Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য আইনি সংস্কার জরুরি

M A  Khaleque

এম এ খালেক

সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে ব্যাংকিং সেক্টরের দুরবস্থা তুলে ধরেছে। সংস্থাটি বলেছে, গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়েছে। ফলে এই সেক্টর বর্তমানে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পতিত হয়েছে। দেশে ব্যবসায়রত ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে অন্তত ২৯টি নানা কারণেই স্বাভাবিক গতিতে চলছে না। এর মধ্যে অন্তত ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া হবার পর্যায়ে রয়েছে। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের স্থল ব্যাংকিং সেক্টরকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করা হয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে সংঘটিত ২৪টি বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে একটি চিহ্নিত মহল। ব্যাংকিং সেক্টর থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে লুটে নেয়া এই অর্থের পরিমাণ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১২ শতাংশ।

সিপিডির তথ্য মোতাবেক, বিগত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধরনের ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ২০২২ সালে। এই বছর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে এস আলম গ্রুপ ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে বের করে নিয়ে বিদেশে পাচার করে। তার আগে এস আলম গ্রুপ রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে রাতের আঁধারে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পদত্যাগে বাধ্য করে ব্যাংকের মালিকানা দখল করে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়ে নানা অনিয়মের মাধ্যমে বেসিক ব্যাংক থেকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লুটে নেয় ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু। এই ঋণ কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে আদালতে ৬০টির বেশি মামলা করা হয়েছে। ৫০টি মামলায় তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুকে আসামি করা হলেও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। প্রায় একই সময়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালি ব্যাংক লিমিটেড থেকে হলমার্ক গ্রুপ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়। ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে জনতা ব্যাংক লিমিটেড থেকে ক্রিসেন্ট গ্রুপ ও অ্যানন টেক্স গ্রুপ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়। জনতা ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান এই অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ উত্থাপিত হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বরং যারা ব্যাংকিং সেক্টরে এমন দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন সরকারিভাবে তাদের সুরক্ষা দেয়া হয়েছে।

দেশের ব্যাংকিং সেক্টর দুর্নীতির মাধ্যমে সহজে অর্থ উপার্জনের সুবর্ণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক ব্যাংকিং খাতে একক ব্যাংক নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। এমন সব ব্যক্তিকে ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়, কর্মজীবনে যাদের সততা এবং নৈতিক মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল; কিন্তু তারপরও শুধু রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে তাদের ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। বিশ্বে সাধারণত দুধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করা যায়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ইউনিট ব্যাংকিং এবং অন্যটি ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিং। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিট ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ইউনিট ব্যাংকিং হচ্ছে সেই ব্যাংকিং ব্যবস্থা যেখানে মাত্র কয়েকটি শাখা নিয়ে একটি ব্যাংক স্থাপিত হয়। আর ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিং হচ্ছে সেই ব্যাংকিং ব্যবস্থা, যেখানে সামান্য কিছু ব্যাংক বিপুলসংখ্যক শাখার মাধ্যমে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ব্রিটিশ ব্যাংকিং ব্যবস্থা হচ্ছে ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিং। ইউনিট ব্যাংকিং ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে সামান্য আঘাতেই একটি ব্যাংক পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে।

গত এক শতাব্দীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ হাজার ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনুসরণ করে আসছে; কিন্তু গত সরকার আমলে এমনভাবে নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়, যা ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিং নীতিমালার পরিপন্থি ছিল। গত সরকার আমলে সর্বশেষ যখন ৯টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক এতে আপত্তি জ্ঞাপন করেছিল; কিন্তু সেই আপত্তি উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকগুলো স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, এ মুহূর্তে দেশে নতুন ব্যাংকের কোনো প্রয়োজন নেই; কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক বিবেচনায় ৯টি ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং বিদেশি মিলিয়ে মোট ৬০টি ব্যাংক ব্যবসায়রত রয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের সংখ্যা হচ্ছে ৪৩টি। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও বিদেশি মিলিয়ে অবশিষ্ট ব্যাংকের সংখ্যা ১৭টি। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশের জন্য এত বিপুলসংখ্যক ব্যাংক কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ব্যাংকের সংখ্যা ৩৩টি। পাকিস্তানে ব্যাংকের সংখ্যা ২০টি আর মালয়েশিয়ায় রয়েছে ৪৩টি ব্যাংক। চাহিদার তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হয়ে যাবার কারণে এ খাতে অসম প্রতিযোগতা চলছে। বেশির ভাগ ব্যাংকই কোনো নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে গ্রাহকের কাছে উপস্থিত হতে পারছে না। তারা একই ধরনের প্রোডাক্ট নিয়ে গ্রাহকদের দ্বারে যাচ্ছে। বিভিন্ন মেয়াদ মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ২০ বছরে মোট ২৬টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়। প্রতিটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে এখানে পেশাদারিত্বের কোনো বালাই ছিল না। একইভাবে ২০০৯ সালের পর এমন সব ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে নিয়োগদান করা হয়, যাদের অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পর্কে ন্যূনতম কোনো ধারণা ছিল না। এদের কাজই ছিল নানাভাবে ঋণ অনুমোদনের তদবির করে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করা। কোনো কর্মকর্তা এদের অন্যায় কর্মে সহায়তা না করলে তাদের সরকার বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে হেনস্তা করা হতো। তাদের নির্মম মানসিক নির্যাতনে কত সৎ এবং দক্ষ কর্মকর্তা যে নীরবে চোখের পানি ফেলেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

বিগত সরকার আমলের পুরোটা সময়জুড়েই ব্যাংকিং সেক্টরকে ধ্বংসের চেষ্টা চালানো হয়েছে। বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব পালনকালে ব্যাংকিং সেক্টরের বিভিন্ন আইন সংশোধনের নামে যে ক্ষতি করা হয়েছে তার চূড়ান্ত রূপ প্রত্যক্ষ করা যাবে আরও কয়েক বছর পর। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যতজন ব্যক্তি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন তার মধ্যে এক মাত্র আ হ ম মুস্তফা কামালই ছিলেন সরাসরি ব্যবসায়-উদ্যোক্তা। যেহেতু তিনি নিজেই একজন ব্যবসায়ী ছিলেন তাই ব্যবসায়ীদের অনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষা দেবার জন্য ব্যাংকিং আইনগুলো পরিবর্তন করেন। তিনি কীভাবে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের আইনি পরিবর্তন-পূর্বক ক্ষতি সাধন করেছেন, তার কিছু উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

আ হ ম মুস্তফা কামাল আগে পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। সেখান থেকে তাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্তির পর তিনি প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, আজ থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক টাকাও বাড়বে না। তার এই বক্তব্য ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের আশান্বিত করেছিল; কিন্তু তিনি এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করেন, বিশেষ করে এই সেক্টরের জন্য বিদ্যমান আন্তর্জাতিক মানের আইনগুলো এমনভাবে পরিবর্তন করতে থাকেন, যাতে খেলাপি ঋণের কিস্তি আদায় না করেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো যায়।

প্রথমেই তিনি করোনার অজুহাতে খেলাপি ঋণ চিহ্নিতকরণের মেয়াদ বৃদ্ধি করেন। এতে আগের তুলনায় বেশি দিন মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলেও সেই ঋণ হিসাবকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়নি। ঋণ হিসাব অবলোপনের সংজ্ঞা পরিবর্তন করেন। আগে কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরপূর্বক শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করে সেই ঋণ হিসাবকে অবলোপন করা যেত। সংশোধিত আইনের মাধ্যমে ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর ২ বছর অতিক্রান্ত হলেই তা অবলোপন করার সুযোগ দেয়া হয়। পাঁচ লাখ টাকার কম ঋণাঙ্কের জন্য আদালতে মামলা দায়েরের শর্ত বাতিল করা হয়। একইভাবে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের শর্তও প্রত্যাহার করা হয়। ঋণ হিসাব অবলোপন সুবিধা সহজীকরণের কারণে বর্তমানে এই খাতে ব্যাংকের পাওনা ঋণাঙ্কেও পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। ঋণ হিসাব অবলোপন শব্দটি নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। ঋণ হিসাব অবলোপন শব্দটি উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের মনে হতে পারে ব্যাংক সম্ভবত পাওনা ঋণের দাবি ত্যাগ করেছে বা মওকুফ করে দিয়েছে। আসলে বিষয়টি তা নয়। যে ঋণ হিসাব অবলোপন করা হয় সেখান থেকে ঋণের কিস্তি আদায়ের সম্ভাবনা কমে যায় ঠিকই কিন্তু ব্যাংক কখনোই এই ঋণের দাবি ত্যাগ করে না। অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব থেকে ব্যাংক ঋণের কিস্তি আদায়ের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। তবে এ ধরনের ঋণ হিসাব থেকে কোনো কিস্তি আদায় হলে তা সরাসরি ব্যাংকের মুনাফা খাতে যোগ হয়। কয়েক বছর আগেও অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবের নিকট ব্যাংকগুলোর পাওনার পরিমাণ ছিল ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এখন তা ৭৫ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।

আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ২ শতাংশ নগদ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ হিসাব পুনঃতপশিলীকরণের সুযোগ দেয়া হয়। আগে কোনো ঋণ হিসাব পুনঃতপশিলীকরণ করতে হলে প্রথমবারের জন্য মোট খেলাপি ঋণের ১০ শতাংশ, দ্বিতীয়বারের জন্য ২০ শতাংশ এবং তৃতীয় বারের জন্য ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট ব্যাংকে জমা দিতে হতো। প্রতিবার সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য ঋণ হিসাব পুনঃতপশিলীকরণ করা যেত; কিন্তু সর্বশেষ মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য ঋণ হিসাব পুনঃতপশিলীকরণের সুযোগ দেয়া হয়। গত এক বছরে পুনঃতপশিলীকরণকৃত ঋণ ৯১ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে মোট স্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। গত জুন মাসে পর্যন্ত সময়ে দেশের বিভিন্ন আদালতে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য দায়েরকৃত ৬৭ হাজার ৫১৯টি মামলায় ব্যাংকগুলোর দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা। এটা ব্যাংকের ছাড়কৃত মোট ঋণ ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকার ৩৫ দশমিক ৩৯৬ কোটি টাকার ৩৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান প্রকাশের সময় অবলোপনকৃত, মামলাধীন ও পুনঃতপশিলীকৃত ঋণাঙ্ক প্রদর্শন করে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মোতাবেক খেলাপি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। আ হ ম মুস্তফা কামাল যখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তখন খেলাপি ঋণের প্রদর্শিত পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার কোটি টাকা।

গত সরকার আমলে দেশের ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠান রাস্তা উন্মুক্ত করা হয়েছিল। আগে কোনো ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে একই পরিবার থেকে একযোগে দুজন পরিচালক নিযুক্ত হতে পারতেন। তারা অব্যাহতভাবে দুই টার্ম (প্রতি টার্ম তিন বছর) দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। এই আইন পরিবর্তন করে একই পরিবার থেকে একযোগে চারজন পরিচালক নিয়োগের বিধান করা হয়। তারা অব্যাহতভাবে তিন টার্ম দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) এর নিকট থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণের সময় এই আইনি বিধান পরিবর্তনের শর্ত প্রদান করা হয়। এরপর একই পরিবার থেকে চার জনের পরিবর্তে তিন জন পরিচালক নিয়োগের বিধান করা হয়।

দলীয় অনুগত ব্যাংক মালিকদের বিশেষ সুবিধা দেবার জন্য যেসব আইনি পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে তার দু-একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আগে নিয়ম ছিল কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তাদের উদ্বৃত্ত অর্থের ২৫ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে আমানত হিসেবে সংরক্ষণ করতে পারতো। অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ অর্থ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হতো। এটা করা হতো মূলত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অর্থেও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু গত সরকার আমলে ব্যক্তি মালিনাকায় বিপুলসংখ্যক ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার পাশাপাশি তারা যাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত অর্থ আমানত হিসেবে পেতে পারে, সে জন্য আগের বিধান পরিবর্তন করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ৫০ শতাংশ অর্থ ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণের বিধান করা হয়।

সবচেয়ে জঘন্য নীতিগত পরিবর্তন করা হয় ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে। আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক বহুল বিতর্কিত ৯-৬ সুদহার প্রয়োগ করে। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সুদের হার বাজার চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করেই নির্ধারিত হবে। শুধু অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেই বাংলাদেশ ব্যাংক সুদ হার নির্ধারণের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারদলীয় সমর্থক ব্যবসায়ীদের অনৈতিক সুবিধা দেবার জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। আর আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের সর্বোচ্চ হার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের বেলায় সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। এখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার দশমিক ৫০ শতাংশ কম নির্ধারণ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে আমানতকারিরা বেশি সুদ পাবার প্রত্যাশায় ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ সংরক্ষণ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৯/৬ সুদ হার নির্ধারণের বিষয়টি শুধু যে ব্যাংকিং সেক্টরের ক্ষতি করেছে তা নয় সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও তা ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনে।

ব্যাংক ব্যবসায় পরিচালিত হয় সাধারণ মানুষের বিশ্বাস আর আস্থার ওপর নির্ভর করে। সেই আস্থা এখন বিনষ্ট হবার পর্যায়ে রয়েছে। একটি কমিটি গঠন করে তার সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বকেই প্রাধান্য দিতে হতে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে কেউ যাতে কোনো পরিষদের নামে রাজনীতি চর্চা করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু পরিষদ অথবা জিয়া পরিষদের নামে ব্যাংকে রাজনীতি চর্চা করেছেন তাদের চিহ্নিত করে চাকরিচ্যুতিসহ শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কেউ যদি রাজনীতির চর্চা করতে চান তাহলে তাকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়েই তা করতে হবে।

এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ