেক্ষা করুন। নিউইয়র্ক শহরের পুলিশ ও এফবিআইর উচিত তাকে গ্রেপ্তার করা এবং বিশেষত অভিযুক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া। নেতানিয়াহু বিপজ্জনক। সব ধরনের বিদ্যমান অহিংস উপায়ে তাকে অবশ্যই থামাতে হবে। যদি গাজায় চলমান যুদ্ধটি বাকি সব যুদ্ধগুলোর মতো হতো তাহলে এতদিনে হয়তো সেখানে অনেক কিছুর ক্ষেত্রে আলাদা চিত্র দেখা যেতো। সম্প্রতি সেখানে যুদ্ধবিরতি হয়েছে। কিন্তু তখন হয়তো বহুদিন আগেই এই যুদ্ধবিরতি হতো। মৃতদের কবর দেয়া হয়ে যেত এবং ইসরায়েলকে হয়তো জাতিসংঘের সাথে তর্ক করতে হতো যে গাজার পুনর্নির্মাণে ঠিক কী পরিমাণ সিমেন্টের দরকার হবে; কিন্তু এই যুদ্ধটা সেগুলোর মতো নয়। কারণ এখানে যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলছে শুধু সেটাই একমাত্র কারণ নয়।
এখানে হত্যাযজ্ঞের শুরুটা করেছিল হামাস গত ৭ অক্টোবর, বেশিরভাগ ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর। তারপর ইসরায়েল পাল্টা আক্রমণ শুরু করে যাকে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অভিহিত করেছেন ‘ভয়ংকর প্রতিশোধ’ হিসেবে, সেখানেও বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক হত্যার শিকার হয়েছেন। এই যুদ্ধটা অন্যগুলো থেকে ভিন্ন কারণ এটা এমন সময় হচ্ছে যখন মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগ করা ফল্ট লাইনে চিড় ধরেছে। গত দুই দশক ধরে এখানকার ভূরাজনীতির যে উত্তেজনাকর চিত্র, তার একদিকে ইরান এবং তার বন্ধু ও মিত্ররা, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু ও মিত্ররা। ইরানের এই নেটওয়ার্কের মূলে, যেটা কখনো পরিচিত ‘প্রতিরোধের জোট’ হিসেবে, সেই দলে রয়েছে লেবাননের হেজবুল্লাহ, সিরিয়ার আসাদ সরকার, ইয়েমেনের হুতি এবং ইরাকের সশস্ত্র বাহিনী যাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ইরান। ইরানিরা গাজায় হামাস এবং ইসলামিক জিহাদকেও সমর্থন দিয়ে আসছে।
একই সঙ্গে ইরান এখন চীন এবং রাশিয়ারও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। ইউক্রেনে রাশিয়া যে যুদ্ধ পরিচালনা করছে ইরান সেটার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর চীন ইরানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ তেল কিনে থাকে। গাজায় যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে এবং ইসরায়েল যত বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোক হত্যা করবে ও হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস করবে ততই এই দুই মিত্র গোষ্ঠীর কোন কোন সদস্যের মধ্যে সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি হবে; কিন্তু বর্তমানে যে বেদনা, ঘৃণা আর শঙ্কার পরিবেশ চলমান সেখানে এই ধারণার প্রয়োগ করা হবে খুবই কঠিন কাজ। আর বর্তমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি যে নেতৃত্ব তাদের অধীনে এটা অসম্ভব। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীরে নিরাপত্তার জন্য ইসরায়েলকে সহায়তা করে আসছে কিন্তু তাদের নিজেদের লোকদেরই বসতি স্থাপনকারী অস্ত্রধারী ইহুদিদের থেকে রক্ষায় ব্যর্থ। একসময় নেতৃত্বের বদল ঘটবে। কিন্তু যদি গাজার এই মর্মান্তিক যুদ্ধ ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও তাদের শক্তিশালী বন্ধুদের শান্তি স্থাপনে বাধ্য না করে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও যুদ্ধই অপেক্ষা করছে।
রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে