Views Bangladesh Logo

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক: আইনের ব্যর্থতা ঘটলে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়

২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। ২০১১ সালের ১৭ মে তিনি অবসরে যান। ২০১৩ সালে তাকে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। তারপর থেকে তিন মেয়াদে তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার হাত ধরেই পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত হয়েছিলো, বাতিল হয়েছিলো বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। নানা ঐতিহাসিক মামলায় রায় দিয়ে তিনি বহুল আলোচিত। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির দায়িত্ব পালনকালে এ বি এম খায়রুল হক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা, স্বাধীনতার ঘোষক, রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার স্মৃতি সংরক্ষণ, ঢাকার চার প্রধান নদী রক্ষা, ঢাকার ট্যানারি স্থানান্তর এবং আপিল বিভাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ফতোয়াসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দিয়েছেন।
দেশের বিচার ব্যাবস্থা নিয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন ভিউজ বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হিরা তালুকদার

ভিউজ বাংলাদেশ : দেশে প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি মামলা বিচারাধীন। এই জট কমানোর উপায় কি?
এবিএম খায়রুল হক: বিচারিক আদালতে বিচারকের সংখ্যা অনেক কম। দ্রুত পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। অন্যদিকে হাইকোর্টের বিচারকদের উচিত হবে, যে কোনো রুল ইস্যুর আগে আবেদনটির অন্তত ৫০ শতাংশ মেরিট আছে কি-না, তা নিশ্চিত হওয়া। ৫০ শতাংশ মেরিট না থাকলে আবেদনটি নট প্রেস না করে রায় দিয়ে ডিসমিস করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি রুল জারি করা মানে, নতুন একটি মামলা হওয়া। আর হয়রানিমূলক মামলা করলে পিটিশনারকে জরিমানা করার পাশাপাশি আইনজীবীকে তিরস্কার করার ব্যবস্থা হলেও মামলাজট কমবে বলে মনে করি।
ভিউজ বাংলাদেশ: সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে এখনো খুব একটা বাংলা ভাষায় রায় দিতে দেখা যায় না। এর কারণ কি?
এবিএম খায়রুল হক: হাইকোর্টের রুলসের ভাষা ইংরেজির সঙ্গে ‘বাংলায়’ কথাটি যুক্ত করা এবং ইংল্যান্ডের মতো করে আমাদের দেশের প্রধান বিচারপতিদের রুলস তৈরির ক্ষমতা সংক্রান্ত বিধি সংযোজন হয়ে ২০১২ সালে এই রুলস পাস হয়। এতে করে বাংলা ভাষায় রায় দিতে এখন আর কারও কোনও সীমাবদ্ধতা নেই। তবুও কিছু সমস্যা হয়। কারণ, বাংলায় আইনের প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না। আইনগুলো ব্রিটিশ আমলের। সেখান থেকে হাজার হাজার রায় ও সিদ্ধান্ত এসেছে ইংরেজিতে। তাই কিছু ইংরেজির মর্মার্থ বাংলায় প্রতিশব্দ করা ছিল বেশ দূরূহ কাজ।
ভিউজ বাংলাদেশ : আপনি তো এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বাংলায় রায় দিয়েছেন। কতগুলো রায় দিয়েছিলেন বাংলায়?
এবিএম খায়রুল হক: সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসহ প্রায় প্রায় ৭ শতাধিক রায় ও আদেশ আমি বাংলাতে দিয়েছি। তবে সে সময়ে অনেকে বিচারকই বাংলায় রায় লিখতে অনিহা প্রকাশ করতেন। আমার সঙ্গে যারা বসতেন, তাদের আমি বাংলায় রায় লিখতে উৎসাহ দিতাম। আপিল বিভাগের বিচারপতি হওয়ার পর বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনকে বাংলায় রায় দিতে উৎসাহ যোগাই। পরবর্তীতে তিনি বাংলায় রায় লেখা চালু রাখেন। এছাড়াও বিচারপতি আশরাফুল কামাল, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকীও বাংলায় রায় লিখছেন। অনেক ক্ষেত্রে চালু হলেও এখনো সবখানে বাংলা প্রচলন হয়নি। বিশেষ করে আমরা উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু করতে পারিনি। আশা করি বর্তমান প্রধান বিচারপতির সুপ্রিম কোর্টের সব বিভাগে বাংলা ভাষা প্রচলনের ব্যবস্থা করবেন।
ভিউজ বাংলাদেশ : কমিশনের সুপারিশমালায় বাংলায় রায় লেখা নিয়ে বলা হয়েছে। এটা কতটুকু কার্যকর হয়েছে?
এবিএম খায়রুল হক: কমিশনের সুপারিশ অনুসারে নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রায় সবাই বাংলায় রায় ও আদেশ লিখছেন। হাইকোর্টেরও অনেক বিচারক বাংলা রায় লিখছেন। তবে আপিল বিভাগে বাংলায় রায় লেখা হচ্ছে না। আশা করি ভবিষ্যতে সর্বোচ্চ আদালতেও বাংলায় রায় লেখা হবে।
ভিউজ বাংলাদেশ : বর্তমানে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছে। আপনিতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপনার কোনো বক্তব্য আছে?
এবিএম খায়রুল হক: কোন রায়ই প্রধান বিচারপতি একক সিদ্ধান্তে প্রদান করেন না, কিন্তু সেই রায় যদি কোন রাজনৈতিক দলের স্বার্থের বিপক্ষে যায় তাহলে তারা প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এটা স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, আইন ও গণতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক। আইনের ব্যর্থতা ঘটলে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়।
ভিউজ বাংলাদেশ : বর্তমানে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার দেশবাসী পাচ্ছে বলে মনে করেন?
এবিএম খায়রুল হক: স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হচ্ছে। তবে আজকাল অনেক মিডিয়া ট্রায়ালও হচ্ছে। অনেককে আটকের পর কোর্টে নিয়ে গেলেই বলা হচ্ছে অপরাধী। যদি আইনের বদলে মানুষ ইচ্ছামতো শাসন করে আইন তখন সে পশুর বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।
ভিউজ বাংলাদেশ : আইন কমিশন যেসব আইন তৈরী করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় তাতে কি খুব বেশি হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন কি?
এবিএম খায়রুল হক: দেখুন, আইন কমিশনের করা আইন হুবহু জাতীয় সংসদে পাশ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আইন মন্ত্রণালয় ভেটিংয়ে আইনের কিছু পরিবর্তন বা পরিমার্জন করে থাকেন। তবে এটা কতটুকু করবেন সেটা মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। আইন কমিশন তো সর্বোচ্চটা দিয়ে একটি আইন তৈরী করে দেয়। সেখানে কতটুকু হাত দিতে হবে তা যারা দেন তারাই বলতে পারেন। এ ব্যাপারে আমি আর কিছু বলতে চাই না।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাকে ধন্যবাদ। 

এবিএম খায়রুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ। 


মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ