Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ব্যাংক একীভূতকরণ ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণের জন্য আইনি সংস্কার জরুরি

M A  Khaleque

এম এ খালেক

বুধবার, ৩ এপ্রিল ২০২৪

ই মুহূর্তে ব্যাংকিং সেক্টরে সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ হচ্ছে দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ এবং ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। অনেক দিন ধরেই দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার পরামর্শ দিলেও কর্তৃপক্ষ সে ব্যাপারে কর্ণপাত করেনি। সম্প্রতি অনেকটা হঠাৎ করেই বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভুত করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করে। একই সঙ্গে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি, যারা অত্যন্ত ক্ষমতাবান এবং ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য ‘দুষ্টক্ষত’ হিসেবে পরিচিত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের ব্যাপারে নড়েচড়ে বসলো কোনো। আর দুর্বল ব্যাংক একীভুতকরণের উদ্যোগই বা কেনো নিচ্ছে তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংক একীভুতকরণ ও ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের চিহ্নিত করে কঠোর আইনি ব্যবস্থার আওতায় আনার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা এমনি এমনি বা স্বপ্রনোদিত হয়ে করেনি।

গত বছর ৩০ জানুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) এর কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ সহায়তার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। একই বছর ২ ফেব্রæয়ারি ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৪৩ লাখ মার্কিন ডলার বাংলাদেশের অনুক‚ল্যে ছাড় করা হয়। দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার ছাড়া করা হয় গত ডিসেম্বর মাসে। সেই চুক্তির অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের পরিমাণ যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনা এবং অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করা।

এই শর্ত পরিপালিত না হলে আগামীতে ঋণের কিস্তি ছাড়করণের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং সেক্টরে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা আন্তরিক তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করতে শুরু করেছেন। ইতিমধ্যেই এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড এবং বিপর্যয়ের মুখে থাকা পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড একীভুত হবার জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। আরো ৭ থেকে ১০টি ব্যাংক একীভুতকরণ করা হতে পারে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো একীভুতকরণ সংক্রান্ত কোনো আইন প্রণয়ন করেনি। সুনির্দিষ্ট আইন ব্যতীত এমন একটি উদ্যোগ কতটা সফল হবে তা নিয়ে সংশয় থাকাটাই স্বাভাবিক। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিতকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলার জারি করেছে। কিন্তু একটি মাত্র সার্কুলারের ভিত্তিতে এত বড় একটি কর্মযজ্ঞ সমাপন করা কি সম্ভব হবে? কারণ যারা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি তারা অত্যন্ত পাওয়ারফুল। তারা সব সময় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ে থাকেন। কাজেই তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এতটা সহজ নাও হতে পারে। অনেকেই এমনও বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক একীভুতকরণ ও ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিতকরণে জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছে তা মূলত আইএমএফ’কে খুশি করার জন্যই। ব্যাংকিং সেক্টরের সুব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ এর মধ্যে নেই।

ব্যাংক একীভুতকরণের কথা বলা হচ্ছে অথচ একীভুতকরণ এবং অধিগ্রহণের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি। এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড এবং পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড একীভুতকরণের লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে। কিন্তু এটা কি একীভুতকরণ নাকি অধিগ্রহণ তা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। ব্যাংক একীভুতকরণের প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা মিলে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) গঠন। বিডিবিএল গঠনের পর আগের কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারি চাকরিচ্যুৎ হয়নি। এক ব্যাংকের উপর অন্য ব্যাংকের কোনো প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়নি। দুটি প্রতিষ্ঠান তাদের আগের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে নতুন নামে নবযাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক যেভাবে একীভুত হচ্ছে তাকে একীভুতকরণের চেয়ে অধিগ্রহণ বলাই উত্তম। কারণ মনে হচ্ছে পদ্মা ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকের মাঝে তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। দুটি ব্যাংক একীভুত হয়ে যদি নতুন নামে যাত্রা শুরু করতো অথবা এক্সিম-পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড নামে যাত্রা শুরু করতো তাহলে একে একীভুতকরণ বলা যেতো। যদিও এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক কোন প্রক্রিয়ায় একীভুুতকরণ হবে তা এখনো চূড়ান্ত ভাবে বলা যাচ্ছে না। তারপরও মনে হচ্ছে এক্সিম ব্যাংকের মাঝে পদ্মা ব্যাংক বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক একীভুতকরণের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন না করা পর্যন্ত এ ব্যাপারে চূড়ান্ত মন্তব্য করা যাচ্ছে না।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যে যে নীতিমালা ঘোষণা করেছে তার আলোকে বলা যায় এই উদ্যোগ সফল হবার সম্ভাবনা খুবই কম। প্রথমত, এ ধরনের একটি আইনি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকে জারি করা সার্কুলারের মাধ্যমে তা সম্ভব হবে না। এ জন্য জাতীয় সংসদে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। জাতীয় সংসদের অধিকাংশ সদস্য ব্যবসায়ী-শিল্পপতি। এদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে খেলাপি ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণের মাধ্যমে নিজেদের ঋণ হিসাব নিয়মিত করেছেন। তারা কি চাইবেন ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিতকরণ ও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হোক? আমরা কি দেখেছি? সাম্প্রতিক সময়, বিশেষ করে গত ৫/৬ বছরে ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান আইনগুলো যেভাবে সংস্কার/ সংশোধন করা হয়েছে তা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি এবং দুষ্টু গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। সম্ভবত একটি আইনি সংস্কারও দেখানো যাবে না যা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারিদের স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত। এসব আইন বহাল রেখে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। সাম্প্রতিক আইনি সংস্কারগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলেই অনুধাবন করা যাবে এগুলো কাদের স্বার্থে নিবেদিত।

প্রথমেই উল্লেখ করতে হয়, ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন সংস্কারের প্রসঙ্গটি। ঋণ হিসাব পুন:তঅফসিলিকরণ অর্থ হচ্ছে ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের নির্ধারিত কিস্তি পরিশোধের সময় সীমা বাড়নো বা কমানো। সাধারণত ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় সীমা কমানো হয় না, বাড়ানো হয়। যেমন, কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য হয়তো ২০২৪ সালের জুন মাসের ৩০ তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু ঋণ গ্রহীতা যে কোনো কারণেই হোক জুন মাসে কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ তাকে ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ তারিখে কিস্তি পরিশোধের অনুমতি দিলো। এটা ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ।

আগে সাধারণত কোনো ঋণ হিসাব ১ বছর বা ২ বছরের জন্য পুন:তফসিলিকরণ করার অনুমতি দেয়া হতো। কোনো ঋণ হিসাব সর্বমোট তিন বার পুন:তফসিলিকরণ করা যেতো। এ জন্য প্রথম বা ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণের জন্য মোট পাওনা ঋণের ১০ শতাংশ এককালিন নগদে ব্যাংকে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে জমা দিতে হতো। দ্বিতীয়বার পুন:তফসিলিকরণের জন্য ২০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট এবং তৃতীয় বার পুন:তফসিলিকরণের জন্য ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট জমা দিতে হতো। কিন্তু কিছু দিন আগে এক বিশেষ নির্দেশনা বলে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট জমা দিয়ে এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ মোট ১০ বছরের জন্য ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণের সুযোগ দেয়া হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অন্তত ৩৮ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ করিয়ে নিয়েছে। যারা তাদের ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ করিয়ে নিয়েছেন শর্ত ভঙ্গ না করলে তাদের ঋণ খেলাপি হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে না। এই যে ৩৮ হাজার ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ করা হয়েছে তার মধ্যে একটি বড় অংশই ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি। আইন মোতাবেক এদের ঋণ খেলাপি হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে না। কারণ আইন তাদের দায়মুক্তি দিয়েছে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। তাহলে এদের বিরুদ্ধে ব্যাংকগুলো কিভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে?

২০১৫ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবসায়-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এই অজুহাতে দেশের এক শ্রেণির প্রভাবশালি উদ্যোক্তা গোষ্ঠী ৫০০ কোটি টাকা ও তদুর্ধ অঙ্কের খেলাপি ঋণ হিসাব পুনর্গঠন করিয়ে নিয়েছেন। ঋণ হিসাব পুনর্গঠন এবং পুন:তফসিলিকরণ চরিত্রগত দিক থেকে একই রকমের। ১১ টি উদ্যোক্তা গোষ্ঠী ১৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন করিয়ে নিয়েছে। এদের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঋণ খেলাপি হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে না। সেই সময় অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, ৫০০ কোটি টাকা ও তদুর্ধ অঙ্কের ঋণ খেলাপিরা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অন্যেরা কি ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি? তাই আইনি সুযোগ শুধু একটি বিশেষ শ্রেণিকে কেনো দেয়া হলো?

দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে যে ঋণ হিসাবগুলো পুন:তফসিলিকরণ করা হয়েছে এবং ৫০০ কোটি টাকা ও তদুর্ধ অঙ্কের খেলাপি ঋণ ধারিদের ঋণ হিসাব পুনর্গঠনের যে সুবিধা দেয়া হয়েছে তা বাতিল না করা পর্যন্ত এই সুবিধা গ্রহণকারি ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের কোনোভাবেই চিহ্নত করা যাবে না। ব্যবস্থা গ্রহণতো দূরের কথা।

আগে ঋণ হিসাব অবলোপনের নীতিমালা ছিল আন্তর্জাতিক মানের। ‘ঋণ হিসাব অবলোপন’ শব্দটি উচ্চারিত হলেও অনেকের মনে করেন, ব্যাংক তার পাওনা ঋণ মওকুফ করে দিয়েছে অথবা ঋণের দাবি ত্যাগ করেছে। বিষয়টি আসলে তা নয়। অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবের উপর ব্যাংকের দাবি অপরিবর্তিত থাকে। অর্থাৎ অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবের কাছে পাওনা ঋণের অর্থ ব্যাংক কোনোভাবেই মওকুফ করে না। অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবের নিকট পাওনা ঋণের হিসাব ব্যাংক তার মূল লেজার থেকে সরিয়ে অন্য একটি হিসাবে সংরক্ষণ করে। এই ঋণের অর্থ আদায়ের জন্য ব্যাংক সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। আগে কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরপূর্বক শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করে একটি ঋণ হিসাব অবলোপন করা হতো। কয়েক বছর আগে এই আইন সংশোধন করা হয়েছে। কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর তিন বছর অতিক্রান্ত হলেই তা অবলোপনযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। কিছু দিন আগে আরো এক বছর কমানো হয়েছে। এখন কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর ২ বছর অতিক্রান্ত হলেই তা অবলোপন করা যাচ্ছে। এ জন্য ৫ লাখ টাকার কম ঋণের ক্ষেত্রে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরের শর্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের বিধানও প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রভিশন হচ্ছে ঋণের নিরাপত্তা বিধানের একটি কৌশল। প্রত্যেক শ্রেণির ঋণ হিসাবের বিপরীতে নির্ধারিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। যে ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হয় অর্থাৎ যে ঋণ হিসাব থেকে ভবিষ্যতে পাওনা কিস্তি আদায়ের সম্ভাবনা তাকে না। সেই ঋণ হিসাবের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। অবলোাপনকৃত ঋণকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হিসাবে অন্তর্ভক্ত করে দেখানো হয় না। ঋণ হিসাব অবলোাপন পদ্ধতি হচ্ছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর একটি স্বীকৃত কৌশল।

বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের জারিকৃত সার্কুলারে বলেছে, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দুই ধাপ নিচের একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে ব্যাংকের একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি যাচাই করবে। এটা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। কারণ এক শ্রেণির অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তার সহযোগিতা ব্যতীত কেউ ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হতে পারেন না। ব্যাংকের এক শ্রেণির অসৎ কর্মকর্তা আছেন যারা ব্যক্তি স্বার্থে ব্যাংকের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অপাত্রে ঋণ মঞ্জুর করে থাকেন। যারা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি যাচাই কমিটিতে থাকবেন তাদের কেউ যদি ঋণ মঞ্জুরের সময় জড়িত থাকেন তিনি কি সেই ঋণ গ্রহীতাকে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইবেন? বরং এ জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নেতৃত্বে একাধিক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিতকরণের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ হিসাব অবলোপন, ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ ও ঋণ হিসাব পুনর্গঠন সংক্রান্ত যে আইন পরিবর্তন/সংশোধন করা হয়েছে এগুলো বাতিল করে আগের আইন, যা আন্তর্জাতিক মানে তা বহাল করতে হবে। প্রয়োজনে আইনগুলোকে আরো কঠোর করতে হবে।

একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে। অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নামে একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে। এর ফলে কার্যত ব্যাংকিং সেক্টরে দ্বৈত শাসন চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে যেভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পাওে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা পারে না। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যা ও সম্ভাবনা বেশি ভালো বুঝতে পারবে। সবার চেয়ে আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এ ধরনের উদ্যোগ কখনোই বাস্তবায়িত হবে না।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতি বিষয়ক লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ