সব উৎকণ্ঠা শেষে নাবিকরা ফিরে আসুক নিরাপদে
ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজটির চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান স্ত্রীর কাছে পাঠানো বার্তায় জানিয়েছেন ‘টাকা না দিলে একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলেছে’। সপ্তাহজুড়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে আছেন আতিক উল্লাহ খান এবং তার সঙ্গীরা। এ রকম পরিস্থিতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা আর না ফেরার আশঙ্কা যেমন নাবিকদের রয়েছে তেমনি তাদের পরিবারগুলোরও রয়েছে।
আতিক উল্লাহ খান এর মা এবং দুমেয়ের ছবি ছাপা হয়েছে গণমাধ্যমে। বাবা জলদস্যুদের হাতে আটক ঠিক সেই সময় কি ছবি তুলতে ইচ্ছা করে! করে না; কিন্তু ছবিও কথা বলে। মা আর দুমেয়ের মনে যে উদ্বেগ তাই চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। দূর দেশ থেকে বাবা ফিরে এলে কন্যারা ঝাঁপিয়ে পড়েন বাবার কোলে ঠিক ওই বয়সই ওদের। এবারও নিশ্চয় বাবার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল ওরা; কিন্তু তার বদলে এ কেমন খবর এল, যা ওদের চোখের ঘুম কেড়ে নিলো।
ঝড় ঝঞ্ঝা, সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ আর প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে নাবিকরা সারা বিশ্বের অর্থনীতি সচল রাখে। এর মধ্যে দস্যুতা নাবিকদের জীবনে নতুন সংকট তৈরি করে। মুক্তিপণের জন্য কখনো কখনো নাবিকদের হত্যা করে লাশ সমুদ্রে ফেলে দেয়া হয়। নাবিকরা নিজেরাও যেমন বিষয়টি জানেন তেমনি তাদের পরিবারগুলোও জানে এই যাত্রা শেষ যাত্রা শবযাত্রা হতে পারে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সারা দুনিয়ার অর্থনীতি সচল রাখতে নিজেদের প্রাণ পর্যন্ত উৎস্বর্গ করছে আমরা তাদের জন্য কি করছি? শুধু সোমালিয়া নয় এমন দস্যুতা পৃথিবীর আরও অনেক দেশে বিস্তৃত রয়েছে। তবে সোমালিয়ান সদ্যুরা যেমন সমুদ্রগামী বড় জাহাজে হামলা চালিয়ে যে কুখ্যাতি পেয়েছে তা হয়তো অন্যরা খুব একটা পাননি।
জার্মান তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা বলছে, সারা বিশ্বে ২০১০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত এমন ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ১৩০টি। আর সোমালিয়া উপকূলে ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এমন ঘটনা ঘটেছে ৩৫৮টি অন্যদিকে ২০১৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত এমন দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে ৮টি। অর্থাৎ সোমালিয়া হোক বা অন্য কোন দেশের উপকূল হোক গড়ে প্রায় দেড় দিনে এমন দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতিদিন ঘটে যাওয়া এই দস্যুতার বিরুদ্ধে কেন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে গোটা দুনিয়া ব্যর্থ হচ্ছে তা চিন্তার বিষয়। দস্যুতার সব চাইতে বড় কারণ হচ্ছে অন্য যে কোন ব্যবসার চাইতে এখানে আয়ের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্বব্যাংক ২০০৫ থেকে ২০১২ অর্থাৎ আট বছরে সোমালিয়ান দস্যুদেরে আয়ের একটি হিসেব দিয়েছে। এই হিসেবে দেখা গেছে এই সময়ে তারা ৩৫০ মিলিয়ন ডলার থেকে ৪২৫ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ আদায় করেছে। অর্থাৎ তাদের বাৎসরিক আয় ৪৩ মিলিয়ন ডলার থেকে ৫৩ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। তবে এই প্রতিবেদনের তথ্য কতটা সঠিক তা যাচাই বাছাই করা কঠিন। কারণ দস্যুরা দাবি করা মুক্তিপণের কতটা পেয়ে থাকে তার হিসাব জোগাড় করা কঠিন। মুক্তিপণ দেয়া সমুদ্রগামী জাহাজ কোম্পানির কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যবসায়িক কৌশলের অংশ হিসেবে দস্যুদের দেয়া ডলারের পরিমাণটি বাড়িয়ে দেখায়। অন্যদিকে দস্যুরা এটি প্রকাশ করে না। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবর বলছে জলদস্যুরা রাজকীয় জীবনযাপন করে। তারা দামি গাড়ি বাড়ির সঙ্গে বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তবে একটি রাষ্ট্রের খুব কমসংখ্যক মানুষ এই দস্যুতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিষয়টি এমন নয় যে দস্যুরা সম্পদ লুট করে কিম্বা মুক্তিপণ আদায় করে তারা সোমালিয়ার সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলি করছে। দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে সোমালিয়া সরকারেরও বিষয়টি নিয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই। দেশটির সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক এমনকি সংবাদপত্রও এই দস্যুতাকে অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখে। ইন্টারনেটে দেখা যায় সোমালিয়ার এমন কিছু সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশি জাহাজ ছিনতাই নিয়ে কোনো খবরই ছাপেনি।
ইতিহাসের পাতায় তাকালে দেখা যাবে সোমালিয়ান জলদস্যু সৃষ্টির প্রধান কারণ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী সম্পদের যে অসম বণ্টন, গরিব আর পিছিয়ে পড়া মানুষ সম্পদ লুট করা, অগণতান্ত্রিক চর্চায় মানুষকে বিক্ষুব্ধ হতে বাধ্য করার কারণে জেলে থেকে দস্যু হয়ে উঠেছে এসব মানুষ।
ইতালিয়ান উপনিবেশ থেকে ১৯৬০ সালে সোমালিয়া স্বাধীন হয়। সোমালিয়ার মোট আয়োতন ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৬৫৭ বর্গ কিলোমিটার। সোমালিয়ার জনসংখ্যা ২০২৩ এর হিসেব অনুযায়ি ১ কোটি ৮৩ লাখ ৪৩ হাজার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও খুব একটা বেশি নয়। পরিসংখ্যান বলছে ১৯৫০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত এই রাষ্ট্রের গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তিন শতাংশের সামান্য বেশি। বিশাল ভূখণ্ড আর স্বল্প জনসংখ্যার এই দেশটি কেন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হলো সেটি বিশ্লেষণ করা জরুরি। বিশ্লেষণ এই কারণে জরুরি যে কোনো বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ধীরে ধীরে দস্যুতার দিকে ঠেলে দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ইতিহাস বলছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়, সোমালিয়ায় তখন শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ। আর্থিক অভাব-অনটন থাকলেও সমুদ্রের নোনাজল থেকে মৎস্য আহরণ করে সুখেই দিনাতিপাত করছিল মানুষগুলো। ঠিক সে সময় বিশ্বের অন্য প্রান্তে রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে ওঠে শক্তিধর সাম্রাজ্যগুলো। যাতায়াতের জন্য তারা বেছে নেয় নির্ঝঞ্ঝাট সমুদ্রপথকে। এভাবে সোমালিয়া চলে যায় ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণে। এভাবে ৩০০ বছরের বেশি সময় সোমালিয়াকে শোষণ করে ইতিলিয়ানরা। স্বাধীনতার পরপর ১৯৬৯ সালেই আবার সোমালিয়া চলে যায় এক সামরিক শাসকের দখলে। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের উৎখাতের পরে নৈরাজ্যের মধ্যে পড়ে দেশটি।
সামরিক শাসন আর চরম নৈরাজ্যের মধ্যে ইউরোপীয় দেশগুলো সোমালিয়া উপকূলে তাদের পারমাণবিক বর্জ্যের সঙ্গে হাসপাতাল বর্জ্য ডাম্পিং শুরু করে। এ সময় সোমালীয় উপকূলজুড়ে দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে ইউরোপীয় বড় আকারের জাহাজগুলো উপকূল থেকে চুরি করে মাছ ধরে নিয়ে যেতে শুরু করে। সাধারণ সোমালীয় জেলেরা এক সময় বুঝতে পারে তাদের সমুদ্র মাছশূন্য হয়ে পড়ছে। তখন তারা নিজেদের উদ্যোগে ইউরোপীয় জাহাজগুলো হটিয়ে দিতে শুরু করে। এক সময় তারা বুঝতে পারে জাহাজ হটিয়ে দেয়ার চাইতে সেগুলো আটকে মুক্তিপণ আদায় করলে বেশি অর্থ পাওয়া সম্ভব। এভাবে জেলে থেকে দস্যু হয়ে ওঠে সাধারণ সাধাসিধে এই সোমালিয়ানরা।
১৯৯১ সাল থেকে সোমালিয়ানরা জলদস্যুতা শুরু করে; কিন্তু ২০০৫ সাল থেকে সোমালিয়ানরা আধুনিকভাবে দস্যুতা শুরু করে। এই সময়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জলদস্যুদের বিভিন্ন দলে যোগ দেয়। তারা স্যাটেলাইট সংযোগের সঙ্গে আধুনিক মারণাস্ত্রে সংযোজিত হয়। সোমালিয়ার সাধারণ মানুষ শুধু এই দস্যুতার সমর্থনই দেয় না, তারা মনে করে এটিই তাদের জলসীমা রক্ষার একমাত্র উপায়। ফলে শুধু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে সাধারণ মানুষের এই ধারণা ভেঙে দেয়া জরুরি। দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সোমালিয়াকে শান্ত করে এই ভয়ংকর জনপদকে চলাচলের উপযোগী করার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিতে হবে। যাতে আর কোনো নাবিক কিংবা তাদের পরিবার উৎকণ্ঠায় না থাক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে