যুবদল নেতা তৌহিদকে ‘হত্যার’ কারণ জানতে চান কুমিল্লার ইটাল্লাবাসী
কোনো মামলা নেই, নেই কোনো অভিযোগও। তারপরও কেন যৌথবাহিনীর হেফাজতে মারা যেতে হলো যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামকে- এ প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন নিহতের স্বজনসহ কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ইটাল্লা গ্রামবাসী।
বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) রাতে কুমিল্লার যৌথবাহিনী তুলে নেয়ার পর শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) দুপুরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানীয় যুবদল নেতা তৌহিদের মরদেহ পায় পরিবার। শরীরের নানা স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখে তাকে রাতভর এবং পরদিন সকালেও নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যার অভিযোগ তুলেছেন স্বজনেরা। পাঁচথুবি ইউনিয়নের ইটাল্লা গ্রামের সদ্যপ্রয়াত মোখলেছুর রহমানের ছেলে তৌহিদকে ভালো মানুষ উল্লেখ করে তার মৃত্যুর কারণ জানতে চান গ্রামবাসীও।
কোতোয়ালি থানার তদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, তৌহিদের (৪২) শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তার পেটে, তলপেটে, উরুর পেছনে, দুই হাত এবং বাম পায়ের বুড়ো আঙুলে ভোঁতা আঘাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ গাঢ় ও ফোলা চিহ্ন রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তৌহিদকে হারিয়ে ইটাল্লা গ্রামে এখন থমথমে পরিস্থিতি। অজানা ভয়-আতঙ্কের পাশাপাশি এই মৃত্যুকে হত্যা অভিযোগ করে ক্ষুব্ধ পুরো গ্রামবাসীও।
তবে, প্রতিবেশী সাইফুলের সঙ্গে জমি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরেই এ হত্যার ঘটনা বলেও দাবি করছেন গ্রামবাসী ও তৌহিদের পরিবার। সবারই দাবি, যৌথবাহিনীকে ব্যবহার করেছে পরিবারটির প্রতিপক্ষ।
বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ টিপু বলেন, ‘৩০ জানুয়ারি রাতে যৌথবাহিনীর সদস্যরা এসে প্রথমেই তৗহিদের কাছে অস্ত্র আছে বলে দাবি করেন। এরপর কয়েকজনকে এলোপাতাড়ি মারপিটে আতঙ্ক ছড়ান। যাকে সামনে পান, তাকেই পেটান। তৌদিকে তুলে নেয়ার সময়ও তাকে মারধর করতে থাকেন তারা। পরে চাচাতো ভাই লুৎফুরসহ তাকে ধরে নিয়ে যান গোমতী নদীপারের পরিত্যক্ত স্থাপনা ‘গোমতী বিলাসে’। ঘরে থাকা সাতটি মোবাইল ফোনও নিয়ে যান তারা’।
টিপু বলেন, ‘রাতেই আমরা যৌথবাহিনীর একাধিক ক্যাম্পে খবর নেই। কোথাও তাকে নেয়া হয়নি বলে জানানো হয় সেগুলো থেকে। ভোরে আমাকে ফোন করে একটি মোবাইল থেকে। ফোন ধরলে তৌহিদ বলে- ‘আমাকে বাঁচান, তারা মেরে ফেলবে।’ আমি বলি- ‘কতো টাকা চায়, ৫০ লাখ হলেও দেবো। তোকে ছেড়ে দিতে বল। সে বলে, ‘টাকা না, তারা আমার কাছে অস্ত্র চায়। অস্ত্র আমি কোথা থেকে দেবো? আমার কাছে নাকি অস্ত্র আছে।’
‘এ সময় একজন তার কাছ থেকে ফোন নিয়ে বলেন, ‘তৌহিদের কাছে অস্ত্র আছে। সে অস্ত্র না দিলে পরিনাম ভয়াবহ হবে। বলে কল কেটে দেয়’।
টিপু বলেন, ‘পরদিন সকালের দিকে তৌহিদকে যৌথবাহিনীর সদস্যরা আবার বাড়িতে নিয়ে আসেন। তখন তার সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। খুব ক্লান্ত ছিল। এখানে আসার পর সবার সামনে তারা আবারো পেটান তৌহিদকে। এসময় তারা গোটা গ্রামে ত্রাসের সৃষ্টি করেন। যাকে দেখেন, তাকেই পেটান। সবার মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন অনেকেই পালান’।
তিনি বলেন, ‘যৌথবহিনীর সঙ্গে আমাদের প্রতিবেশী সাইফুল ছিল। মুখ কাপড়ে মোড়ানো থাকলেও তাকে স্পষ্ট চেনা যায়। তাদের সাথে আমাদের জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাদের সঙ্গে আরও চারজন লোক সাদা পোশাকে মুখ বাধা ছিল। এলাকাবাসী তাদের পরিচয় জানতে চাইলেও যৌথবাহিনীর সদস্যরা কোনো জবাব দেয়নি। এরপর তারা তৌহিদকে নিয়ে আবারও চলে যান’।
তিনি বলেন, ‘সকালে তৌহিদকে নিয়ে চলে যাবার প্রায় দুই ঘন্টা পর আর একটি ফোন থেকে আমাকে কল করে বলে, ভুল ইনফরমেশেনে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা দুঃখিত’।
আরেক ভাই সাদেকুর রহমান বলেন, ‘দুপুর পৌনে ১২টার দিকে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোরশেদ আলম আমাদের অন্য ব্যক্তির মাধ্যমে কল করে জানান, তৌহিদের অবস্থা খুব খারাপ। আমরা যেন দ্রুত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসি। হাসপাতালে আসার পর দেখি, তৌহিদ আর নেই। তাকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। তার কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত এমনভাবে পিটিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে যে, কালো ফোলা জখমের চিহ্ন রয়েছে। আমার ভাইয়ের পেট, বুক, পিঠ, পা, গলাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে শুধুই নির্যাতনের চিহ্ন’।
হাহাকার করে নিহত তৌহিদের ভাইয়েরা বলেন, ‘ভুল ইনফরমেশেনটা তাকে হত্যার পর কেন জানলো? আগে জানলো না কেন ? অবশ্যই এটা পরিকল্পিত হত্যা’।
টিপু ও সাদেক বলেন, ‘আমাদের প্রশ্ন, তাকে যৌথবাহিনীর ক্যাম্পে না নিয়ে কেন গোমতী বিলাসে নেয়া হল? তার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ আছে, তা আমরা কেউ জানি না কেন? এ হত্যার দায় কার?’
তৌহিদের সাথে ধরে নেয়া লুৎফুর রহমান লুতু বলেন, ‘তৌহিদকে ধরেই পেটাতে থাকেন যৌথবাহিনীর সদস্যরা। তারা আমাকেও ধরে নিয়ে যান গোমতী নদীর তীরের গোমতী বিলাসে। বেদম পেটান আমাদের দুজনকেই। আমার কাছেও অস্ত্র চান। আমি বলি, ‘আমি একজন কৃষক, অস্ত্র কোথায় পাবো? কৃষিকাজ করি, গরু-ছাগল লালন-পালনে জীবিকা নির্বাহ করি। তৌহিদের কাছে অস্ত্র আছে কি-না, জানতে চান তারা। আমি বলি, তার মতো ভালো ছেলে দুই/চার গ্রামে নেই। সে অত্যন্ত স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। তাও মানছিলেন না তারা। পিটিয়ে এবং ইলেট্রিক শক দিয়ে অস্ত্রের অবস্থান জানতে চান’।
লুৎফুর বলেন, ‘পিটুনি এবং নির্যাতনের যন্ত্রণায় তৌহিদ আমাকে বলে, ‘ভাই, আমি বাঁচবো না। আমাকে আমার মা বাবার কবরের পাশে কবর দিতে বলবেন’। তখন আমার চোখ পানিতে ভিজে যায়। কিচ্ছু করার ছিল না আমার’।
‘পরে ভোরে তারা আমাকে ছেড়ে দিয়ে তৌহিদকে আটকে রাখেন তারা’- জানান নিহতের চাচাতো ভাই লুৎফুর
গ্রামের মানুষেরও একটাই প্রশ্ন, ‘কোন ‘অপরাধে’ তৌহিদকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তা জানানো হোক’।
গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক মো. শাহজাহান ও মো. মনির হোসেন বলেন, ‘এলাকাবাসী তৌহিদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ বা কী অপরাধ তা জানতে চান। সেদিন গোটা গ্রামে তাণ্ডব চালিয়েছেন যৌথবাহিনীর সদস্যরা। এটা কোনো সভ্য দেশে সম্ভব নয়, যা এখানে হয়েছে’।
‘এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন চাই আমরা। এই হত্যার বিচার চাই’- বলেন তারা।
তৌহিদুল ইসলাম ছিলেন পাঁচথুবি ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে শিপিং এজেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তারা চার ভাই ও তিন বোন। ভাইদের মধ্যে তৌহিদ তৃতীয়। তাদের মা প্রায় ২০ বছর আগে মারা গেছেন। তার স্ত্রী ও চার মেয়ে আছে। চারজনের মধ্যে বড় মেয়ে তাসফিয়া আক্তারের বয়স ১৪ বছর, অন্যরা আরও ছোট।
স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা নিহত তৌহিদুল ইসলামের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার চার মেয়ের মধ্যে তিনজনই কোরআনে হাফেজ। আমার স্বামী আজীবন সৎ পথে চলেছেন। কোনো অন্যায় করেননি। তাকে কেন হত্যা করা হল? তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, তা আমরাও জানতে চাই। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই’।
এ ‘হত্যার’ ঘটনায় প্রতিবেশী সাইফুলের সাথে জাহাঙ্গীরও জড়িত বলেও দাবি তার।
ইয়াসমিন নাহার বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে, সাইফুল ও তার সহযোগীরা যৌথবাহিনীকে ব্যবহার করেছেন। তাকে হত্যার পর দুঃখ প্রকাশ করা হচ্ছে। দুঃখ প্রকাশ করলেই কি সব শেষ হয়ে যায়?’।
ওই গ্রামের সাইফুল ও জাহাঙ্গীরের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তাদের বাড়িতে গেলে দরজায় তালা ঝুলতে দেখা গেছে। তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাতে বাড়িতে এসে তৌহিদের পরিবারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন যৌথবাহিনীর কর্মকর্তারা।
রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) যৌথবাহিনীর পক্ষে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এনাম সাংবাদিকদের জানান, পাঁচটি সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে। সেগুলো হল, এ বিষয়ে তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কার্যক্রম শেষ হওয়া মাত্রই বিচার প্রক্রিয়া শুরু এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সার্বক্ষণিক তৎপর থাকবে যৌথবাহিনী। পরিবারের নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষায় সচেষ্ট থাকবে এবং নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে পরিবারকে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করা হবে।
‘হত্যার’ মাত্র চারদিন আগে গত ২৬ জানুয়ারি তৌহিদের বাবা মোখলেছুর রহমান (৮৫) বার্ধক্যের কারণে মারা যান। তার কুলখানির আয়োজন ছিল ৩১ জানুয়ারি। কিন্তু আগের রাতে তৌহিদকে ধরে নেয়া ও ওইদিনই তার মরদেহ উদ্ধারে সেটি শেষ পর্যন্ত আর হয়নি।
তৌহিদের মৃত্যুতে এলোমেলো হয়ে গেছে সবকিছু বলে জানিয়ে বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ টিপু আরও বলেন, ‘এখন কারণ জানাসহ এই হত্যার বিচার চাই আমরা। আর কিচ্ছু চাই না’।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে