মব সহিংসতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায় এড়াতে পারে না
সাইকোলজিতে মব সহিংসতার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে: মব সাইকোলজি হচ্ছে এমন কর্মকাণ্ড যেখানে ব্যক্তি তার নিজস্ব বিচারবোধ হারিয়ে ফেলে যৌথ-মনস্তত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত হন এবং যৌথ মতামতের ভিত্তিতে বিচারের দায়ভার নিজের হাতে তুলে নিয়ে সহিংসতা সৃষ্টি করেন। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ভয়ংকর মব সহিংসতা দেখছে। আগের এর কিছু নজির দেখা গেছে, তবে এখন দিন দিন তা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের ৭ মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৭৯২ জন। আহত হয়েছেন ৭৬৫ জন। বুধবার মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এসব তথ্য জানিয়েছে।
এইচআরএসএস বলছে, সম্প্রতি গণপিটুনির মাধ্যমে মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। ডাকাত, চোর, ছিনতাইকারী সন্দেহেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এসবের বাইরে ধর্মীয় অবমাননা এবং ছেলেধরার অভিযোগেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। গণপিটুনির ঘটনায় থানায় মামলা হলেও সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের ঘটনা খুবই কম। এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা আইনের আওতায় না আসায় এ ধরনের ঘটনা থামছে না।
মব সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেব দায়ী করা হয় মূলত একটি দেশের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। তবে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে মব সহিংসতা বেড়ে যায়। আমাদের দেশে সম্প্রতি মব সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণআন্দোলনে সরকার পতনের পর পুলিশের ঢিলেঢালা ভাব ও নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে অনেকে দলবদ্ধ হয়ে আইন হাতে তুলে নিচ্ছেন। তাৎক্ষণিক ‘শাস্তি’ নিশ্চিত করার যে প্রবণতা সমাজে দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে উৎকণ্ঠা। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হলেও মব সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মব ট্রায়ালের ব্যাপারে সরকার যে কঠিন অ্যাকশনে রয়েছে, এটা আরও দৃশ্যমান করা জরুরি। যৌথ বাহিনী মাঠে থাকার পরও যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তাতে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। প্রাপ্ত তথ্যমতে, চারপাশে প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটছে। গত মঙ্গলবার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ‘ছিনতাইকারী’বলে মব সৃষ্টি করে দুই ইরানি নাগরিকসহ তিনজনকে বেদম মারধর করা হয়েছে।
মঙ্গলবার মধ্যরাতে ‘মব’ তৈরি করে গুলশানে সাবেক এমপি তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর বাসায় ঢুকে তল্লাশির নামে মালপত্র তছনছ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। আগের দিন সোমবার চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় লুটপাট ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে নেজাম উদ্দিন ও আবু সালেককে হত্যা করা হয়। একই দিন গাজীপুরে যাত্রীবাহী বাসকে সাইড দেয়া নিয়ে বাগবিতণ্ডার জেরে রিটন মিয়া নামে এক অটোরিকশার চালকে হাত ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয়। গত রোববার চুরির অভিযোগে ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার দক্ষিণ আইচার শাহজাহান মিন্টিজ নামে এক ব্যক্তির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়। ৪০-৫০ জন মিলে পিটিয়ে কাঁচি দিয়ে খুঁচিয়ে তার চোখ তুলে ফেলা হয়।
এসব কোনোটাই সুস্থ সমাজের পরিচয় না। এসব ঘটনা শুধু যে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে তা না, আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের ভাবমূর্তি অনেক ক্ষুণ্ণ করেছে। ফলে বিদেশীরা আমাদের দেশে আসতে ভয় পাবেন, এবং আমাদের দেশের মানুষ এখন বিদেশে যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনোভাবেই এসব ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না। অন্তবর্তী সরকার কেন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে সেটিও একটি প্রশ্ন। আমরা চাই এসব মব বন্ধ করার জন্য সরকার দ্রুত জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। আমরা চাই, আইন অনুযায়ী কোনো অপরাধী ধরা পড়লে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। গণপিটুনিতে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে ওই ঘটনায় অংশগ্রহণকারী সব ব্যক্তি সমনাভাবে দায়ী থাকবেন। অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কারও প্রতি নির্যাতন, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক আচরণ করা যাবে না। তাই মব সহিংসতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে না। সুতরাং এখনই মব সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে