বড় বড় প্যাভিলিয়ন হচ্ছে; কিন্তু বড় লেখকের সমাদর হচ্ছে না
কবি রাসেল আশেকী প্রায় তিন যুগ ধরে কবিতার নিমগ্ন সাধক। ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার কবিতার ভুবনে যাত্রা শুরু। সম্প্রতি তিনি এক মহাকাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছেন। কবিতা ছাড়াও তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক ও গান রচনা করেন। তার লেখালেখির ভাবনা নিয়ে কথা হলো ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কামরুল আহসান।
ভিউজ বাংলাদেশ: ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
রাসেল আশেকী: আমার তরফ থেকেও শুভেচ্ছা। যতটা দেখেছি ভিউজ বাংলাদেশ ভালো করছে। নতুন পোর্টাল হিসেবে ইতোমধ্যেই নাম করেছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: এবারের বইমেলায় আপনার কী বই প্রকাশিত হয়েছে?
রাসেল আশেকী: আমার মহাকাব্য সিরিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে- ‘বঙ্গবন্ধু, কোথায় লিখব মহাকাব্য?’
ভিউজ বাংলাদেশ: মহাকাব্য সিরিজ মানে?
রাসেল আশেকী: মহাকাব্য তো বিশাল গ্রন্থ আমরা জানি। মহাকাব্য লিখতে হলে অনেক সময়ের দরকার। অনেক কষ্টসাধ্য কাজ। আমি এটা সিরিজ আকারে লিখব। বাঙালি জাতির হাজারের বছরের চিন্তা, সংস্কৃতি, প্রজ্ঞা, স্পিরিট উঠে আসবে এই মহাকাব্যে। ছোট ছোট খণ্ড খণ্ড করে বের করতে চাই যেন মানুষও সহজে পড়তে পারে। ১১ খণ্ডে এটা সমাপ্ত হবে। তারপর পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্যরূপে প্রকাশিত হবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: প্রথম খণ্ড বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কেন?
রাসেল আশেকী: বঙ্গবন্ধুর ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে এই মহাকাব্য। সাধারণত অন্যান্য মহাকাব্যে দেখা যায় ট্র্যাজেডি শেষ পরিণতি; কিন্তু আমার মহাকাব্য শুরু হয়েছে ট্র্যাজেডি দিয়ে। এই ট্র্যাজেডি আমাদের জাতির জীবনের একটা শিক্ষা। কেউ যদি মানুষের জন্য কাজ করে, জাতির জন্য কাজ করে তাকে জীবন দানও করতে হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর জীবন দানের মধ্য দিয়ে একটা নতুন প্রজন্মের জন্ম হয়েছে, একটা শ্রেণির জন্ম হয়েছে। আমরা একটা নতুন জাতি উপহার পেয়েছি। এই ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে আমাদের নানা ধরণের অবক্ষয় ঘটে গেছে। বিরাট বিরাট অবক্ষয়। রাষ্ট্রীয় অবক্ষয়, সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। এই অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষাটা কী? আমাদের তো এই জাতিকে গড়ে তুলতে হবে। সুন্দর করতে হবে। কারা করবে? আমরা যারা এই ভূখণ্ডে বসবাস করি তারাই। এই স্পিরিট থেকে অসংখ্য চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে। এই চরিত্রগুলো চলমান। এইরকম একটা বিষয় নিয়েই আমার এই মহাকাব্য রচিত।
ভিউজ বাংলাদেশ: কেন লিখছেন এই মহাকাব্য?
রাসেল আশেকী: মহাকাব্য ছাড়া বড় জাতি তৈরি হয় না। কবিরা জাতিকে পথ দেখান। রাজনীতিবিদরা সেটা বাস্তবায়ন করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম না জন্মালে বঙ্গবন্ধু জন্মাতেন না। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশ অনেক সম্ভাবনময়। জনসংখ্যাকে সম্পদে রূপান্তর করতে হবে। জাতিকে স্বপ্ন দেখাতে হবে। বড় স্বপ্ন ছাড়া বড় কিছু হয় না। এই জাতিকে স্বপ্ন দেখানোর জন্যই এই মহাকাব্য রচনা করছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: এ পর্যন্ত আপনার প্রকাশিত কবিতার বই কয়টি?
রাসেল আশেকী: ২১টি। এর মধ্যে রয়েছে- ‘প্রেমিক এসেছি ফিরে’, ‘বইকন্যা সশব্দ পুরুষ’, ‘লালঘোড়া নীলঘোড়া’, ‘প্রেমভূমি’, ‘প্রেম ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই’, ‘একটি ভাষণ একটি দেশ’, ‘ভালোবাসার সিলমোহর’।
ভিউজ বাংলাদেশ: কবিতা ছাড়া আপনি আর কী লিখেন?
রাসেল আশেকী: কবিতা ছাড়া আমি গান-গল্প-নাটক-উপন্যাস লিখি। আমার গল্প-উপন্যাস নিয়ে নাটকও নির্মিত হয়েছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার লেখালেখির শুরুর কথা একটু জানতে চাই।
রাসেল আশেকী: আমার লেখালেখির শুরু নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। ১৯৮৮ সালে আমি এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম; কিন্তু আমি পরীক্ষা দিতে পারিনি। আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম। আমার জেলার অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলাম। পরীক্ষার আগের দিনই আমাদের হল থেকে বের করে দিল এরশাদের বাহিনী। তখন ঢাকা শহরে থাকা আমার জন্য কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল। কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিল না ঢাকায়। একটা মার্কেটে আমি রাত কাটাই। ওই বছর আমি আর পরীক্ষা দিতে পারিনি। পরীক্ষা দিতে গিয়ে আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাই। তখনই আমি শপথ নিয়েছিলাম, স্বৈরাচরী সরকারের পতন না ঘটিয়ে আমি আর লেখাপড়া করব না। কবি শামসুর রাহমান, সুফিয়া কামালের আহ্বানে আমিও আন্দোলনে শরিক হলাম। তখন ‘বিদগ্ধ মানচিত্র’ নামে আমি একটা দীর্ঘ কবিতা লিখি। ছয় মাস লাগে কবিতাটা লিখতে। যতটুকু লেখা হত ততটুকু আমি মঞ্চে আবৃত্তি করতাম। কবিতাটা লেখা শেষ হয় ১৯৯০ সালের ১ ডিসেম্বর, তখন আমি কবি শামসুর রাহমানকে বললাম, আমার কবিতা শেষ, এবার এরশাদের পতন হবে। ঠিক পাঁচ দিন পর, ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন হলো। এরশাদ-পতনের পর টিএসএসসিতে লাখ লাখ জনতার সামনে আমি এই কবিতাটি আবৃত্তি করি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার লেখালেখির মূল অনুপ্রেরণা কী?
রাসেল আশেকী: অন্তরের প্রেরণাই বড় প্রেরণা। মানবকল্যাণই আমার লেখালেখির উদ্দেশ্য। মানুষের জন্য নিরন্তর সংগ্রামই আমার কলমের শক্তি।
ভিউজ বাংলাদেশ: এত বছরের লেখালেখি থেকে আপনার আত্মতৃপ্তি, হতাশা বা ক্ষোভের জায়গাগুলো কীরকম?
রাসেল আশেকী: এখানে হতাশা বা ক্ষোভ বা আত্মতৃপ্তির কোনো জায়গা নাই। এখানে আছে কেবল প্রেম। প্রেম ছাড়া কোনো জায়গা নেই। লেখালেখি খুব সংগ্রামের বিষয়। প্রেম ছাড়া এটা করা যায় না। মানবজাতির জন্য আমার যে-প্রেম তাই আমার লেখালেখির প্রতি ঢেলে দিয়েছি। আমি কতটুকু দিতে পারলাম এটাই আমার চিন্তা। কে আমাকে কী দিল এটা বড় বিষয় না।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার নিজস্ব পাঠকগোষ্ঠী আছে বলে মনে করেন?
রাসেল আশেকী: অবশ্যই পেরেছি। আমি যতদূর গেছি ততদূর পাঠক আমার সঙ্গে গেছে। ততদূর সাহসী মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। এক সময় আমার বই হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। নিজস্ব পাঠকগোষ্ঠী না থাকলে এতদিন আমি টিকে থাকতে পারতাম না।
ভিউজ বাংলাদেশ: বইমেলা প্রায় শেষ হতে চলল। কেমন লাগল এবারের বইমেলা?
রাসেল আশেকী: এখন আমার মনে হচ্ছে, বইমেলাটা আগে যেমন সৃজনশীলতার জায়গা ছিল সে জায়গায় নেই। এখন বিপণন প্রতিযোগিতার পরিণত হয়েছে। বড় বড় প্যাভিলিয়ন হচ্ছে; কিন্তু বড় লেখকের সমাদর হচ্ছে না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে