Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বড় আকারের ড্রাগন ফল অনিরাপদ নয়

Md. Zahidul  Islam

মো. জাহিদুল ইসলাম

সোমবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩

ড্রাগন ফল একদিকে পুষ্টিকর অন্যদিকে চাষাবাদে লাভজনক। তাই মাত্র ৯ বছরের ব্যবধানে ফলটির আবাদ বেড়েছে ১১৬ গুণ, উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪০০ গুণ। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া ফলটির বড় আকার নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয়েছে হরমোন বা টনিক ব্যবহারের কথা। নেতিবাচক আলোচনায় থাকা ফলটি সম্পর্কে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বড় আকারের ড্রাগন অনিরাপদ নয়।

তারা জানান, প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটরস হিসেবে ব্যবহৃত জিবরেলিক অ্যাসিড বা টনিক বিজ্ঞানসম্মত। ফলে স্বাস্থ্যহানির কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে দেশে উৎপাদিত ড্রাগন নিয়ে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণা করা উচিত। সেইসঙ্গে ড্রাগন আবাদে হরমোন বা টনিক ব্যবহারের মাত্রা নির্ধারণ করা উচিত বলেও মত তাদের।

জানা গেছে, বাংলাদেশে ব্যক্তি উদ্যোগে ড্রাগন চাষ শুরু হয় ২০১০ সালের পর। এরপর ২০১৪ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’ এর অধীনে বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন চাষ শুরু হয়। তথ্যমতে, দেশে সাধারণত বাউ ড্রাগন-১, বাউ ড্রাগন-২, বারি ড্রাগন-১, পিংক ড্রাগন, ভেলভেট ড্রাগন ও ইয়োলো ড্রাগন ফলের চাষ হয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি চাষ হয় গোলাপি ড্রাগন ও বাউ ড্রাগন-২।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ড্রাগন ফলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিজেন রয়েছে। এর মধ্যে ক্যালসিয়ামও থাকে ভালো পরিমাণে। যাদের বোন ডেনসিটি বা হাড়ের কোনো সমস্যা আছে তাদের শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণ করার জন্য ড্রাগন ফল অত্যন্ত উপকারী। বাচ্চাদের ভিটামিন এ এবং বিটা ক্যারোটিনের চাহিদা পূরণে ড্রাগন ফল দেয়া যেতে পারে। চোখের সমস্যা বা দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে শুধু বাচ্চাদেরই নয়, বড়দের শরীরেও ভিটামিন এ ও বিটা ক্যারোটিনের জোগান দেয় ড্রাগন ফল। ড্রাগন ফলে ভিটামিন বি ও থায়ামিনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। ড্রাগন ফলে যে ছোট ছোট সিডগুলো থাকে তাতে আছে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি, প্রোটিন। ড্রাগনে আয়রনও পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে। এ ছাড়া ড্রাগনে থাকে ফাইবারও। কোলনের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলস। এ ধরনের ক্ষেত্রে শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য ফাইবার অনেক বেশি দরকার হয়।

মাত্র ৯ বছরের ব্যবধানে দেশে ড্রাগনের আবাদ বেড়েছে ১১৬ গুণ ও উৎপাদন বেড়েছে ৩৯০ গুণ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ১৮ হেক্টর জমিতে ড্রাগন আবাদ হয়, উৎপাদন হয় ৬৬ টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৮ হেক্টর জমিতে আবাদের বিপরীতে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ২৭৭ টনে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৪ হেক্টর জমিতে ড্রাগনের আবাদ হয় এবং উৎপাদন হয় ৪৩১ টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০৮ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়ে ড্রাগনের উৎপাদন দাঁড়ায় ৮১৫ টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২২৭ হেক্টর জমিতে আবাদ হলেও উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৮০২ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৪১ হেক্টর জমিতে ড্রাগনের আবাদ হলে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪৬৪ টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৯৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগনের আবাদ হয় এবং উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৬৫৯ টনে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগনের আবাদ হয় এবং উৎপাদন হয় ১৩ হাজার ৮৭২ টন। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেকর্ড ২ হাজার ৯৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগনের আবাদ হয় এবং দেশে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ উৎপাদন ২৫ হাজার ৭৬০ টনে দাঁড়ায়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ড্রাগনের আবাদ ও উৎপাদন আরও বেড়েছে।

বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. মেহেদি মাসুদ ভিউজ বাংলাদেশেকে বলেন, ইদানিং ফল বড় করার জন্য কৃষকেরা হরমোন বা প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটরস ব্যবহার করছে। প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটরস হিসাবে যেগুলো ব্যবহার করা হয় তারমধ্যে বহুল প্রচলিত হচ্ছে জিবরেলিক অ্যাসিড, অক্সিজ, ইনডোল অ্যাসিডিক, এগুলো বিজ্ঞান কর্তৃক স্বীকৃত। আপেলে প্ল্যান্ট রেগুলেটর ব্যবহৃত হয়, জিএ-৩ ব্যবহৃত হয়, এতো আঙুর বাজারে দেখা যায়-এমন কোন আঙুর নেই যেখানে প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটরস ব্যবহার করা হয়নি। প্রত্যেকটি ফলে বড় বড় আঙুর, প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটরের ফল। প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটরস, বিশেষত জিবরেলিক অ্যাসিড বা জিবরেলিন এগুলো হচ্ছে অর্গানিক অ্যাসিড। এগুলো ফাঙ্গাস ও গাছের মধ্যে এমনিতে তৈরি হয়। যদি একটু এনডোস করা হয় একটু সাপোর্ট দেয়া হয়, তাহলে তার কার্যক্ষমতা বাড়ে। গাছের যে শরীর কোষ দিয়ে তৈরি, কোষের সেল ডিভিশন বেশি হয়। যেখানে শক্তির প্রয়োজন নেই, যেমন কাছের কাণ্ড ও পাতায় যে শক্তি তৈরি হয় সেই শক্তিটাকে যদি আমরা ফলের ভেতর নিয়ে আসি, ট্রান্সফার করে ফলের ভেতর নিয়ে আসি, তাহলে তো কোন সমস্যা নেই। প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটরসগুলো এই কাজটিই করে। এবং এতে স্বাস্থ্যহানির কোন সম্ভাবনা নেই। প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটরসের কোনো ক্ষতিকর প্রভাব থাকে না। যেহেতু এটি ন্যাচারাল ফাইটো হরমোনস এ জন্য এর কোনো ক্ষতি নেই। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপকার হতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, জিবরেলিক অ্যাসিড ব্যবহার না করলে খুব ভালো খাবার দিয়েও ৩৯২ গ্রাম হয়েছে, সেখানে জিবরেলিক অ্যাসিড ব্যবহারের ফলে (৪০ পিপিএম জিবরেলিক অ্যাসিড এবং ২০ পিপিএম নেপথেলিন এসিডিটিক অ্যাসিড) ৫৬২ গ্রাম হয়েছে। ৩৯২ থেকে ৫৬২ গ্রাম হলো, এটা কিন্তু জিবরেলিক এসিডের কারণে। ড্রাগন ফলের চারটি গ্রেড রয়েছে। সর্বনিম্ন গ্রেডে হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম, মিডিয়াম গ্রেড হচ্ছে ২৫১ থেকে ৩৫০ গ্রাম, লার্জ গ্রেড হচ্ছে ৩৫১ থেকে ৪৫০ গ্রাম এবং এক্সএল গ্রেড হচ্ছে ৪৫১ গ্রাম থেকে বেশি ওজনের। এক্সএল সাইজের ড্রাগন যদি কেউ উৎপাদন করতে চায় অবশ্যই তাকে হরমোন ব্যবহার করতে হবে, যা ফাইটো হরমোনস, ন্যাচারাল হরমোনস এবং প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটরস। এতে স্বাস্থ্যহানির কোনো সম্ভাবনা নেই।

২০১৪ সালে আরেকটি গবেষণা হয়েছে ড্রাগন ফলের ওপরে, যেটি হয়েছে মালয়েশিয়ায়। মালয়েশিয়া জার্নাল অব বায়োলজি এগ্রিকালচার অ্যান্ড হেলথ কেয়ার, এই জার্নালে দেখা গেছে যে ফলে জিএ-৩ ব্যবহার করেছে, জিএপি-৩ ৫০ পিপিএম ব্যবহার করেছে, যত পিপিএম ব্যবহার করা বেড়েছে ফলের আকার তত বেড়েছে।
এশিয়া মহাদেশের মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামে গবেষণায় ও জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদন তুলে ধরে ড. মো. মেহেদি মাসুদ বলেন, এটা একদম পরিষ্কার ড্রাগন ফলে প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটরস ব্যবহার করলে স্বাস্থ্যহানির কোনো শঙ্কা নেই। যে সমস্ত ইউটিউবার ড্রাগন ফলকে অজনপ্রিয় করার জন্য মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে, সেগুলো ঠিক নয়। আমি বলব এই অপবাদ থেকে তারা নিবৃত থাকুক।

কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের গবেষণায় ড্রাগন ফলে কীটনাশকের কোনো প্রভাব পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের গবেষণায় ড্রাগনে কোনো কীটনাশকের প্রভাব পাওয়া যায়নি। তবে হরমোনের প্রভাব নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। আমি বলব বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উচিত বাজারের বিভিন্ন জায়গা থেকে ড্রাগসের স্যাম্পল সংগ্রহ করে গবেষণা করে ক্ষতিকর কিছু আছে কি না, তা যাচাই করে দেখা।

এ প্রসঙ্গে জানতে জাইলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (ফল বিভাগ) ড. মো. উবায়দুল্লাহ কায়ছার ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ড্রাগনে এখন হরমোন ও টনিক দেয়া হচ্ছে। আমরা সেই কেমিক্যাল অ্যানালাইসিস করার উদ্যোগ নিচ্ছি। অনুমোদনবিহীন কেমিক্যাল বা টনিক এখন দেশের বাইরে থেকে আসছে। নজরে আসার পর আমরা কাজ করতে শুরু করেছি। ফলের সাইজ যেভাবে চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল কাইউম সরকার ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, এখন পর্যন্ত ড্রাগনে অনিরাপদ কিছু পাওয়া যায়নি।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ