Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ট্রাম্প-কমলার ভোটের লড়াই ও বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ

Rased Mehedi

রাশেদ মেহেদী

শনিবার, ২ নভেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে মর্কিন হস্তক্ষেপের বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতদিন সংবাদ মাধ্যমের কলামে, পর্যালোচনায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা ছিল। সেই আলোচনাটি হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থান ছিল পরিকল্পিত এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে। সেই আলোচনাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। চূড়ান্ত ভোটের লড়াইয়ে নামার আগে তার এই পোস্ট এখন বাংলাদেশে টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে।

গত ৩১ অক্টোবর এক্স হ্যান্ডেলে দেয়া পোস্টে ট্রাম্পের বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্যের প্রসঙ্গেই বলছি। এই পোস্টে তিনি বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয় উল্লেখ করে এর নিন্দা জানিয়েছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশে বর্তমানে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে বলেও মন্তব্য করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য হচ্ছে ‘ইট উড হ্যাভ নেভার হ্যাপেন্ড অন মাই ওয়াচ’। ট্রাম্পের এই উক্তির সরল বাংলা হচ্ছে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। এই উক্তির মধ্য দিয়ে ট্রাম্প বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকার কথাই স্পষ্ট করে দিলেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাবেক ট্রাম্পের এই বক্তব্য ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। দীর্ঘদিন থেকেই জনশ্রুতি হচ্ছে, ড. মুহম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটদের কাছের মানুষ। বিশেষ করে ডেমোক্রেটিক দলের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ড.মুহম্মদ ইউনূস । এবারের নির্বাচনে জো বাইডেন প্রথমে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলেও পরবর্তী সময়ে ডেমোক্র্যাটরা প্রার্থী বদল করে জো বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের নাম ঘোষণা করেন। আর রিপাবলিকানরা সাবেক প্রেসিডেন্টে ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই প্রার্থী হিসেবে বহাল রেখেছেন। তবে দৃশ্যত কমলা-ট্রাম্প লড়াই হলেও মূল লড়াইটা হবে গত চার বছরে জো বাইডেন নীতির প্রশ্নেই। বাইডেন নীতি না ট্রাম্প নীতি, কোনটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উপযুক্ত ছিল, সেটাই এবারের নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে মূল ভূমিকা রাখবে।

এই অবস্থায় নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার একটি নির্বাচনি পোস্ট শুরু করলেন ‘বাংলাদেশ’ এর নাম উল্লেখ করে। যেখানে তার মন্তব্য এবং বক্তব্য ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বিব্রতকর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ট্রাম্প বলেছেন, ‘ইট উড হ্যাভ নেভার হ্যাপেন্ড অন মাই ওয়াচ’ বা তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে, নির্বাচনে ট্রাস্প জিতলে বাংলাদেশ ঘিরে বাইডেন প্রশাসনের নীতি আমূল বদলে যাবে? কীভাবে বদলাবে? সেই নীতি বদলের সুফল বাংলাদেশের রাজনীতিতে কারা কীভাবে ভোগ করবেন? বাইডেন সমর্থিত হিসেবে পরিচিত বর্তমান সরকারের সঙ্গেই বা ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্ক কেমন হবে? কারণ ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটের লড়াই থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি থেকে এখন পর্যন্ত ট্রাম্প-বাইডেন সম্পর্কের তিক্ততা একেবারেই স্পষ্ট। অতএব, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এই সরকারকে কি সমর্থন দেবেন? যদি সমর্থন না দেন তাহলে কী হবে?

যদিও এর আগে আমরা দেখেছি যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট বদল হলেও পররাষ্ট্রনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক নীতিতে খুব একটা পরিবর্তন আসে না। তবে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি আমূল পরিবর্তিত হতে দেখা গেছে। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিন শত্রুতা থাকা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের একটা নীতি নিয়েছিলেন। তিনি উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে ফিলিস্তিনে নির্বিচার হামলা, হত্যা এবং যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ইসরায়েল নিঃশর্ত সমর্থন পায়নি। বরং ওই অঞ্চলে যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বন্ধের জন্য ট্রাম্প আরব দেশগুলোর রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। বিপরীতে জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে শত্রু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে শত্রুতা আরও বাড়ানোর নীতিতে চলে গেছেন। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। পশ্চিম ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র দেশগুলো এই যুদ্ধ না চাইলেও বাইডেন প্রশাসন অনেকটা একক নীতিতেই এই যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এর নেতিবাচক ফল যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এবং পুরো বিশ্বকেই ভোগ করতে হয়েছে। মধ্যপ্রোচ্যে বাইডেন যুদ্ধ পরিস্থতি সৃষ্টি এবং বজায় রাখার নীতিতেই গুরুত্ব দিলেন। বাইডেনের যুদ্ধনীতিতে ফিলিস্তিন থেকে লেবানন পর্যন্ত রক্তাক্ত হয়েছে। জো বাইডেনের রানিংমেট কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে নিশ্চিতভাবেই বাইডেন নীতিরই সম্প্রসারণ করবেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের রক্তাক্ত অধ্যায় আরও নতুন সীমানায় বিস্তৃত করার উদ্যোগ নেবেন, কোনো সন্দেহ নেই।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যদি ট্রাম্প জিতে যায়, তাহলে কী হবে? নিশ্চিতভাবে ট্রাম্প তার পুরোনো নীতিতে ফিরে যাবেন। আসলে নিজের প্রথম মেয়াদের চার বছরে ট্রাম্প যুদ্ধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং স্থিতিশীলতা এবং আস্থার সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার নতুন কূটনীতি গ্রহণ করেছিলেন। ট্রাম্পের নীতি তার পূর্বসূরি রিপাবলিকানদের থেকেও পৃথক ছিল। এ কারণে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের অনেকেই ট্রাম্পকে ‘রিপাবিলিকান প্রেসিডেন্ট’ না বলে যুক্তরাষ্ট্রের একজন স্বতন্ত্র প্রেসিডেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অতএব, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বাইডেন নীতির বিপরীতেই  কি অবস্থান নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প?

এ প্রশ্নের উত্তর আসলে ট্রাম্প তার এক্স হ্যান্ডেলের পোস্টেই দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি তার মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন এবং তিনি ক্ষমতায় থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে দিতেন না বলে মন্তব্য করেছেন। এর অর্থ বর্তমানে যে ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশে আছে, সেটা ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থন করেন না এবং এর বিপরীতেই তিনি অবস্থান নেবেন। এখন প্রশ্ন ওঠে সেই বিপরীত অবস্থানটা আসলে কী? তাহলে কি ট্রাম্পের অবস্থান পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে যাবে?

মার্কিন কূটনীতির ধারাবাহিতার ইতিহাস এবং বিদ্যমান বাস্তবতা বিবেচনায় ট্রাম্পের অবস্থান পরিবর্তিত হলেও তা শেখ হাসিনা কিংবা তার হাতে গত ১৬ বছরে নেতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে যাবে বলে মনে হয় না। কারণ মাত্র কিছুদিন আগে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানে পতিত সরকার কিংবা উৎখাত হয়ে পালিয়ে যাওয়া সরকার প্রধানকে সক্রিয় সমর্থন দেয়া যুক্তরাষ্ট্র কেন, অন্য কোনো দেশের সরকারেরই পক্ষেই সম্ভব নয়। দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া একজন সাবেক সরকারপ্রধানকে আশ্রয় দেয়া এবং পুনরায় ক্ষমতায় যেতে সমর্থন দেয়া এক বিষয় নয়। এখানেই কূটনীতি কুয়াশাচ্ছন্ন।

বরং ট্রাম্প কিংবা কমলা, যিনিই নির্বাচিত হন না কেন, বাংলাদেশ ঘিরে আগামীতে যুক্তরাষ্ট্র নীতির সবচেয়ে বড় মনোযোগ হবে বাংলাদেশে নতুন করে উগ্র্পন্থিদের উত্থান ঘটছে কি না, তা নজরে রাখা। সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী এ বিষয়টিতে এরই মধ্যে বর্তমান বাইডেন প্রশাসনও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে উদ্বেগ জানিয়ে কূটনৈতিক বার্তা দিয়েছে। এই উদ্বেগ নিশ্চিতভাবে প্রতিবেশী ভারতেরও থাকবে। আর দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রশ্নে যৌথ অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র্র। ফলে বাংলাদেশে উগ্রপন্থার উত্থানকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই সমর্থন করবে না, এটাই বাস্তবতা। চীন এবং রাশিয়ারও বড় বিনিয়োগ আছে বাংলাদেশে। অতএব, ভারত-যুক্তরাষ্ট্রও তাদের বিনিয়োগের স্বার্থে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কিংবা উগ্রবাদের উত্থান চাইবে না।

যে কোনো দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাই উগ্রপন্থার বিকাশে সবচেয়ে বড় সহায়ক। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত নির্বাচিত সরকার ছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব। এ কারণেই চীন, ভারত, রাশিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক বার্তায় যত দ্রুত সম্ভব একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপ থাকবে, এটাই যুক্তিসঙ্গত। দেশের ভেতরেও বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোও দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে তাদের স্পষ্ট অবস্থানের কথা জানিয়েছে। সরকারও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারের জাতীয় নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু হয়েছে।

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। আশাকরি, বর্তমান সরকার একটি অবাধ, সফল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনবে। সেই নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার প্রতিহিংসা আর দম্ভের অপসংস্কৃতির পরিবর্তে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, মানবিক বোধের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলবে, যার মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতির নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। ট্রাম্প কিংবা কমলা হ্যারিস, যিনিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না কেন, অবশ্যই শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহযোগিতা ও সমর্থন থাকবে।

রাশেদ মেহেদী: সাংবাদিক, সম্পাদক ভিউজ বাংলাদেশ।  

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ