Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ঢালাও গায়েবি মামলায় বিব্রত সরকার

মিথ্যা মামলাকারীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলার পরামর্শ আইনজীবীদের

Hira  Talukder

হিরা তালুকদার

সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

ণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণঅভ্যুত্থানে বহু হতাহতের ঘটনায় এরপর দেশজুড়ে একের পর এক হত্যা মামলা করা শুরু হয়। তবে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সুযোগ সন্ধানীরা ঢালাওভাবে সারা দেশে গায়েবি মামলা দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনো অভিযোগ এসেছে যে, এসব গায়েবি মামলায় পারিবারিক ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি ও শায়েস্তা করা, পূর্বশত্রুতা ও চাঁদাবাজির জন্য বহু নিরাপরাধ মানুষকে আসামি করা হচ্ছে। এই ঘটনায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও পড়েছে বিব্রতকর অবস্থায়।

ঢালাওভাবে গায়েবি মামলার অভিযোগ স্বীকার করেছেন সরকারের আইন উপদেষ্টা ও অ্যাটর্নি জেনারেল। এ ছাড়া বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বেশ কয়েকজন আইনজীবীও এমন গায়েবি মামলা হচ্ছে বলে ভিউজ বাংলাদেশকে জানান। তারা গায়েবি মামলাকারী বা বাদীর বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুসারে পাল্টা মামলা করার পারামর্শ দিয়েছেন।

গণঅভ্যুত্থানের সময় গত ৫ আগস্ট গুলিতে আল আমিন মিয়া (২২) মারা গেছেন দাবি করে তার স্ত্রী কুলসুম বেগম ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন। ১৩০ জনকে আসামি করে করা ওই মামলা গত ৮ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়া থানায় এজাহারভুক্ত হয়। তবে যাকে মৃত দেখিয়ে মামলাটি করা হয়েছে, সেই আল আমিন মিয়া গত ১৩ নভেম্বর স্বশরীরে হাজির হন আশুলিয়া থানায়। তিনি পুলিশকে জানান, তাকে না জানিয়ে স্ত্রী অসৎ উদ্দেশ্যে মামলাটি করেছেন, তিনি মারা যাননি এবং কোনো গুলিও খাননি।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঢাকার মিরপুরে মো. ফজলু হত্যার ঘটনায় গত ১১ সেপ্টেম্বর ২৫ সাংবাদিকসহ ১৬৫ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন নিহতের বড় ভাই মো. সবুজ। এ মামলায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সৈয়দ শুক্কুর আলী শুভ ২৭ নম্বর আসামি। তিনি ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি একজন পেশাদার সাংবাদিক। পেশাদার খুনি না। এভাবে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা হলে গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত হত্যা মামলার স্পিরিটও নষ্ট হয়ে যাবে।’ মামলার বাদী মো. সবুজ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সাংবাদিকরা এই মামলার আসামি কীভাবে হলো এটা তো আমি জানি না। আমি এজাহার লিখিনি। এর বেশি এখন কিছু বলা যাবে না।’

গণআন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ীতে মেহেদী হাসান হত্যার ঘটনায় করা মামলার এজাহারে বলা হয়, ‘যাত্রাবাড়ী থানার রায়েরবাগে গত ১৯ জুলাই কামরাঙ্গীরচরের টেকেরহাট ইউনিট আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খোকনসহ অন্য নেতারা ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে সশস্ত্র হামলা করেন। ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে বুলেট ও গুলি ছোড়া হয়। একপর্যায়ে মেহেদী হাসান (১৮) নামের এক তরুণের গায়ে গুলি লাগে। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’ এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সাকিব হাসান (২২) ও জাহাঙ্গীর আলম (৫০) নামের দুই ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা করা হয় যাত্রাবাড়ী থানায়। এই দুটি হত্যা মামলায় মেহেদী হাসান হত্যা মামলার এজাহারের অবিকল কথা লেখা হয়েছে। শুধু নিহত ব্যক্তির নাম-ঠিকানা ও আক্রমণকারীর নাম আলাদা। যাত্রাবাড়ী থানা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সারা দেশে এমন আরও অনেক ঢালাওভাবে গায়েবি মামলা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অথচ আইন অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুসারে, যদি কোনো ব্যক্তি কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা ফৌজদারি মামলা করেন এবং তা প্রমাণিত হয়, তবে মিথ্যা মামলাকারী বা বাদীপক্ষ দুই বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। যদি এমন গুরুতর মিথ্যা ফৌজদারি মামলা করেন, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সাত বছর বা তার ঊর্ধ্বে কারাদণ্ড হতে পারে, তাহলে সে ক্ষেত্রে মিথ্যা মামলাকারী বা বাদীপক্ষ সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এ বিষয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে গত ৫ আগস্টের পর থেকে ঢালাওভাবে মামলা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাচ্ছি, যার মধ্যে একটি বিরাট অংশে আসামিদের নাম গায়েবিভাবে এসেছে বলে জানতে পেরেছি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এমন ঘটনা ঘটছে। যার কারণে সরকার অবশ্যই বিব্রত। এই বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের অংশীজনদের কাছে পরামর্শ চেয়েছি। সেখানে গায়েবি মামলাকারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়েও পরামর্শ চাওয়া হয়েছে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে গত ৫ আগস্টের পর থেকে অনেক গায়েবি মামলা হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সঠিক মামলায় ঢালাও গায়েবি আসামি করা হচ্ছে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই এমন ব্যক্তিদের। এসব বিষয় রাষ্ট্রপক্ষ পর্যবেক্ষণ করছে। নিরপরাধীরা অবশ্যই মামলা থেকে বাদ যাবেন।’ যারা মিথ্য মামলা করছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তরা ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুসারে মিথ্যা মামলাকারীর বা বাদীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করতে পারেন।’

এ ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সহায়ক কমিটির সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পর অনেক গায়েবি ও আজগুবি মামলা দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে। এভাবে ঢালাও গায়েবি মামলা হওয়াটা মোটেই কাম্য নয় বর্তমান সরকারের আমলে। বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে বিরোধী মতের মানুষের বিরুদ্ধে যেভাবে গায়েবি মামলা হয়েছে, সেটা এখনো অব্যাহত থাকাটা দুঃখজনক।’

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নিরাপরাধ ব্যক্তিদের ফাঁসানোর জন্য গত ৫ আগস্টের পর থেকে অনেক গায়েবি মামলা হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত হত্যা মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করা হচ্ছে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই এমন ব্যক্তিকে। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, আসামি হওয়া নিরপরাধ ব্যক্তিদের মিথ্যা মামলাকারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুসারে পাল্টা মামলা করা উচিত। নইলে এমন বিশৃঙ্খলা থামানো যাবে না।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ