Views Bangladesh Logo

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কিৎকিৎ খেলা

ক্কা-দোক্কা বা কিৎকিৎ খেলার নানা ধরনের ছক বা কোর্ট কাটা হয়। চতুর্ভুজ ঘরের ভেতর আড়াআড়ি করে তিনটি দাগ টানা হয়, এরপর এই তিনটি দাগ বরাবর মাঝখানে একটি দাগ টেনে ছয়টি ঘর তৈরি করা হয়। অঞ্চল ভেদে এই ঘর আলাদা ধরনের হতে পারে। এই ঘরগুলোর নাম হচ্ছে- এক্কা, দোক্কা, তেক্কা, চৌকা, পাঞ্জা, ছক্কা ইত্যাদি। খেলোয়াড় ঘরগুলো অতিক্রম করার সময় দমবন্ধ করে অবিরাম কিৎকিৎ শব্দ করতে থাকে এবং এক পা দিয়ে খোলাকুচি ঠেলে এক ঘর থেকে আর এক ঘরে নিয়ে যায়। এভাবে সব ঘর অতিক্রম করা শেষ হলে খেলোয়াড় ঘরগুলোর দিকে পেছন ফিরে খোলাকুচিটাকে মাথার ওপর দিয়ে পেছনে ছুড়ে মারে। খোলাকুচি যে ঘরে পড়ে, সেটি তার ‘কেনা’ ঘর হয়ে যায় এবং সেই ঘরে খেলোয়াড় দুপা ফেলে বিশ্রাম নিতে পারে। এভাবে যেসব ঘর ‘কিনে’ নিতে পারে তারই জয় হয়।

ড. ওয়াকিল আহমেদ বলেছেন, ‘নারী নীড়াশ্রয়ী। মানব সভ্যতার ইতিহাসে নারীই পুরুষদের ঘর বাঁধার প্রেরণা দিয়েছে। ঘর দখল এবং ঘর-কন্নায় নারীর ভূমিকা আজও সক্রিয়। সুতরাং এক্কা-দোক্কায় প্রাচীন সংস্কারের ও অভ্যাসের পরিচয় থাকতে পারে।’ কিন্তু খেলাটির ক্ষেত্রে এই সরলীকরণ মেনে নেয়া যায় না। সমাজে কৃষি ব্যবস্থার গোরাপত্তন ঘটিয়েছিল নারী এবং কৃষিব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে সমাজে যখন নানা শ্রেণি গড়ে উঠল এবং রাষ্ট্রের জন্ম নিল, তখনই নারী তাদের অবস্থান হারাতে শুরু করল। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস প্রায় শতাব্দীকাল আগেই একে বলেছেন ‘স্ত্রী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয়’।

এক সময় যে নারীরা ছিলেন পুরুষের সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অংশীদার, পরবর্তীকালে তারাই অধীন ও পরনির্ভরশীল হিসেবে বিবেচিত হতে লাগলেন! তবে সব সমাজে এবং একই সমাজের সব শ্রেণিতে এই অধীনতা একইরকম ছিল না। এভাবে একসময় নারীর নিজস্ব মতামত দেয়ার অধিকার যেমন হরণ করা হলো, তেমনি হরণ করা হলো সম্পদের অধিকার। তার চারপাশে জমি আছে অথচ সেই জমিতে তার বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ এই জমিগুলোর মালিকানা তার নয়। তাকে সেই জমিতে পা ফেলতে হলে সাবধানে, সংকোচের সঙ্গে পা ফেলতে হয়। নারীর ক্ষেত্রেই কেবল এই অধিকার হরণ করা হয়েছিল এমন নয়। সামন্তযুগে চাষিদের ক্ষেত্রে ভূমির অধিকার এভাবেই খর্ব করা হয়েছিল।

চাষযোগ্য ভূমি বিক্রি করা, বন্ধক দেওয়া, বিভক্ত করার কোনো অধিকার চাষিদের ছিল না। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাবান ভূস্বামীরা দুর্বল অসহায় কৃষকদের ভূমি-সংক্রান্ত অধিকারগুলো ভোগ করতে না দিয়ে তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলত। এমনকি পুকুর, কুয়া ইত্যাদিতেও অস্পৃশ্যদের কোনো অধিকারই ছিল না। ফলে সে একা বা একঘরে হয়ে যেত। বাংলা এক শব্দটি প্রাকৃত এক্ক শব্দ থেকে এসেছে। হিন্দিতে এক্কা শব্দে অর্থ হচ্ছে- একা চরে এমন পশু বা পাখি। গুজরাটি ভাষায় এক্কো শব্দের অর্থ হচ্ছে- এক বলদে টানে এমন গাড়ি।

এ খেলায় এক পা তুলে চলার যে সিম্বল তা মূলত ভূমির অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার ফলে ব্যক্তির অস্বাভাবিক জীবন টেনে নিয়ে যাওয়া বলদের সঙ্গেই তুলনীয়। এক্কা দোক্কার খোলাকুচি বা চাড়াটাও একটা সিম্বল। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ এর অর্থ করা হয়েছে ঘটাদির ভগ্ন অংশ, মাথার খুলি, খাপরা। অনেক সময় গ্রাম্যভাষায় ভাগ্যহীনতাকে ভাঙা কপাল বলেও উল্লেখ করতে দেখা যায়। অর্থাৎ এই খেলার মধ্যে ভাগ্যবিড়ম্বিত একজন মানুষকে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে আমরা দেখতে পাই। অসহায় অস্পৃশ্য মানুষ এক পা তুলে নিজের অবশিষ্ট বা ভগ্ন ভাগ্যরূপ চাড়াটা নিয়ে সব কটি ঘর একদমে পার হতে পারলেই যে সে জমির মালিক হবে তা নয়। তাকে পিছনে না ফিরে খোলাকুচিটাকে ছক কাটা ঘরের দিকে ফেলতে হয়, এ কাজটাও তাকে অদৃষ্টের ওপর নির্ভর করেই করতে হয়। সে নিজের ওপর আস্থা রেখে পরিশ্রম করলেও যে সুফল পাবে এমন নয়। শেষ পর্যন্ত তার হাসিটা নির্ভর করে ভাগ্যের ওপরই। আর বলার অপেক্ষা রাখে না সামন্তযুগে রাজা বা ব্রাহ্মণরা প্রজাদের ভাগ্য নিয়ন্তা ছিলেন। চাষিদের কাজে খুশি হয়ে তারা অনুদান হিসেবে সামান্য জমি দিয়ে দিতে পারতেন। এই করুণা সব সময় সকলের ভাগ্যে জুটত না। ভাগ্যের চাড়া তাদের ঘরে না পড়ে বাইরে গিয়ে পড়ত!

কাজেই অসহায় চাষিদের জীবনের এই খেলাটাই সামন্তযুগে জুয়া ছাড়া কিছুই ছিল না! শব্দটির উপস্থিতি পাই খেলোয়াড়ের অনবরত কিৎকিৎ বলতে থাকা শব্দের মধ্যে। কিৎ শব্দটি মূলত একটি ধাতু। এর অর্থে বলা হয়েছে, করার ইচ্ছা করে যে অর্থাৎ কোনো কিছু করার ইচ্ছা যার মধ্যে চালিত হয়। এই ধাতুযোগে নিষ্পন্ন শব্দ হচ্ছে কিতব। বঙ্গীয় শব্দকোষে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, বঞ্চিত করার ইচ্ছা বা কিৎ পোষণকারীরা হচ্ছে কিতব বা জুয়াড়ি। এই কিতবের মধ্যে অন্যকে টপকে যাওয়ার বা হারিয়ে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা লক্ষ্য করা যায়। আবার কিৎ ধাতু নিষ্পন্ন একটি শব্দ হচ্ছে, ‘কেত’ যার অর্থ আশ্রয়। তার অর্থ হচ্ছে কিৎকিৎ উচ্চারণকারী খেলোয়াড়ের কিৎ বা ইচ্ছা যেখানে স্থিতি বা আশ্রয় লাভ করে সেটাই হচ্ছে তার আশ্রয় বা কেত। এই একই ধারাবাহিকতায় যিনি রোগকে হঠিয়ে দিতে চান, তাকে বলা হয় চিকিৎসক। এক্কা-দোক্কা খেলায় খেলোয়াড় নিজের অক্ষমতাকে হারিয়ে দিতে চায় বলে খোলাকুচিকে পায়ে ঠেলে ঠেলে কিৎকিৎ শব্দ তুলে প্রতিপক্ষের ঘরকে টপকে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। এই খেলোয়াড় নিজের জন্য একটি আশ্রয় খোঁজ করে বলে সে কিৎকিৎ শব্দকে মন্ত্রের মতো উচ্চারণ কওর যায়। যারা তাকে বঞ্চিত করেছে, তাদের হটিয়ে দিয়ে সে তার নিজের আসনটি অধিকার করতে চায়। এই আকাঙ্ক্ষার ভেতর কিৎকিৎ শব্দটি জাদুকরী শব্দ হিসেবেই কাজ করে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ