Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

টঙ্ক আন্দোলনের কুমুদিনী হাজং

Zeauddin Ahmed

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বুধবার, ২৭ মার্চ ২০২৪

লে গেলেন ব্রিটিশ শাসনামলে সংঘটিত ঐতিহাসিক টঙ্ক আন্দোলনের হাজং সম্প্রদায়ের নেত্রী কুমুদিনী হাজং। ১০২ বছর বয়সে তার নিজ বাড়ি নেত্রকোনায় মারা যান তিনি। জমিদারের অন্যায্য খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন এই কুমুদিনী হাজং। সেই সময়ে ব্রিটিশ ও জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াকু হাজংদের মধ্যে কেবল কুমুদিনী হাজং কালের সাক্ষী হয়ে এতদিন বেঁচে ছিলেন। তিনিও চলে গেলেন। নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে বহেরাতলী গ্রামে কুমুদিনী হাজংয়ের জন্ম। বহেরাতলী গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় কুমুদিনী হাজং কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি; কিন্তু তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এবং নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে কমরেড মণি সিংহের স্মৃতি জাদুঘরের উদ্বোধন করেন।

বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের পাদদেশে হাজং আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। সুসং দুর্গাপুর জমিদারের প্রজা ছিল হাজং সম্প্রদায়। টঙ্ক বা ধানকাবারি খাজনা ছিল এমন একটি প্রথা, যার আওতায় ফসল হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান-খাজনা জমিদারকে দিতে হতো। এই প্রথায় উৎপাদিত ফসলের পরিমাণের ওপর নয়, বরাদ্দকৃত জমির পরিমাণের ভিত্তিতে খাজনা নির্ধারিত হতো; প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল মার খেলেও জোর করে খাজনা আদায় করা হতো, তাই টঙ্ক প্রথা হাজং কৃষকদের দরিদ্র ও নিঃস্ব করে তোলে। অথচ হাজংরা এক সময় খাজনা মুক্ত জমি চাষের সুযোগ পেয়েছিল, বিনিময়ে শুধু বন্য হাতি ধরে জমিদারকে দিয়ে দিতে হতো। জমিদার সেই হাতি বেশি দামে অন্য জমিদারের কাছে বিক্রি করতেন। ‘গারো হিলস অ্যাক্ট-১৮৬৯’ পাস হওয়ার পর জমির মালিকানা চলে যায় ইংরেজদের হাতে এবং এতে হাজংরা বিনা খাজনায় জমি চাষের সুযোগ হারায়।

কৃষিই ছিল হাজংদের প্রধান পেশা; তাই তারা নিজেদের স্বার্থেই টঙ্ক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিল। অন্যদিকে সুসং দুর্গাপুর জমিদারের ভাগ্নে হচ্ছেন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মনি সিংহ। ১৯৩৭ সালে কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বে সূচিত এই টঙ্ক আন্দোলন ছিল স্থানীয় জমিদারের বিরুদ্ধে। এই আন্দোলনে কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজং সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। হাজংদের নিয়ন্ত্রণে রেখে অ্যাক্টিভিস্টদের শায়েস্তা করতে ১৯৪৬ সনে দুর্গাপুর থানার বিরিশিরিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এই ক্যাম্প স্থাপনের পর টঙ্ক প্রথাবিরোধী হাজংরা প্রতিদিন ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর অত্যাচারের শিকার হতো। ১৯৪৬ সনের ৩১ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকারের সশস্ত্র সেনারা কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বরকে ধরতে তার বাড়িতে হানা দেয়। লংকেশ্বর হাজং ও তার ভাইদের ধরতে না পেরে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর সশস্ত্র সেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং লংকেশ্বর হাজংয়ের পরিবর্তে তার নববিবাহিতা স্ত্রী কুমুদিনী হাজংকে জোর করে টেনেহিঁছড়ে দুর্গাপুর সেনাছাউনির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এই খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে টঙ্ক আন্দোলনের আরেক নেত্রী রাশমনি হাজং শতাধিক নারী পুরুষসহ দেশীয় দা, কুড়াল, বল্লম, লাঠি, তীর, ধনুক নিয়ে কুমুদিনীকে ছাড়িয়ে আনতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

এমন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে সশস্ত্র সেনারা রাশিমণি হাজং এবং সুরেন্দ্র হাজংকে গুলি করে হত্যা করে। দুই সহযোদ্ধাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে ঘটনায় উপস্থিত হাজং নারী-পুরুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সশস্ত্র সেনাদের ওপর বল্লম ও রামদা দিয়ে হামলা চালায়। হাজংদের এই হামলায় ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর দুজন সেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। হামলায় হতবুদ্ধি হয়ে সেনারা কুমুদিনী হাজংকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে; কিন্তু পরদিন ব্রিটিশ সেনারা কুমুদিনী হাজং ও রাশিমণিদের বহেরাতলী গ্রামে এসে সব তছনছ করে তাণ্ডব চালালেও অ্যাক্টিভিস্ট কাউকে খুঁজে পায়নি। ঘটনার কিছু দিন পর রাশিমণির স্বামী পাঞ্জি স্ত্রীর শোকে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

অন্যদিকে সংজ্ঞাহীন কুমুদিনী হাজংকে নেওয়া হয় কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহের পাহাড়ঘেরা গোপন আস্তানায়। ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর আগমন বার্তা পেয়ে কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী ও ভাশুররা আগেই মণি সিংহের আস্তানায় এসে অবস্থান নিয়েছিল। বহেরাতলী গ্রামে হাজংদের সশস্ত্র আক্রমণে দুজন সেনা মারা যাওয়ায় সরকার বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করে এবং মামলায় কমরেড মণি সিংহ, কুমুদিনী হাজংসহ অ্যাক্টিভিস্ট হাজংদের আসামি করা হয়। সেনাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে কুমুদিনী হাজং ফেরারি জীবনে ‘সরস্বতী’ নাম ধারণ করেন। নিপীড়িত মানবতার জন্য আত্মবিসর্জন দিয়ে রাশমণি হাজং হয়ে যান হাজং সম্প্রদায়ের ‘হাজং মাতা’, আর কুমুদিনী হাজং হয়ে ওঠেন টঙ্ক আন্দোলনের মহান নেত্রী। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৫০ সনে পূর্ববঙ্গে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হলে এই নির্মম প্রথার বিলোপ হয়। লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে শুধু রাজা-বাদশাহর অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের কাহিনি পড়েছি, শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের আত্মত্যাগের বর্ণনা না থাকায় প্রকৃত ইতিহাস আমাদের অজ্ঞাত থেকে গেছে। এখনো যে ইতিহাস চর্চা হয়, তাতে গ্রামাঞ্চলের অচ্ছ্যুত মানুষদের কথা ওঠে আসে না। কুমুদিনী হাজং না মরলে তার সংগ্রামী জীবন বা রাশিমণি হাজং ও সুরেন্দ্র হাজংয়ের গুলি খেয়ে মরার খবর বিস্মৃত হয়ে থেকে যেত।

ক্ষমতাবান ও শক্তিধর শোষকদের শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুগে যুগে কুমুদিনী হাজংরা লড়াই করে গেছেন, তাদের বিস্মৃত হয়ে শোষণ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সত্যি অসম্ভব। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি পাকিস্তানের শোষণ আর উলঙ্গ সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি থেকে নিষ্কৃত পাওয়ার প্রত্যাশায়। তাই একাত্তরে আমাদের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে পূর্বসূরি রাশিমণি হাজং বা কুমিদিনী হাজংয়ের আত্মত্যাগের ঋণ অস্বীকার করা যাবে না। ‘একুশে’ বা ‘স্বাধীনতা’ পদক দেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই সরকার মাঝে মাঝে উপযুক্ত লোক খুঁজে বেড়ায় দাসানুদাস মনোবৃত্তির পদলেহী বিদগ্ধজনদের মধ্যে। উপযুক্ত লোকের অভাবে একই লোককে সব পদকে ভুষিত করে বর্তমানে পদকের শ্রাদ্ধ করা হচ্ছে। ব্রিটিশ শাসন এবং জমিদারদের অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা লড়তে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকা অপরিহার্য। সংগ্রামী নারী ফুলো মুর্মু, ঝানো মুর্মু, ইলা মিত্র, লীলা নাগ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বীণা দাস, মাজেরা, জামিলা, মাতঙ্গিনী হাজরা ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। এরা আমাদের ‘জাতীয় প্রতীক’ না হলেও এখনো নবীনদের আন্দোলন সংগ্রামের প্রেরণা।

বাংলার তৎকালীন গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে যিনি গুলি ছুড়েছিলেন, সেই বীণা দাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোর রোডে গড়ে ওঠা একটি অস্থায়ী হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন, সারা কলকাতা ঘুরে ঘুরে ওষুধ সংগ্রহ করেছেন। লড়াই-সংগ্রামের জীবন্ত কিংবদন্তি কুমুদিনী হাজংও তার জীবদ্দশায় একুশে পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতে পারতেন। রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য, যারা পদক বা পুরস্কার পায় না, তারা অগণিত মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় চিরঞ্জীব হয়ে ওঠেন। টঙ্ক আন্দোলনের নেতা কুমুদিনী হাজংয়ের স্মৃতির প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা রইল।

লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ