লোকসভা নির্বাচনে কদর্য হয়ে উঠছে রাজনীতির ভাষা
এবারের লোকসভা ভোটে আমাদের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ যে ভাষায় কথা বলছেন, তা শুধু অশ্লীল, অশোভন নয়, অত্যন্ত কুৎসিত, কদর্য। অনেক বছর আগে দিল্লির খান মার্কেট থেকে একটি বই কিনেছিলাম- ‘ডিকশনারি অব স্ল্যাং’। গালাগালের অভিধান। আমাদের নেতা-নেত্রীদের কটূক্তি সে অভিধানে নেই। কারণ গালাগালের যেটুকু মাপকাঠি, আমাদের নীতি-নির্ণায়কেরা সেসবের অনেক ওপরে। ডিকশনারিতে গালাগাল আছে; কিন্তু এই বিদ্বজ্জনরা নতুন নতুন উদ্ভাবনী মেধায় যা প্রয়োগ করে চলেছেন, তা আভিধানিক শব্দে ধরা যায় না। এই ভদ্র মহাদয়-মহাদয়েরা স্রেফ গাল দিলে না হয় তা স্ল্যাং ডিকশনারিতে জায়গা পেত; কিন্তু তারা তো সব কুশলী রাজনীতিক। ফলে গালাগালের সঙ্গে নোংরা ধর্ম ও জাত-বিদ্বেষ মিলেমিশে যে ককটেল তৈরি হচ্ছে, তা আগের কোনো ইলেকশনে শুনেছি বলে মনে করতে পারছি না।
কুৎসিত ভাষা ব্যবহারে প্রতিযোগিতা হলে, দুঃখজনক হলেও সত্যি, প্রথম পুরস্কার পাবার দৌড়ে নিশ্চিত এগিয়ে থাকবেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। গিনেজ বুকে নাম না উঠলেও, নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে যে ভাষায় মোদিজি খিস্তি আউরে চলেছেন, তা আগে কখনো দেশের কোনো প্রধানমন্ত্রী বলা দূরের কথা, কল্পনাও বোধহয় করেননি, যা তিনি প্রকাশ্য-জনসভায় বলছেন, তা একমাত্র অতি উগ্র জাতীয়তাবাদী সিনেমাতে কখনো কখনো শোনা যায়। তাও সেন্সরশিপের কর্তারা যদি সংবেদনশীল ও ব্যক্তিত্বশালী হতেন, তাহলে আটকে যেত। নরেন্দ্র মোদির কাছাকাছি কুকথা বলার কম্পিটিশনে সামনের সারিতে থাকতে পারেন আমাদের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি তো শুনছি, কাগজেও পড়ছি যে, বিরোধীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখার নিদান দিচ্ছেন।
শাসক দলের প্রথম সারির নেতাদের ভাষা যদি চূড়ান্ত রকমের অশোভন হয়, তাহলে আন্দাজ করুন, তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের ভাষা নির্বাচনি জনসভায় ঠিক কী ধরনের হতে পারে।
আগেও নির্বাচন এলে বিরুদ্ধ পক্ষকে চোখা চোখা শব্দবাণে ভূপতিত করা হতো। কিছু কমন বিষয় ষাট-সত্তর দশকেও ছিল, এখনো আছে। সেই পুরাতন শত্রুটির নাম পাকিস্তান। যে সময়ের কথা বলছি, তখন চীনের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক ছিল ভারতের, আজ যেমনটা পাকিস্তানের সঙ্গে। ফলে কাউকে চীনপন্থি বলে চিহ্নিত করলে জনমনে তার বা তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করা সহজ ছিল। তখন বিজেপি বা সাবেক জনসংঘের রমরমা ছিল না। অন্তত পশ্চিমবঙ্গে বাম-কংগ্রেস সম্পর্কের প্রবল রেষারেষি ছিল। কংগ্রেসের দেয়াল লিখন ছিল- ‘চীনের তৈরি কাস্তে হাতুড়ি, পাকিস্তানের তারা, এরপরেও কি বলতে হবে দেশের শত্রু কারা!’
বোঝাই যায় যে, বাম কমিউনিস্টদের নির্বাচনি প্রতীক কাস্তে-হাতুড়ি-তারাকে ব্যঙ্গ করে বলা ওই ছড়া। এত বছর বাদে বিজেপির নেতাদের ভাষণে ফের পাকিস্তান ঘুরে ফিরে আসছে। মজা হচ্ছে, এখন কংগ্রেসের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে তাদের ‘পাকিস্তান প্রেম’ সন্দেহে। পাকিস্তানকে আক্রমণ করলে জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা সহজ হয়, এটা শাসকদের থিঙ্ক ট্যাঙ্কেরা জানে বলেই ইলেকশন এলেই পাকজুজু সামনে আসে।
ইদানীং অবশ্য ভোট এলে বাংলাদেশকে নিয়েও টানাটানি হচ্ছে। ঘুষপেটিয়া শব্দ তো এখন বিজেপি নেতাদের প্রিয়। অভিযোগ করা হচ্ছে যে দলে দলে ঘুষপেটিয়া বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঢুকে পড়ছে। এই অনুপ্রবেশের কারণেই দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হচ্ছে। যদিও প্রশ্ন তোলাই যায়, বিষয়টি নিয়ে তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি সরকারি স্তরে কথা বলা হচ্ছে না কেন! তা ছাড়া সীমান্তে বিপুলসংখ্যক বিএসএফ পাহারা দেয়া সত্ত্বেও রোজ রোজ বাংলাদেশিরা ঢুকছে কীভাবে?
মুশকিল হচ্ছে আবেগের জোয়ারে চিরকালই দেশে দেশে যুক্তি কোণঠাসা অবস্থায় থাকে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ আবার মনে করছেন, এই অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহারের পেছনে ভোটে জেতার রাজনৈতিক রণকৌশল তো আছেই। সমর্থকদের চাঙ্গা করতে এরকম গালাগাল দিয়ে তাদের মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা। ভোট যেখানে যুদ্ধ। সেখানে নীতি নৈতিকতার জায়গা নেই। ছলেবলে কৌশলে ক্ষমতা দখল করতেই হবে। পাশাপাশি খারাপ খারাপ কথা বলে বিরোধীদের উত্তেজিত করে তাদের ভুল পথে চালিত করতে হবে। ঠিক যেমনটা আমরা শ্লেজিং করতে দেখি ক্রিকেট মাঠে। ফুটবল ও অন্যান্য খেলাতেও এরকম কুকথা বলে বিপক্ষ শিবিরের রণকৌশল ভেস্তে দেওয়ার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। তবে শাসক দলের বিরোধীদের গালাগাল করার পেছনে একধরনের স্বৈরাচারী মানসিকতাও আছে। সেটা নিছক রাজনৈতিক অপভাষা নয়, এ হচ্ছে পুরোপুরিভাবে হিটলারের নাৎসি কর্মকাণ্ডের কৌশল। হিটলার যেমন বৃহত্তর জার্মান জাতিকে উজ্জীবিত করতে জাতির কাল্পনিক শত্রু হিসেবে ইহুদিদের চিহ্নিত করেছিলেন। তার পরিণতি কী হয়েছিল তা সবাই জানেন। ভারতেও শাসকদলের অধিকাংশ নেতা ঠিক সেভাবেই ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন গণতন্ত্রপ্রিয় সাধারণ মানুষ।
অসংযত ভাষা শোনা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও। তবে নিঃসন্দেহে তুলনামূলকভাবে কম। যদিও একটি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের মুখে তা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। গালাগাল করার ক্ষেত্রে, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে অনেক পিছিয়ে বাম শিবির। পোস্টার, ফেস্টুন, স্লোগান সব ক্ষেত্রেই বামেরা অনেক নান্দনিক। এটা অবশ্য চিরকালই ঘটেছে। উৎপল দত্তের পথনাটক বা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা কিংবা পুর্ণেন্দু পত্রী, অমিতাভ দাশগুপ্ত, অসীম রায়, গোলাম কুদ্দুস, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, সমরেশ বসুর লেখা ছিল মহতী এক শিল্প। বামপন্থি রাজনীতির দেয়াল অলংকরণ, গ্রাফিতি এখনো চোখের সামনে ভাসে। সেই সময় হয়তো নেই। তবুও বামদের সঙ্গে দক্ষিণপন্থি রাজনীতির ভোট প্রচারের ধরনেও বিস্তর ফারাক।
মূল ফারাক দুই দর্শনের দ্বন্দ্ব। নব্য পুঁজিবাদের জগতে এখনো বামদের, ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না’ আওয়াজ গরিবকে ভাবায়। সারা দেশে ধর্মীয় মেরুকরণের তীব্র আবহাওয়া যখন জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে, যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং একটি সম্প্রদায়কে সরাসরি আক্রমণ করে ভারতের সংবিধানকে অগ্রাহ্য করছেন, তখন বামপন্থি রাজনীতির কুশীলবরা রাস্তায় রাস্তায় আওয়াজ তুলছেন, ‘হক রুটি রুজি, জনতাই পুঁজি’। করপোরেট বনাম জনতা এই দুই দ্বন্দ্বই এবার ভারতের ভোটের মুখ্য চালিকাশক্তি।
সৌমিত্র দস্তিদার: প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে