বৈষম্যের অভিযোগ
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন: আহতদের একমাত্র দাবি পুনর্বাসন
গত বছর জুলাই-আগস্টে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে তারা ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছিলেন দেশে বৈষম্য দূর করে মানুষের মধ্যে সমতা ফিরিয়ে আনতে। অথচ মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে এই আন্দোলনে আহতরা দাবি করছেন, তারা নিজেরাই এখন চরম বৈষম্যের শিকার। সময়মতো চিকিৎসা পেলেও এখন তাদের মূল দাবি পুনর্বাসন। অনেকেই পঙ্গু হয়েছেন, চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন অনেকেই ফলে তারা ভুগছেন ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায়। আহতরা বলছেন, তাদের পুনর্বাসন না হলে পরিবার নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থার উত্তরণে বিগত পাঁচ মাস যাবৎ আন্দোলন করছেন তারা। সর্বশেষ গতকাল রাতে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে তারা ছুটে গেলেন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে। পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে আনলেও, এই সমস্যার সমাধান এখনই হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মূল দাবি পুনর্বাসন
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত আহতদের মধ্যে অঙ্গ হারিয়েছেন মোট ২১ জন। এদের মধ্যে এক পা হারিয়েছেন ১৭ জন এবং এক হাত হারিয়েছেন চারজন।
পঙ্গু হাসপাতালের ডেপুটি ডিরেক্টর ড. বদিউজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, ‘এ পর্যন্ত ২১ জন আহত আন্দোলনকারী পঙ্গু হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৭ জনের এক পা এবং চারজনের এক হাত কেটে ফেলা হয়েছে। সম্প্রতি আরেকজন এরকম রোগীর অস্ত্রোপচার আমরা করেছি। সে হিসেবে সংখ্যাটি ২২ হওয়ার কথা থাকলেও আমরা আপাতত অফিসিয়ালি সেটা ২১ বলছি কারণ এই রোগীর পরিচয় নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, তিনি আন্দোলনে আহত হননি। তথ্য যাচাইবাছাই করে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
‘এদিকে পাঁচজন রোগী আছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য যাদের দেশের বাইরে পাঠানো প্রয়োজন। এদের নামের তালিকা আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।’
অন্যদিকে, এই আন্দোলনের সময় আহতদের মধ্যে ৪৫ জন চিরতরে দৃষ্টি হারিয়েছেন এবং ৫৭০ জন হারিয়েছেন এক চোখের দৃষ্টি।
আহতরা বলছেন, যেহেতু তারা শরীরের অঙ্গ হারিয়েছেন, চাইলেই অন্য সবার মতো কাজ করার সক্ষমতা এখন তাদের নেই। আবার আহত অবস্থায় পড়ে থাকার ফলে ছয় মাস ধরে তারা কর্মহীন। পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করাই এখন তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা যায়, গত বছর ১৪ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আহতদের দাবি-দাওয়া নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বলা হয়, দ্রুত সময়ের মধ্যে আহতদের উন্নত চিকিৎসা, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানে ব্যবস্থা করা হবে। এজন্য বেঁধে দেয়া হয়েছিল পাঁচ কর্মদিবস। অথচ, তিন মাস পেরিয়ে গেলেও সেসব অঙ্গীকার কোনোটাই পূরণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার নূরে আলম ফলের ব্যবসা করতেন ঢাকার যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড এলাকায়। আন্দোলনে নেমে চোখে বেশকিছু ছররাগুলি বিঁধলে পাঁচ মাস ধরে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি।
চোখে তিনটি সার্জারির পরও শরীরে এখনো দেড় শতাধিক ছররাগুলির স্প্লিন্টার রয়ে যাওয়ার দাবি নূরে আলমের। বলেন, ‘ডান চোখে দেখি; কিন্তু বাম চোখে কিছুই দেখি না।’
এখন পর্যন্ত আর্থিক বা সরকারি কোনো সহযোগিতাই পাননি বলে অভিযোগ নূরে আলমের। বলেন, ‘আহতদের পক্ষ থেকে উপদেষ্টাসহ সবাইকে মেসেজ দিয়েছি। সুচিকিৎসার জন্য আশ্বাস দিয়েছেন তারা; কিন্তু বাস্তবায়ন কিছুই দেখছি না!’
দেশের বাইরের বিশেষজ্ঞ ভালো কর্নিয়া চিকিৎসক এসে দেখলে হয়তো চোখটা সম্পূর্ণ ভালো হতো বলেও দাবি করেন তিনি।
৫ আগস্ট কুষ্টিয়ায় আহত হলে সেই রাতেই ঢাকায় এনে হাসপাতালটিতে ভর্তি করা হয় কোরবান শেখ হিল্লোলকে। হিল্লোল বলেন, ‘তবে আমাদের সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা হয়নি। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার পরিচিত দুজন উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান। তাদের চোখ দেখে চিকিৎসক বলেছেন, চোখ ড্রাই হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে যদি যেতেন, দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ না ফিরলেও ৭৫ শতাংশ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আবার চীন ও নেপাল থেকে চক্ষু চিকিৎসক এই হাসপাতালে এলেও রোগীদের সন্তোষজনক উন্নতি হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘এই আন্দোলনে সবাই আহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হননি। গোটা কয়েক মানুষ আহত, পঙ্গু হয়েছেন বা চোখ হারিয়েছেন। এই সরকার আমাদের সরকার, কেন আমাদের নিয়ে ভাববে না? যাদের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছি, তাদের কাছে কেন আবেদন করব? সরকারের কাছেই বা কেন আবেদন করব?’
রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কয়েকজন রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের উন্নত চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
তাদের অভিযোগ, এখন পর্যন্ত তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো মূল্যায়ন করা হচ্ছে না, স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা কিংবা উপার্জনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না।
এরকমই একজন ইমরান প্রামাণিক। দশম শ্রেণির ছাত্র ইমরান জানান, আন্দোলনে তিনি গুরুতর আহত হয়ে ছয় মাস যাবৎ নিটোরে চিকিৎসাধীন। আহত হওয়ার ফলে তার পড়াশোনায় ক্ষতি হয়েছে। স্বাভাবিক পড়াশোনা তার পক্ষে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব কিনা তিনি জানেন না। তার প্রয়োজন পুনর্বাসনের যাতে ভবিষ্যতে জীবনযাপন করা চ্যালেঞ্জিং না হয়ে যায়।
ইমরান জানান, ‘আমাদের পুনর্বাসন না করা হলে আমরা অদূর ভবিষ্যতে সংকটে পতিত হব।’
৪ আগস্ট ফেনীতে গুলিবিদ্ধ সাইফুল ইসলাম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল এদেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করা। সে আন্দোলনে আমরা যারা সম্মুখ সারিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করেছি তাদের বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল নেতৃত্বেও গুরুতর আহত কেউ নেই। সরকারের দায়িত্ব নেয়া ছাত্ররাও কেউই গুলিবিদ্ধ নন।’
‘অথচ যারা আহত হয়েছি, তারা জাতীয় নাগরিক কমিটিতেও মূল্যায়ন পাইনি। আমাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও সরকারের সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না।’
এ সময় তিনি এই ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরকারকে দ্রুত পদত্যাগ করে নির্বাচন দেয়ার আহ্বান জানান।
ট্রমা
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আন্দোলনের ট্রমার কারণে নির্দিষ্ট সময় পর পর আহতদের ক্ষোভ বিস্ফোরিত হচ্ছে। আমাদের যে মানসিক স্বাস্থ্যগত প্রস্তুতি, মেন্টাল ট্রমা বা পিটিএইচডি (পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার) অ্যাড্রেস করার সামর্থ্য যথেষ্ট নয়। এরকম হাজার হাজার যোদ্ধার পিটিএইচডি অ্যাড্রেস করার সামর্থ্য নেই বিধায় তাদের মধ্যে বিস্ফোরণ হয় নির্দিষ্ট সময় পর পর। অবশ্যই আমাদের কোনো ত্রুটি বা বিচ্যুতি এটাকে স্পার্ক করে; কিন্তু মূলত একটা পিটিএইচডি সাইকেলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিস্ফোরিত হচ্ছে।’
‘আহতরা ৫-৬ মাস ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এতে করে তাদের ওপর যে মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে, সেটি প্রশমনে আমরা যথেষ্ট ব্যবস্থা নিতে পারিনি। এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। তাদের কাছে দুটি দাবি আছে। গতকাল রাতে আহতরা বলেছেন, যোদ্ধাদের ক্যাটাগরি করার ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা এবং আজ আমরা যেটা পেয়েছি আহতদের ক্যাটাগরি সঠিকভাবে প্রণয়নের বিষয়টি। আমরা দুটিই করার জন্য বলেছি। যদি কেউ কারও ক্যাটাগরি পরিবর্তন করতে চান, বিজ্ঞানভিত্তিক প্রস্তাবনা দেন আমরা দুটিই বিবেচনা করবো।’
ফান্ডের টাকা বিতরণে দেরি
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) জুলাই আন্দোলনে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন কয়েকজন জানান, ৬ মাস পার হয়ে গেলেও সরকারের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত অনুদান পাননি তারা। জুলাই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও সেখানে পেয়েছেন মাত্র এক লাখ টাকা। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আন্দোলনে আহতরা।
পশালীহাটা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র শাহীন আলম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, আন্দোলনে যারা গুরুতর আহত তাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৩ লাখ টাকা। তুলনামূলক কম আহতদের জন্য সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। ফলে এ অর্থ বরাদ্দ প্রক্রিয়া ভারসাম্যহীন বলে দাবি তার।
সখ্য থাকলেই বিদেশে চিকিৎসা
সিরাজগঞ্জ জেলার শরীফুল ইসলাম। গত বছরের ৪ আগস্ট আহত হন পুলিশের গুলিতে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সমন্বয়কদের সঙ্গে সম্পর্ক যাদের ভালো, তাদেরই উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ প্রেরণ করা হয়েছে। আর যাদের সঙ্গে সখ্য নেই তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এ নিয়েও ক্ষোভের কথা জানান আহত রিকশা শ্রমিক ফুলচাঁদ মিয়া।
এ ব্যাপারে নিটোর ডেপুটি ডিরেক্টর ড. বদিউজ্জামান বলেন, ‘আমরা এখানে চিকিৎসা দানকালে যাদের গুরুতর মনে করছি, তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর পরামর্শ দিচ্ছি। সম্প্রতি এরকম পাঁচজনের নামের তালিকা করা হয়েছে। আমরা পরামর্শ দিচ্ছি, নীতিনির্ধারণী বিষয়ে আমাদের কোনো ধারণা নেই।’
কর্তৃপক্ষ কী বলছে
জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে নানান উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, এমনটিই দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা জানিয়েছেন, আহতদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের বিষয়ে সরকার একটি রূপরেখা তৈরি করেছে। এটি গাইডলাইন আকারে প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। বিশেষ করে আন্দোলনে আহত হয়ে যারা কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন, তাদের আজীবন ভাতা দেয়া হবে এবং প্রত্যেকের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ও আজীবনের জন্য উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে