Views Bangladesh Logo

ঐকমত্য তৈরি না হলে সংস্কার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে

ন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই সরকার একটি কঠিন সময়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। তবে তাদের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে ছাত্র-জনতা ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। এই সরকারের কাছ থেকে জনগণের প্রত্যাশার মাত্রা অনেক উচ্চ ছিল, যা পূরণ করা স্বভাবতই অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রশাসনে কিছুটা অদক্ষতা ও দুর্বলতা দেখা গেলেও, মূলত আগের সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সংস্থাগুলোকে পঙ্গু করে রেখে যাওয়ার প্রবণতার কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব প্রত্যাশা পূরণে পুরোপুরি সক্ষম হতে পারেনি।

অন্যদিকে, গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্বেগের কারণ হতে পারে এমন প্রাধান্যের বিষয়গুলোর সমাধান করতে না পারার ক্ষেত্রে এই সরকারের ব্যর্থতা খুবই হতাশাজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিটির সুপারিশসহ সংস্কার প্রতিবেদন প্রকাশের ফলে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এসব সংস্কার বাস্তবায়নের নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে সরকার। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান ছাত্র-জনতাকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, সেটি বাংলাদেশ বিনির্মাণে আশাবাদী করেছিল। বিশেষত শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এবং ছাত্র-জনতার খুনের প্রতিবাদে জুলাইয়ের শেষদিক থেকে সারা দেশে এক দফার দাবি ঘিরে সবাই যেভাবে এক ছাতার নিচে দাঁড়িয়েছিল, তা অভূতপূর্ব। তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু, হামলা, বিভিন্ন বাহিনীর নির্বিচার গুলির মুখে দাঁড়িয়েও যে ইস্পাতদৃঢ় অবস্থান ছাত্র-জনতা দেখিয়েছে, তা যে কোনো গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে চিরকালের উদাহরণ হয়ে থাকবে; কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও দেশত্যাগের পর রাজনীতির পুরোনো ধারা নতুন করে ফিরে আসতে দেখা গেল। বিভক্তি ও স্বার্থের রাজনীতি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

এ কথা সত্য, দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে; কিন্তু জুলাই-আগস্টে অগণিত জীবন অকালে হারানোর পরও সেই একই ধারায় দেশ চলতে দেখা দুঃখজনক। দেশকে দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে নিতে তাই সব পক্ষকেই বিচক্ষণতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত হতে দেখা গেছে। এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে সরকার কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এরই মধ্যে অনেক কমিশন সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে। বাকি সংস্কার প্রস্তাব জমা হওয়ার পথে। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সংস্কার বাস্তবায়ন ও নির্বাচন আয়োজন করতে হবে সরকারকে। সে ক্ষেত্রে ঐকমত্য তৈরি না হলে সংস্কার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। নিত্যনতুন চিন্তা-পদ্ধতি বেরিয়ে আসবে, সেই সঙ্গে পুরোনো ধারণাও বদলে যাবে। আওয়ামী শাসনামলে ভেঙে পড়া গণতান্ত্রিক সেতুটি পুনরায় নির্মাণ করতে হলে সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। যেমন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বলছে, গত দেড় দশকে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। যে কারণে তারা যে প্রস্তাব দিচ্ছে, সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। তারা বলেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার সেগুলো বাস্তবায়ন করবে; কিন্তু কথা হচ্ছে, দেশে এখন মোটাদাগে রাজনৈতিক শক্তি কারা? এই শক্তিগুলো ঐকমত্যে পৌঁছুতে পারবে কি? নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি দুটি বড় ধারায় বিভক্ত ছিল-বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। এখন চব্বিশের আগস্টের পরে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে বড় ধরনের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।

বর্তমানে আগামী নির্বাচনে দলটির অংশ নেওয়া বিষয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তাতে বলা যায়, আওয়ামী লীগের আগামী নির্বাচনে দলীয় পরিচয়ে অংশ নেয়া অনিশ্চিত। প্রত্যাশিত সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর যে ঐকমত্য দরকার, সেখানে আওয়ামী লীগের মতামত প্রয়োগের সুযোগ থাকছে না। তাহলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের জন্য অবশিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো দুটি মোটাদাগে বিভক্ত-বিএনপি ও জামায়াত। জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে কতটা পারফর্ম করতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এর বাইরে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চাইছে; কিন্তু এখনো আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ না করায় রাজনৈতিক শক্তি বলতে যা বোঝায়, সেভাবে এখনও দানা বাঁধতে পারেনি। এ ছাড়া আরও কিছু রাজনৈতিক দল ও জোট থাকলেও, তারা মোটাদাগে উল্লিখিত দুই ভাগে বিভক্ত। তাই প্রশ্ন আসছে, আগে সংস্কার নাকি নির্বাচন- এ নিয়ে রাজনৈতিক দল ও দেশবাসী এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে। এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি।

আবার সংস্কার বলতে ঠিক কতটুকু সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেটিও পরিষ্কার নয়। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রূপরেখা চাইছে। তারা বলছে, একমাত্র রাজনৈতিক সরকারের পক্ষেই দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। নির্বাচন না হলে দেশের সংকট-অনিশ্চয়তা কাটবে না। সংস্কারের ব্যাপারে কারও কোনো আপত্তি নেই। তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়া। নির্বাচিত সরকার ছাড়া জনগণের প্রত্যাশা আর কেউ পূরণ করতে পারবে না। সে জন্য প্রথমত, প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। পরে সেই সংস্কার অনুমোদন করা হবে। নির্বাচন যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল।

দেশের মানুষ বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। নির্বাচন সংস্কার কমিশন বলছে, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে বেশ কিছু প্রস্তাব তারা চূড়ান্ত করেছে। একটি ভালো নির্বাচন দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার মাপকাঠি। এ ছাড়া অন্যান্য কমিশনও যে প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে, তাতে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে? এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, চাইলেই বিএনপি কিংবা বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত উপেক্ষা করে সংস্কার বাস্তবায়ন করা এই মুহূর্তে সম্ভব না। যদি সরকার মনে করে, সব দলকে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছবে, সেটা যেমন অতীতে হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। পরিস্থিতি এমন হলে নির্বাচনের রোডম্যাপ বাস্তবায়নেও জটিলতা তৈরি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হবে তা অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে সামাল দেয়া কঠিন হবে বৈ কি।

আবার বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচিত সরকার দেখতে চায় বলে বিদেশি বন্ধু ও উন্নয়ন সহযোগী থেকেও প্রকাশ্যে তাগিদ পাওয়া যাচ্ছে। খাদ্য-বস্ত্রসহ অন্য অধিকারগুলোর মতো ভোট দেয়ার অধিকারও এক ধরনের নাগরিক অধিকার। সবার ওপরের দিকের নাগরিক অধিকারগুলোর একটি ভোট দেয়ার অধিকার। ভোটের অধিকার তাই অনেক বড় বিষয়। নির্বাচন বনাম সংস্কারের বিতর্ক এই মুহূর্তে শুভ বুদ্ধির লক্ষণ নয়। নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণাই পারে দেশকে স্থিতিশীল রাখতে। আমাদের দেশে নির্বাচনি ইতিহাসে নানা অনিয়ম এবং অস্থিতিশীলতা দেখা গেছে, যেমন ভোট কারচুপি, সহিংসতা এবং অপপ্রচার। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়া, এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা এবং নিয়মিত রাজনৈতিক সংলাপ জরুরি।

অন্যদিকে, অনেকে বলছেন, নির্বাচন দ্রুত আয়োজন করা উচিত। কেননা নির্বাচন একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, এবং এর মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে, নির্বাচন না হলে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে। আর যদি নির্বাচনের পরে সংস্কারের জন্য একটি নতুন সরকার আসে, তবে তারা আরও কার্যকরভাবে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। তবে মূল কথা হচ্ছে, আমাদের উভয় দিকের সমন্বয় জরুরি। নির্বাচন হতে হবে, তবে তা এমনভাবে আয়োজন করতে হবে যাতে নির্বাচনি সংস্কার নিশ্চিত করা যায়। তাই, কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার যেমন নির্বাচন কমিশনের শক্তিশালীকরণ, সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা, নির্বাচন আগে হওয়া সম্ভব নয়। তবে, নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এবং মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে।

জাতীয় নির্বাচন শুধু একটি নির্বাচন নয়, এটি জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধারের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা সরকারের এবং নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীল পদক্ষেপের মাধ্যমে সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ছিল একটি নতুন দিনের স্বপ্ন, যেখানে গণতান্ত্রিক ও সুশাসিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই বাংলাদেশ গড়ার জন্য এখনই সময় এসেছে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা এবং রোডম্যাপ প্রকাশের যা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী ও সফল জাতির ভিত্তি স্থাপন করবে। এটি কোনো বিলম্ব নয়, বরং একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ, যা দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের মূল বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে। যদিও সংস্কার ও নির্বাচন দুটিই জরুরি, তবে যেটি করলে দেশের ভবিষ্যৎ শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকে সেদিকেই মনোযোগ দিয়ে এগোতে হবে। পাশাপাশি এও ভাবতে হবে, অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচন কতটুকু ফলপ্রসূ হবে।

রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক।  

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ