বর্ণ ও লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে কমলা হ্যারিসের নিরন্তর লড়াই
২০২৪ সালের ২৯ আগস্ট টাইম পত্রিকায় প্রকাশিত 'হাউ উইমেন লাইক কমলা হ্যারিস সেভড অ্যান্ড শেপড আমেরিকা' শিরোনামের একটি নিবন্ধে লেখা হয়েছে, ‘প্রাপ্য স্বীকৃতি অর্জনের জন্য নারীদের সংগ্রাম সর্বজনবিদিত। এই স্বীকৃতির অভাব শুধু ন্যায্যতার বিষয় নয়, সামাজিকভাবেও তাদের অর্জন ততটা স্বীকৃতি পায় না। তাদের শ্রমমূল্য সর্বদাই কম, পুরুষের সঙ্গে নারীর বেতন-কাঠামো ব্যবধান সব দেশেই হয়। নেতৃত্বের অবস্থানে আসা তাদের জন্য আরও কঠিন। সব সময়ই তারা এক সামাজিক পক্ষপাতের শিকার। অবদানের স্বীকৃতি না পাওয়া নারীর সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে।’ নিবন্ধটিতে আরও লেখা হয়েছে, রিপাবলিকানরা কমলা হ্যারিসকে ‘ডিইআই প্রার্থী’ বলে গাল দিয়েছেন। আক্রমণের পুরোনো অভ্যাসের এ এক নতুন পদ্ধতি।
ডিইআই বলতে ‘ডাইভারসিটি, ইক্যুয়িটি এবং ইনক্লুশন’বোঝায়। দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান অসাম্য ও বৈষম্য চিহ্নিত করে কর্মক্ষেত্রে নারী ও বিভিন্ন বর্ণের লোকজনের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে নেয়া উদ্যোগকে ‘ডিইআই’ বলা হয়। এখন ‘ডিইআই ভাড়াটে’ বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যিনি তার পদের যোগ্য নন কিন্তু যাকে কোনো বর্ণের প্রতিনিধি বা লিঙ্গের প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নিয়ে সেই পদে বসানো হয়েছে। হ্যারিসকে ‘ডিইআই ভাড়াটে’ বলতে বোঝানো হয়েছে, তাকে তার যোগ্যতা দেখে নির্বাচিত করা হয়নি বরং বর্ণ, লিঙ্গের ভিত্তিতে বেছে নেওয়া হয়েছে।
ফোর্বস পত্রিকার মতে, করপোরেশন এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এমন করে। সেরা লোকটিকেই খুঁজে বের করার জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়; কিন্তু কাজেরবেলায় বেছে নেয় নিজস্ব পছন্দের প্রার্থীকে। সমতা ও যোগ্যতার চেয়ে ভাড়াটে-প্রার্থীরা সব সময়েই অধিক সুবিধা ভোগ করে থাকেন। যেমন, শ্বেতাঙ্গ পুরুষ প্রার্থীদের সব সময়ই অগ্রাধিকার দেয়া হয় এই যুক্তিতে যে সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতে তাদের প্রবেশাধিকার বেশি, এবং প্রতিষ্ঠানগুলোতেও কাজ করার জন্য তারা সাংস্কৃতিকভাবে ভালো মানিয়ে যান।
কমলা হ্যারিস অনেক দিক দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। প্রথম নারী, প্রথম কালো এবং প্রথম দক্ষিণ এশিয়ান হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৯তম ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এরকম না যে খুব সহজেই তিনি এমন সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছেছেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি অনেক হয়ারানির শিকার হয়েছেন। বর্ণবাদের শিকার হয়েছেন। এত সব প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে গেছেন নিজের লক্ষ্যে।
কমলা হ্যারিসের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেখানে তিনি সান ফ্রান্সিসকোর জেলা অ্যাটর্নি এবং পরে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তার উদ্ভাবনমূলক প্রচেষ্টা, বিশেষ করে ফৌজদারি বিচার সংস্কার এবং ভোক্তা সুরক্ষায় তার অবদান জাতীয় স্বীকৃতি অর্জন করেছে। অনেকেই যেমন তার কাজের প্রতি আগ্রহী ছিলেন, তেমনি তিনি অনেক সমালোচনার শিকারও হয়েছেন। তাকে প্রায়ই মাপা হতো পক্ষপাতের বিচারে এবং বর্ণবাদের দাঁড়িপাল্লায়।
কালো বর্ণের নারী হওয়ায় হ্যারিসকে একসঙ্গে দুটি বিপদের মুখোমুখী হতে হয়েছে সব সময়। একটি বর্ণবাদ, আরেকটি যৌন-নিপীড়নের শিকার। বারবারই তার কৃতিত্বগুলো আক্রমণের শিকার হয়েছে। তার যোগ্যতাকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে হ্যারিস সব সময়ই তার নীততে অটল ছিলেন। অনেক বাধা-বিপত্তি তিনি অতিক্রম করেছেন।
উইক পত্রিকায় আরেকটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘কেন লিঙ্গগতভাবে কমলা হ্যারিসকে ছোট করা হচ্ছে- ২০১৬ সালের হিলারি ক্লিনটনের প্রচারাভিযান থেকে পরিবর্তন’। এত বলা হয়েছে কমলা হ্যারিস হয়তো প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, কিন্তু এতে তার বড় কোনো অবদান নেই। এর বদলে তিনি ‘পরিস্থিতিকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন’। পলিটিকোর বক্তব্য এরকমই। হিলারি ক্লিনটনের ২০১৬ প্রচারাভিযান থেকে এটি একেবারেই ভিন্ন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় হিলারি এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে হেরে যাওয়ার পরও তা ইতিহাস। কমলা হ্যারিসও এবার ট্রাম্পের মুখোমুখি হচ্ছেন, জোর দিয়ে বলছেন ভোটারা একজন নারীকে ভোট দিতে প্রস্তুত, ‘কিন্তু নিজের সম্পর্কেই তিনি যেন অধিক সচেতন।’
আমেরিকান থিং ট্যাঙ্কের মতে, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার বলেছেন তাদের জীবদ্দশায় একজন নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা ‘গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বা কোনো ব্যাপার ছিল না।’ এই ভোটারদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী। ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে হিলারির পরাজয়কে প্রায়ই লিঙ্গগত ব্যবধানকে দায়ী করা হয়। নিজের দুর্বলতা কাটিয়েও হিলারি ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিলেন। সব বাধা তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন।
হ্যারিস যাই করুক না কেন ভোটারদের বিচারে লিঙ্গবৈষম্য অবশ্যই একটা বড় প্রভাব ফেলবে। ইউএসএ টুডেতে পোলস্টার সেলিন্ডা লেক এবং ক্রিস্টিন ম্যাথিউস বলেছেন, ‘নারীরা যে পুরুষদের চেয়ে যোগ্য এটা প্রমাণ করতে পুরুষেরে চেয়ে দ্বিগুণ কাজ করতে হবে।’ ফোকাস গোষ্ঠীর গবেষণাও এটাই দেখায় যে, ভোটারদের কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে নারী প্রার্থীর আরও বেশি কিছু করতে হবে। অধিকাংশ আমেরিকান এখন বলে যে, তারা নারী প্রেসিডেন্ট গ্রহণ করতে প্রস্তুত; কিন্তু তারা নারী নেতৃত্বের ক্ষমতাও দেখতে চায়।
লিঙ্গ-পরিচয়ের রাজনীতি ভোটারদের কাছে আরও জটিল হতে পারে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, নির্বাচনে হ্যারিসের উত্থান ‘নারী এবং তরুণ ভোটারদের দ্বারা প্রবলভাবে চালিত হয়েছে।’ প্রকৃতপক্ষে, পুরুষ এবং নারীর রাজনৈতিক বিভাজন মূলত পক্ষপাতদুষ্ট। বয়স্কদের মধ্যে রিপাবলিকানদের ভোট দেয়ার প্রবণতা বেশি। অ্যাক্সিওসও এরকম বলেছে, লিঙ্গগতভাবে হ্যারিস এতটা দৃষ্টি-আকর্ষণ নাও করতে পারেন। এর মানে এই না যে এই আলোচনাও দৌড় থেকে ছিটকে পড়বে।
২০১৭ সালে হ্যারিস ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মার্কিন সিনেটর নির্বাচিত হন। সিনেটে তার কার্যকাল স্বাস্থ্যসেবা, অভিবাসন সংস্কার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে তার সচেতনতা সবার দৃষ্টি-আকর্ষণ করেছিল। হ্যারিসের স্পষ্টভাষী অবস্থান, অনেক গুণে গুণান্বিত নারী হিসেবে তার পরিচয়, বিভিন্ন ধরণের হয়রানির শিকার সবকিছু মিলিয়েই তিনি নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছিলেন। সিনেট নিশ্চিতকরণ শুনানি এবং জনসাধারণের সম্মুখে উপস্থিতির সময়ে হ্যারিস অবমাননাকর মন্তব্য এবং জাতিগতভাবে অভিযুক্ত আক্রমণের বাধার সম্মুখীন হন। তার সমালোচকরা প্রায়ই তার কর্তৃত্ব এবং বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করার জন্য জাতিগত এবং লিঙ্গগত স্টেরিওটাইপ ব্যবহার করে। এই আক্রমণের মুখে হ্যারিসের তীক্ষ্ণ প্রত্যাখ্যান এবং অটল সংযম তার নীতির প্রতি তার শক্তি এবং অঙ্গীকার তুলে ধরে।
২০২০ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসের নির্বাচন ছিল একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। যা জাতিগত ও লিঙ্গ সমতার লড়াইয়ে অগ্রগতির প্রতীক। তবুও, তার মেয়াদ অব্যাহতভাবে হয়রানি ও পক্ষপাতিত্বের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বর্ণবাদ এবং যৌনতাবাদের অসংখ্য উদাহরণের শিকার হয়েছেন। অবমাননাকর ছদ্মনামে তাকে ডাকা হতো। তার যে কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং নেতৃত্বের ভূমিকা ভিত্তিহীন সমালোচনার শিকার হয়েছে।
তার যোগ্যতা নিয়ে ঘন ঘন প্রশ্ন করা এবং তার কর্তৃত্বকে অবমূল্যায়ন করা, যা প্রায়শই জাতিগত এবং লিঙ্গগত পক্ষপাতের শিকার হয়েছে। এই আক্রমণগুলো সত্ত্বেও, হ্যারিস সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক সমতা এবং জলবায়ু-সংক্রান্ত পদক্ষেপসহ তিনি যে বিষয়গুলোর বিষয়ে যত্নশীল তার জন্য সর্বদাই অবিচল ছিলেন। হয়রানি, পক্ষপাতিত্ব এবং বর্ণবাদের প্রতি কমলা হ্যারিসের প্রতিক্রিয়া স্থিতিস্থাপকতা এবং কৌশলগত নেতৃত্ব দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। আক্রমণগুলো তাকে নিবৃত্ত করার অনুমতি দেয়ার পরিবর্তে, তিনি সেগুলিকে বৃহত্তর পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ব্যবহার করেছেন৷ হ্যারিস ধারাবাহিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ এবং পক্ষপাতের মোকাবিলা এবং বিলুপ্ত করার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন, তার অবস্থান ব্যবহার করে ন্যায় ও ন্যায়বিচারকে উন্নীত করে এমন নীতির পক্ষে সমর্থন করেছেন।
হয়রানি মোকাবিলায় তার দৃষ্টিভঙ্গি তার কাজ এবং তার নীতির প্রভাবের ওপর ফোকাস করা। হ্যারিসের নেতৃত্বের শৈলী বৈষম্য এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দৃঢ় থাকার সময় সামাজিক সমস্যাগুলোর মূল কারণগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য তার প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে। দেশের সর্বোচ্চ পদগুলোর মধ্যে একটিতে হ্যারিসের উত্থান অগ্রগতি এবং নারীদের ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ উভয়েরই প্রতীক। প্রথম মহিলা, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম দক্ষিণ এশীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে, হ্যারিস একাধিক প্রতিবন্ধকতা ভেঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করে। তবুও তার যাত্রা এবং তিনি যে সমালোচনার মুখোমুখি হন তা প্রায়শই একই পক্ষপাত এবং প্রতিরোধকে প্রতিফলিত করে যা নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্মুখীন হয়।
২০২১ সালে ফক্স নিউজের এক সাক্ষাত্কারে ওহাইওর রাজ্যের একজন মার্কিন সিনেটর সেন. জেডি ভ্যান্স কমলা হ্যারিসকে ‘সন্তানহীন নারী বিড়াল’দের একটি দল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি রিপাবলিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট মনোনীত হওয়ার পর থেকে পুনরায় এ কথা বলেন। যা ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। ভ্যান্স বলেন, ‘ডেমোক্র্যাটদের হাতে দেশ তুলে দেয়ার অর্থ হবে নিঃসন্তান বিড়ালদের হাতে দেশ তুলে দেয়া। তারা এখন তাদের পছন্দ মতো দেশ নির্মাণ করবেন। আমি দুঃখিত এভাবে বলার জন্য।’ যদিও হ্যারিসের নিজের কোনো সন্তান নেই, তিনি দুটো সন্তান দত্তক নিয়েছেন। তার সন্তানদের নাম- কোল এবং এলা এমহফ। মাকে তারা আদর করে ডাকে ‘মোমালা’ বলে ডাকে।
কামরুন নাহার: সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে