জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে আগুন কী বার্তা দিল?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ কেসস্টাডি- যারা একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থেকে ‘সরকারবিরোধী দল’ নামে একটি নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছিল। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে ক্ষমতার ভাগীদার হিসেবে তারা নানাবিধ সুবিধা নিয়েছে। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফে তাদের ‘স্বৈরাচারের দোসর’ বলেও আখ্যা দেয়া হয়েছে। ঘটনার পরম্পরায় গত বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) রাতে রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন দেয়া হয়েছে। ভাঙচুর চালানো হয়েছে। পরদিন শুক্রবার (পয়লা নভেম্বর) দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ‘ছাত্র-জনতার নামে কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোক এই ঘটনা ঘটিয়েছে।’
আওয়ামী লীগের কোনো অপকর্মের সঙ্গে জাতীয় পার্টি জড়িত ছিল না এবং জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের দোসর নয় বলেও তিনি দাবি করেন। গণমাধ্যমের খবর বলছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে হেলমেট পরা একদল লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে জাতীয় পার্টির কার্যালয় ভাঙচুর করেছে। এ সময় তাদের ‘আওয়ামী লীগের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’ স্লোগান দিতে শোনা যায়। তারা কার্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন এবং ব্যানার, ফেস্টুন ও চেয়ার নিয়ে কার্যালয়ের সামনে আগুন ধরিয়ে দেন। কার্যালয়ের কক্ষের ভেতরেও আগুন দেখা গেছে। এর আগে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘জাতীয় বেইমান জাতীয় পার্টি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিজয়নগরে আমাদের ভাইদের পিটিয়েছে, অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। এবার জাতীয় বেইমানদের উৎখাত নিশ্চিত।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলমও একইরকম পোস্ট দেন। সম্প্রতি রংপুরে হাসনাত-সারজিসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিল জাতীয় পার্টি। এর প্রতিবাদে রংপুরে বিক্ষোভ মিছিল হয়। এ সময় মিছিল থেকে ‘স্বৈরাচারের দোসরেরা হুঁশিয়ার সাবধান; দালালের ঠিকানা এই রংপুরে হবে না; আবু সাঈদ মুগ্ধ শেষ হয়নি যুদ্ধ; সারজিস-হাসনাতের অপমান মানবে না রংপুরের জনগণ; ২৪-এর বিপ্লবীদের অপমান মানবে না জনগণসহ নানা ধরনের স্লোগান দেয়া হয়। মিছিল শেষে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় পার্টিকে ক্ষমা চেয়ে ওই বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানায়। অন্যথায় ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। সুতরাং, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে আগুন দেয়ার পেছনে রংপুরে হাসনাত ও সারজিসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণার রেশ যে আছে, তা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম।
প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যে সংলাপ হয়, সেখানে জাতীয় পার্টিকে ডাকা হয়; কিন্তু এরপরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা যে সংলাপ করেন, সেখানে জাতীয় পার্টিকে ডাকা হয়নি। মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টিকে সংলাপে না ডাকার দাবি জানানো হয়। সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ এ বিষয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জাতীয় পার্টিকে স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের দোসর ও মেরুদণ্ডহীন ফ্যাসিস্টের দালাল হিসেবে উল্লেখ করেন। তার মানে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে আগুন দেয়ার ঘটনাটি হুট করে হয়ে গেছে- বিষয়টি এমন নয়।
তবে যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই হোক না কেন, একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে আগুন দেয়া সমর্থনযোগ্য নয়। এটি গণতন্ত্র বিকাশের অন্তরায়। রাজনীতির মোকাবিলা করতে হয় রাজনীতি দিয়ে। কোনো একটি দল যদি জনবিরোধী কাজ করে, দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে তাদের প্রধান বিচারক জনগণ এবং সেই বিচারের উপযুক্ত সময় হচ্ছে নির্বাচন। জনগণ যদি মনে করে যে, কোনো একটি দল জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তাহলে তারা ওই দলকে ভোট না দেয়ার মধ্য দিয়েই এর জবাব দেবে। আর যদি ওই দলের বিরুদ্ধে সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন তথা কোনো ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ ওঠে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনেই বিচার হতে পারে। এমনকি সেই দল বা সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধও করা হতে পারে; কিন্তু আইন-কানুন ও বিচারব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে আগুন দেয়ার ঘটনা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠারও অন্তরায়।
এখন প্রশ্ন হলো, জাতীয় পার্টি কি এই ঘটনার বিচারের জন্য মামলা করবে? মামলা করতে চাইলে পুলিশ কি মামলা নেবে? মামলা নিলেও পুলিশ কি অপরাধীদের গ্রেপ্তার করবে বা গ্রেপ্তারের সাহস দেখাবে? সর্বোপরি এই ঘটনায় কি কোনো সুষ্ঠু বিচার হবে? প্রশ্নটা এ কারণে যে, যারা জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে ভাঙচুর চালাল এবং আগুন দিল, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কার্যত সরকারের অংশ। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের মূল নেতৃত্বে ছিল তারাই এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণেও বলেছেন যে, ছাত্ররাই হচ্ছেন তাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। সুতরাং সরকারের কাছে জাতীয় পার্টি যদি বিচার চায়ও, তারপরও সরকার কি তাদের নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে বা নিতে পারবে?
খোদ রাজধানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত একটি বড় রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে হামলা চালানো হবে বলে যখন দুজন সমন্বয়ক সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা দিলেন, সেটি কি পুলিশ, সেনাবাহিনী বা গোয়েন্দা বাহিনীর চোখে পড়েনি? তারা কি চাইলে কার্যালয়ে আগুন দেয়ার ঘটনাটি প্রতিহত করতে পারত না? যেহেতু ঘোষণা দিয়ে ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়েছে এবং সেটি প্রতিহত করার কোনো উদ্যোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফে দেখা যায়নি, তার মানে কি এই যে, এই ঘটনায় তাদের সমর্থন আছে? নাকি তারা ভেবেছে যে প্রতিহত করতে গেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হবে এবং তারা সেই সংঘাত এড়াতে চেয়েছে? এরকম আরও অনেক প্রশ্ন জনমনে আছে। এখনই এসব প্রশ্নের সদুত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না।
কিন্তু এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভিন্নমত ও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের প্রতি ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতার অংশীদারদের প্রতিহিংসামূলক আচরণের একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। এর মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে যে জাতীয় নির্বাচন হবে, সেখানে সরকার-সমর্থিত বা ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট দলগুলোর বাইরে অন্য দলগুলোর প্রার্থী ও সমর্থকদের প্রতি কী ধরনের আচরণ করা হবে- তারও কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া গেল কি না, সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। যদি তাই হয়, তাহলে ইনক্লুসিভ রাজনীতি বা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশকে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাওয়ার যে জনপ্রত্যাশা ও জনআকাঙ্ক্ষা- সেটি আখেরে অধরাই থেকে যাবে।
তবে সঙ্গে সঙ্গে দল হিসেবে জাতীয় পার্টিরও এখন আত্মসমালোচনার সময় হয়েছে যে, বরাবর ক্ষমতাকাঠামোর মধ্য থেকে তারা একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকার যে অদ্ভুত ‘সংস্কৃতি’ তৈরি করেছিল, দল হিসেবে সেটি তাদের দুর্বল করেছে কি না? জনগণের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি করেছে কি না? সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগের ক্ষমতার অংশীদার হিসেবে আওয়ামী লীগের অপরাধের দায়ও তাদের ওপর বর্তায় কি না? যদি তাই হয়, তাহলে তারা জনগণের কাছে এর কী জবাব দেবে? দলের চেয়ারম্যান যদিও দাবি করছেন যে, তারা আওয়ামী লীগের কোনো অপরাধের সমর্থন করেননি বা তারা আওয়ামী লীগের দোসর নন; কিন্তু এই কথার বিশ্বাসযোগ্যতা কম। সুতরাং তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য কি জনগণের কাছে ক্ষমা চাইবে?
দলের প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পরে নেতৃত্বের প্রশ্নে জাতীয় পার্টির ভেতরে যে গৃহদাহ শুরু হয়েছিল, তার মধ্য দিয়ে দলটি অধিকতর দুর্বল হয়েছে। অতএব, তারা সেই দুর্বলতা কীভাবে কাটাবে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এককভাবে নির্বাচন করে তারা বৃহত্তর রংপুরের বাইরে দেশের অন্য কোনো এলাকায় আদৌ সুবিধা করতে পারবে কি না- সেটিও বিবেচনা করা দরকার। সেজন্য তাদের সামনে এখন দল গোছানো একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। তাদের অন্তত এই উপলব্ধিটা করা জরুরি যে, সুবিধাবাদ সব সময় সাময়িক সুবিধা দিলেও আখেরে এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে