কেএনএফকে নির্মূল করতে হবে এখনই
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে, আমার জন্মভূমি।’ দেশাত্মবোধক এই গান গেয়ে আমরা আবেগে আপ্লুত হই; কিন্তু সত্যিই কি বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ, সত্যিই কি বাংলাদেশ সব দেশের রানী। নিরপেক্ষ বিচারে এই দাবিটি হয়তো সত্যি নয়; কিন্তু আমাদের আবেগের কাছে ভেসে যায় সব বাস্তবতা। আমার দেশকেই আমার চোখে সবচেয়ে সুন্দর লাগে। সৌন্দর্যটা সবসময়ই আপেক্ষিক। তবে বাস্তবতা মানলেও বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা পার্বত্য এলাকা। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান- এই তিন জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য এলাকায় লুকিয়ে আছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য। কাপ্তাই লেক আর বিস্তীর্ণ পাহাড়েই লুকিয়ে আছে সৌন্দর্য্য। যদিও কাপ্তাই লেকের পানিতে ডুবে আছে অনেক হাহাকার। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাঁধ দেয়ায় সৃষ্টি হয়েছে এই লেকের। তাতে তলিয়ে গেছে অনেক ইতিহাস, অনেক মানুষের বাস। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অক্লান্ত চেষ্টায় বদলে গেছে পাহাড়ের চেহারা। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে পাহাড়ের মোহনীয় রূপ আরও খোলতাই হয়েছে।
কিন্তু পার্বত্য এলাকার এই সৌন্দর্য্য অনেকটাই অদেখা থেকে যায় অস্ত্রের ঝনঝনানির কারণে। বিদেশি পর্যটকরা তো বটেই, এমনকি দেশের অনেকেও ভয়ে পার্বত্য এলাকায় যেতে ভয় পান। এক সময় বাবার চাকরির সুবাদে আমাদের বাসা ছিল রাঙামাটিতে। আমরা গোসল করতাম কাপ্তাই লেকে। তখনও পাহাড় ছিল অনেকটাই দুর্গম। গত কয়েক বছরে পাহাড় অনেকটাই সুগম হয়েছে। আবিষ্কার হয়েছে নতুন নতুন পর্যটন এলাকা। সাজেক তো এখন পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় গন্তব্য। পাহাড়ের পর্যটনই হতে পারতো আমাদের আয়ের বড় উৎস; কিন্তু ওই যে বললাম অস্ত্রের ভয়ে মানুষ পাহাড়ে যেতে চান না। একসময় শান্তিবাহিনী পাহাড়কে অশান্ত করে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ শুরুতেই পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়ার অভিযোগ আছে বটে, তবে শান্তি চুক্তির পথ ধরেই পাহাড়ের বদলে যাওয়ার শুরু। চুক্তি হলেও পাহাড়ে শান্তি পুরোপুরি ফেরেনি। নানা নামে ছোট ছোট বিভিন্ন সংগঠন পাহাড়ে অস্ত্রের মহড়া চালিয়ে গেছে নিজেদের স্বার্থে।
তবে গত সপ্তাহে বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেএনএফের সন্ত্রাসী তৎপরতা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। পাহাড়ে টুকটাক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী থাকলেও অনেকদিন এমন বেপরোয়া তৎপরতা দেখা যায়নি। পরপর তিনটি ব্যাংকে হামলা, থানায় ও ফাঁড়িতে হামলা শঙ্কিত করেছে অনেককেই। বছর দুয়েক ধরে কেএনএফের তৎপরতা আলোচনায় আসে। তবে তারা সংগঠিত হচ্ছিল আরও আগে থেকেই। নাথান বম নামে এক বম যুবকের প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের স্নাতক নাথান বম পড়াশোনা শেষে নিজ এলাকায় ফিরে যান। সেখানে তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরির চেষ্টা করেন; কিন্তু তার বদলে চাকরি পান চাকমা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। এ ঘটনা তাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। পরে নাথান বম একটি রিসোর্ট গড়ে পর্যটন ব্যবসায় নামেন। সে ব্যবসায়ও ধস নামলে তিনি কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিএ) নামে একটি এনজিও গড়ে তোলেন। সে এনজিওর অর্থায়ন নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেএনডিএ থেকেই পরে কেএনএফের জন্ম।
কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন; কিন্তু তার মনোনয়নপত্র বৈধতা পায়নি। ২০২২ সাল থেকে কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতা শুরু হয়। তারপর থেকেই এর নেতারা আড়ালে চলে যায়। রুমা-থানচিতে সর্বশেষ হামলার আগেও গত দুই বছরে কেএনএফ অন্তত ৯টি বড় ধরনের সংঘাতে জড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘাতে বেশ কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন। ছোটখাটো হামলা, চাঁদাবাজির অভিযোগও আছে কেএনএফের বিরুদ্ধে। তবে ২০২২ সালে পাহাড়ে কেএনএফের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের খবর উদ্বিগ্ন করে সরকারকে। জানা গেছে, অর্থের বিনিময়ে জঙ্গিদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিত। কেএনএফের সদস্যরা মিয়ানমারে প্রশিক্ষণ পেয়েছে বলে দাবি করে।
এটা ঠিক, পাহাড়ের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ মূলধারার জনগোষ্ঠীর চেয়ে কিছুটা অবহেলিত। তবে আদিবাসীদের মধ্যেও রয়েছে বৈষম্য। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমারা সবচেয়ে অগ্রসর। এ ছাড়া অন্য আরও জাতি গোষ্ঠী রয়েছে, যারা প্রান্তের মধ্যেও প্রান্তিক। চাকরির লড়াইয়ে চাকমা প্রতিযোগীর কাছে হেরে যাওয়ার ক্ষোভ থেকেই কেএনএফের ভাবনা আসে নাথান বমের মাথায়। ব্যক্তিগত বঞ্চনা থেকেই তিনি সামনে আনেন কুকি চিন জাতীয়তাবাদের ধারণা। ২০২২ সালের গোড়ার দিকে কেএনএফের নাম নজরে আসে, আসতে থাকে তাদের নানা তৎপরতার খবর। প্রথমে ফেসবুকে পেজ খুলে এই গোষ্ঠী তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। কেএনএফ দাবি করে তারা রাঙামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি- এই ছয় জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে। তারা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম- এই ৯টি উপজেলা নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবি করে। নিজেদের ফেসবুকে পেজে তারা তাদের কল্পিত সেই ‘রাজ্যের’ মানচিত্রও প্রকাশ করে।
উদ্বিগ্ন সরকার কেএনএফের সঙ্গে আলোচনাও শুরু করে। গত ৫ মার্চও শান্তি আলোচনায় অংশ নেয় কেএনএফ। তাদের সঙ্গে পরবর্তী আলোচনা হওয়ার কথা ছিল আগামী ২২ এপ্রিল; কিন্তু তার আগেই রুমা ও থানচিতে কেএনএফের বেপরোয়া সশস্ত্র হামলা পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে। শান্তি প্রক্রিয়ার উদ্যোক্তারাও আর আলোচনা এগিয়ে নিতে চান না।
এমনিতে মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই সময়ে কেএনএফের এই তৎপরতা উদ্বেগ আরও বাড়াবে। কারণ কেএনএফের সঙ্গে মিয়ামনারের কু কিন জাতিগোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারা প্রশিক্ষণও নিয়েছে মিয়ানামারে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও দাবি করেছেন কেএনএফের সঙ্গে দেশের বাইরের সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ রয়েছে। দেশের বাইরের সন্ত্রাসী আর দেশের ভেতরের জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ কেএনএফ নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানো কেএনএফকে সমূলে বিনাশ করার এখনই সময়।
রুমা ও থানচির বেপরোয়া সন্ত্রাসী হামলায় কেএনএফ আসলে নিজেদের বৃহত্তর আঙ্গিকে জানান দিতে চেয়েছে। সবাইকে নিজেদের সক্ষমতা দেখাতে চেয়েছে। তবে আমার ধারণা, এর মাধ্যমে কেএনএফ নিজেদের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামাল বান্দরবান সফর করে কেএনএফের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা দিয়েছেন। সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদও সন্ত্রাসী নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত সমন্বিত অভিযানের ঘোষণা দিয়েছেন। অভিযান এখনো চলছে।
জনগণের সমর্থন না পেলে কোনো সংগঠনই টিকতে পারে না। ছয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের দাবি করলেও পাহাড়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের কোনো সমর্থন বা গ্রহণযোগ্যতা নেই। বরং এই জনগোষ্ঠীর মানুষই নাথান বমের সশস্ত্র তৎপরতাকে সমর্থন করছেন না। বরং কেএনএফের তৎপরতায় পাহাড় আবার অশান্ত হলে তাদের রুটি-রুজতে টান পড়বে। পর্যটন বন্ধ হয়ে যাবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে অনেকের হয়রানি হবে। তাই তারাও কেএনএফকে সমর্থন করছেন না। পাহাড়ে যেভাবে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে, তা বজায় রাখতে দরকার শান্তি ও স্থিতিশীলতা।
একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলা আমাদের সবারই আকাঙ্ক্ষা; কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষ এখনো পূরণ হয়নি। বৈষম্য আছে, বঞ্চনা আছে। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়, দাবি-দাওয়া নিয়েও কথা হয়; কিন্তু আপনি একটি দেশের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করবেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করবেন। তারা নিশ্চয়ই বসে থাকবে না। আমরা চাই বিকাশের আগেই যেন কেএনএফকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে দেয়া হয়। একটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই।
লেখক: কলামিস্ট ও হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে