Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ন্যায়বিচার ও মিডিয়া ট্রায়াল

Md J R Khan Robin

মো. জে আর খান রবিন

বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট ২০২৩

সুশাসনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে আইনের শাসন। বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা, বিচারকদের বিচারিক মন, আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হয় ন্যায়বিচার। আইনের শাসন বলতে আইনের চোখে সবাই সমান এবং সবকিছুর উপরে আইনের প্রাধান্যের স্বীকৃতিকে বোঝায়। আইনের শাসন এর অর্থ হচ্ছে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি এবং ছোটো-বড়ো নির্বিশেষে সবাই আইনের কাছে সমান।

দেশে বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থার মধ্যে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন। সাথে সাথে এটিও বিবেচিত হয়,  একশ’ অপরাধী মুক্তি পেলেও যেন কোন নিরাপরাধ ব্যক্তি শাস্তি না পান।

বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আইনের বাস্তবায়ন ক্রমে দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের বিদ্যমান ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় বিচারক, পুলিশ, প্রসিকিউটর, আইনজীবী সকলের ভূমিকা অপরিসীম এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফৌজদারি বিচারকার্য সম্পূর্ণ হয়।
বিদ্যমান ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রয়েছে। কারণ মানুষের জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম এবং সম্পত্তির ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং আইনগত সুরক্ষার লক্ষ্যে নাগরিকের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মূখ্য উদ্দেশ্যে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভুল তদন্তের কারণে একজন মানুষকে কি পরিমান হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বুঝবেন না। যেমনটি মিথ্যা মামলায় ‘জাহালাম’ নামক ব্যাক্তির ঘটনা গনমাধ্যমে এসেছে। কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ‘হেলালের’ ক্ষেত্রে ঘটেছে। ওই ‘হেলাল’ এখন বিসিএস অফিসার। এরূপ অনেক উদাহরণ রয়েছে।

দেশে বিদ্যমান ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় আমলযোগ্য ও অ-আমলযোগ্য অপরাধের বিষয়ে বর্ণিত রয়েছে। আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারেন। অন্যদিকে অ-আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে আদালতের আদেশ ছাড়া অর্থাৎ গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করতে পারেন না। গ্রেফতার, আটক ও তল্লাশির বিষয়ে সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ, ফৌজধারি কার্যবিধির ৪৬-১০৩ ধারায় ও পুলিশ তদন্ত নির্দেশিকার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৬(১)-৬(১৬) ধারায় বর্নিত রয়েছে। তাছাড়া সুপ্রিমকোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের এই সংক্রান্ত একাধিক নির্দেশনাও রয়েছে।
প্রতিনিয়ত তার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে কখনও কখনও অতি সাধারণ মামলায় কাউকে দুর্ধর্ষ আসামির ন্যায় গ্রেফতার করে তার বসতঘরসহ উদ্ধারকৃত আলামত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যগন মিডিয়ার মাধ্যমে জনসমক্ষে এমনভাবে প্রচার ও প্রকাশ করে যা কোনভাবেই আইন সম্মত নয়।
এছাড়াও অনেক সময় দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের হেফাজতে থাকা কোন কোন স্পর্শকাতর মামলায় অভিযুক্ত ব্যাক্তির নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য মিডিয়ায় যেভাবে বক্তব্য দিয়ে থাকেন তা রীতিমত আদালত অবমাননারও সামিল। কাউকে গ্রেফতার করেই মামলা দায়েরের পূর্বে ও পরে মিডিয়ায় না দেখানোর বিষয়ে ২০১২ সালে  হাইকোর্ট নির্দেশ প্রদান করেন।  ২০১৯ সালের ১৬ মে তারিখে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ বিচারাধীন মামলার খবর প্রচার সংক্রান্ত বিষয়ে গনমাধ্যমের প্রতি নির্দেশনা দেন।  অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ এর ১৪ ধারা অনুযায়ী কোন ভিক্টিমের ছবি মিডিয়ায় প্রচার না করার ব্যাপারে এবং শিশু আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী কোনো শিশুর পরিচয় প্রকাশ না করার ব্যাপারে বিধি-নিষেধ রয়েছে।

এভাবে কোন অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে মিডিয়াতে উপস্থাপন করা হলে দেশের সাধারণ জনগন তার সম্পর্কে অপরাধী ভেবে নেতিবাচক ধারনা পোষণ করেন এবং ওই ব্যক্তি পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়াসহ তার পরিবারও সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হন। এটা সবার মনে রাখা উচিৎ যে, আইনের দৃষ্টিতে অভিযুক্ত ব্যক্তি আর অপরাধী এক নয়। বিচারিক আদালত কর্তৃক চূড়ান্ত ভাবে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যায় না। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ আদালত কর্তৃক বিচার কার্যক্রম শেষ করার পূর্বেই যদি মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে থাকে তাহলে পরবর্তীতে আদালতও ওই মামলায় বিচারকার্যে অনেক সময় বিব্রতবোধ করেন। কেননা বিচারকও এ সমাজ তথা এ রাষ্ট্রেরই একজন নাগরিক।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারা অনুযায়ী পুলিশের নিকট প্রদত্ত জবানবন্দি সাক্ষ্য আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি ফৌজদারি কার্য্যবিধির ১৬৪ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রদত্ত জবানবন্দি সাক্ষ্য আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী সাক্ষ্য নয়। তাছাড়াও সাক্ষ্য আইনের ২৬, ৩০, ১১৪ (বি)১৩৩, ১৩৮,১৪৬ ধারা, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭ ও ৩৩৮ ধারা ও পুলিশ রেগুলেশনের (১৯৪৩)২৮৩ ধারার বিধান সাপেক্ষে উক্ত জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হতে পারে।
কিন্ত ফৌজদারি কার্য্যবিধির ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত জবানবন্দি নিয়েও রয়েছে নানান বিতর্ক, যা ইতিপূর্বে কোন কোন মামলার ক্ষেত্রে অসত্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং এ নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইনগত ভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ও ৩৪৪ ধারা মোতাবেক আদালত কখনো কখনো আসামিকে পুলিশ হেফাজতে (রিমান্ড) নেয়ার আদেশ প্রদান করতে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রেও আদালতকে সচেষ্ট ও সর্তক থাকতে হয়।আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আবেদন অনুযায়ী কথায় কথায় রিমান্ড মঞ্জুর করলে অনেক সময় হিতে বিপরীতও হতে পারে!

ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার করার ক্ষেত্রে তার বয়স, স্বভাব চরিত্র সব কিছু প্রাসঙ্গিক। সাথে সাথে তার কৃতকর্মের অভিপ্রায়কেও বিবেচনা করা হয়।  ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আদালতকে আইনগত ভাবে অনেকদিক বিবেচনা করতে হয়। আবেগ দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

আমরা জানি আইনগত ভাবে অপরাধের মাত্রা রয়েছে। বিচারের ক্ষেত্রে যা খুবই প্রাসঙ্গিক অর্থাৎ সব অপরাধকে একই ভাবে বিবেচনা করা যায় না। অন্যদিকে এটি মনে রাখা উচিৎ অপরাধীর সংস্পর্শে এসে নিরাপরাধীও অপরাধী হয়ে উঠে। কোন নির্দোষ ব্যাক্তিকে যখন মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় তখন ওই ব্যাক্তি বিচারিক প্রক্রিয়ায় অব্যাহতি বা খালাস পেলেও তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠে এবং এতে নিরাপরাধী ব্যাক্তিও একদিন ভয়ংকর অপরাধী হয়ে উঠেন। এর উদাহরণও এ সমাজে রয়েছে।

ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে কাউকে কোন অপরাধে অভিযুক্ত করার পূর্বে অনেক সর্তক থাকতে হয়। কারণ একজন মানুষের সামাজিক মর্যদাসহ মৌলিক অধিকার হরণ করার অধিকার কারো নেই। বিচারের নামে কাউকে হয়রানি করা কোন ভাবেই কাম্য নয়।  মিডিয়া ট্রায়ালে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩(১) অনুযায়ী অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না থাকায় শুধুমাত্র ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ আবেগ দিয়ে করা যায় এবং সাধারন জনগন নিজেকে বিচারক ভেবে যার যার মত মন্তব্য করতে পারেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের দেশের সম্পদ। তারা জনগণের জান-মালের নিরাপত্তার লক্ষ্যে জীবনবাজি রেখে প্রতিনিয়ত দায়িত্ব পালন করছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের অপরাধমূলক ভূমিকায় কখনো এ বাহিনীর প্রতি নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করে। তবে এক্ষেত্রে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার অসংখ্য নজিরও রয়েছে। যেমন-নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জড়িত সদস্য, দুদকের আনা মামলায় ডিআইজি মিজানুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপসহ এরূপ অনেক উদাহরণ রয়েছে যাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে এবং বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান’ এই নীতি রাস্ট্রের সকল স্তরে প্রতিষ্ঠিত হবে এটিই আইনের শাসনের পূর্বশর্ত।

অন্যদিকে স্বাধীন মিডিয়াও বা গনমাধ্যম হল সমাজের আয়না। গনমাধ্যমকে রাস্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গনমাধ্যম একটি সুষ্ঠু সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে অপরিসীম ভূমিকা রাখেছে। মিডিয়ার স্বাধীনতার বিষয়ে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে উল্লেখ থাকলেও সে স্বাধীনতারও কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্র সমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনের প্ররোচনা সম্পর্কে আইন দ্বারা আরোপিত যুক্তি সংঘত বাধা নিষেধ রয়েছে। অন্যদিকে মানুষ সর্বদা নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট। সুতরাং নিষিদ্ধ বিষয়গুলো জনসমক্ষে না আসাই ভালো। কারণ এতে কমবয়সী ছেলে-মেয়েসহ সবাই আকৃষ্ট হয়ে বিপথগামী হতে পারে। এক্ষেত্রেও মিডিয়াকে দায়িত্বশীল হতে হয়। 

 কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়, তাই বলে মানুষের একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয় মিডিয়ায় বার বার আসা কোন ভাবেই কাম্য নয়। এতে অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে নিয়ে সহজেই ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ হয়ে যায়। তাছাড়া আমাদের বিচার ব্যবস্থায় এখনও ডিজিটাল তথ্য উপাত্ত সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এগুলো বিচারের কোন অংশ হতে পারে না। তবে সরকারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যাক্তি যৌক্তিক কারণে কখনও কখনও ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারেন। তাই বলে কারো ব্যক্তিগত বিষয় উদ্দেশ্যমূলক মিডিয়ায় প্রকাশ ও প্রচার না হওয়াই শ্রেয়। এক্ষেত্রে মিডিয়া ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সংশ্লিষ্টদের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য।



মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ