সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিই যেন শেষ কথা হয়
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান নষ্টের একটি পাঁয়তারা যে চলছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু কারা করছে এ ষড়যন্ত্র, তা এক কথায় বলা মোটে সহজ নয়। স্বভাবতই একপক্ষ আরেক পক্ষকে ষড়যন্ত্রের জন্য দোষারোপ করছে; কিন্তু ঘটনাবলির দিকে তাকালে যদি একটু পরিষ্কার হওয়া যায়। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নানা সেক্টরে নানা ধরনের দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে মানুষ। কোনো গোষ্ঠী হয়তো বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে, কোনো গোষ্ঠী কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে, কোনো সম্প্রদায় বড় সড়কগুলোতে তিন চাকার রিকশা চালানোর অধিকারের দাবিতে। এ ছাড়াও বিভিন্ন মহল থেকে হয় সুবিধা প্রাপ্তি অথবা বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়া, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাস্তা রয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকেই এই পরিস্থিতি দায়িত্ব গ্রহণ করা সরকারকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষ বিব্রত করছে।
এমন পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে, কোথাও বা মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে দুর্গাপূজার আগে-পরে। যদিও দেশের দুটি বৃহত রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলাম এসব ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে বারবার। এমনকি জামায়াতে ইসলামী হিন্দুদের ধর্মালয় মন্দির পাহারা দেয়ারও আহ্বান জানিয়েছে। কোথাও কোথাও দিয়েছেও; কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাতে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরও ঘটতে পারে এমন আশঙ্কায় তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চেষ্টা করে।
বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের ব্যানারে হিন্দু সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করার ব্যাপারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে চেষ্টা করেন চট্টগ্রাম হাটহাজারি পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী, যিনি চিন্ময় মহাপ্রভু নামেও পরিচিত। গড়ে ওঠে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট, যার মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য বিবৃতি দিচ্ছিলেন চিন্ময় ব্রহ্মচারী। তিনি দেশব্যাপী খুব সুপরিচিত ছিলেন না। তবে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত সদালাপী এবং বন্ধত্বপূর্ণ মানুষ। স্থানীয় অনেক মুসলমানের সঙ্গেও তার বন্ধত্ব রয়েছে। কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে দেখা হয় বাংলাদেশের প্রথমসারির বুদ্ধিজীবী ও ইসলামী ভাবান্দোলনের প্রবক্তা ফরহাদ মজহারের। উল্লেখ্য, ফরহাদ মজহারের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ওপর একটি প্রভাব রয়েছে।
ফরহাদ মজহার এবং চিন্ময় কৃষ্ণ দুজন একে-অপরকে আলিঙ্গন করে আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা করেন এবং মত বিনিময় করেন। এই চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের পর ফরহাদ মজহার তার অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেন এবং ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র এবং পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে অবিলম্ব মুক্তি দিন, সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ ধর্ম ও জাতিসত্তা নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষা করুন, আত্মঘাতী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বন্ধ করুন। হিন্দু মানেই দিল্লির দালাল, বিজেপির এজেন্ট, হিন্দুত্ববাদী এ ধরনের ঘৃণাবোধক সাম্প্রদায়িক ট্যাগিং পরিহার করুন...’
কেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হলো? গত ২৫ অক্টোবর বন্দর শহর চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে গণসমাবেশ করে এই নতুন সংগঠনটি। সেখানে উপস্থিত হয় হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সেখানে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস তার বক্তব্যে বলেন, ‘সনাতনীদের এদেশ থেকে উৎখাতের চেষ্টা হলে পরিণতি ভয়াবহ হবে। যে মঞ্চ থেকে স্বাধীনতার ছয় দফার দাবি উঠেছিল, সেই মাঠে বাংলাদেশের সব মঠ মিশনের সাধুরা সমবেত হয়েছেন সনাতনীদের দাবি আদায়ে। সনাতনীদের ওপর যতই নিপীড়ন হবে, আমরা তত বেশি ঐক্যবদ্ধ হবো। দাবি আদায়ে বিভাগ ও জেলায় সমাবেশ শেষে আমরা ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করব।’ উল্লেখ্য, এখানে কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা হয়নি। এই সমাবেশে জাতীয় পতাকার পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসাসনেস বা ইসকনের পতাকা ছিল। এরও আগে ১৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের জামাল খান মোড়ে দুর্গাপূজায় বিভিন্ন মন্দিরে হামলা এবং শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করানো, দুর্গপূজায় নিরাপত্তা জোরদারসহ ৮ দফা দাবিতে সমাবেশ করেছিল সম্মিলিত সনাতনী সমাজ বাংলাদেশ যেখানে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী ছিলেন প্রধান বক্তা।
যা হোক, ২৫ অক্টোবরের ৬ দিন পর ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগরের মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান একটি মামলা করেন দণ্ডবিধির ১২০(খ), ১২৪(ক), ১৫৩(ক), ১০৯ এবং ৩৪ ধারায়। মামলায় তিনি ১৯ জন সনাতন ধর্মের অনুসারীর নামোল্লেখ করেন এবং আরও ১০-১৫ জন অজ্ঞাত পরিচয় কথা বলা হয়। মামলার ধারাগুলো অত্যন্ত গুরুতর। দণ্ডবিধির ১২০(খ) হল অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, ১২৪(ক) রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ। পূর্বে এই মামলায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও ২৫ নভেম্বর চিন্ময় প্রভুকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলাটিতে জাতীয় পতাকার চেয়ে অন্য পতাকা দিয়ে প্রায় ঢেকে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। বাংলাদেশের আইন অনুসারে জাতীয় পতাকার চেয়ে অন্য কোনো পতাকা প্রমিনেন্ট করা বা হওয়া একটি ফৌজদারি অপরাধ।
অবশ্য এই মামলার পর রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। প্রথমে চট্টগ্রামের স্থানীয় বিএনপি নেতারা বলেন, এই মামলা তার ব্যক্তিগত, দলের কোনো সম্পর্ক নাই। পরে দল থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এবং এটাও উল্লেখ থাকা দরকার যে চিন্ময় কৃষ্ণদাস ইসকন আগেই দলীয় আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে অব্যাহতি দিয়েছে; কিন্তু যেহেতু তিনি দীর্ঘদিন ইসকন ছিলেন এবং ইসকনের ওই সব সমাবেশে সম্পৃক্ততা দেখা গেছে, তাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের মধ্যে ইসকন নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে।
চিন্ময় প্রভুকে গ্রেপ্তারের পর বিষয়টি সংখ্যাগরিষ্ঠ সনাতন ধর্মের দেশ ভারত বিষয়টিকে সহজভাবে নেয়নি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৬ নভেম্বর এক বিবৃতিতে তার গ্রেপ্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পশ্চিমবাংলার বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারি উপ-হাই কমিশনে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। রাজ্য বিজেপি নানা বাংলাদেশ সীমান্তে নানা কর্মসূচির কথা বলেছে। রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দোপধ্যায় বলেছেন, ‘এটি বিদেশের ব্যাপার। এ ব্যাপারে ভারত সরকার যে অবস্থান নেবে আমরা তাকে সমর্থন দেব।’ রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের অন্যতম নেতা ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বিষয়টি পূর্বে ছিল দুঃখজনক; কিন্তু এখন হয়েছে উদ্বেগের।’
বাংলাদেশ সরকার ভারতের বিবৃতির প্রতিউত্তর দিয়েছে। তথাপি দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকে সরকারকে দৃষ্টি রাখতে হবে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির ক্ষেত্রে এ ঘটনা উদ্বেগের। সরকারের উচিত হবে, এটিকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা। কারণ আইন নিজের গতিতে চললেও কখনো কখনো তা পরিবেশ পরিস্থিতির জন্য প্রতিকূল হয়ে উঠতে পারে। আমরা এদেশের সব মানুষের মধ্যে বিভাজন নয়, সম্প্রীতি দেখতে চাই। দেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষও মিলে মিশে থাকতে চায়। সুতরাং সবকিছুরই শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। সেই পথেই সব পক্ষ হাঁটবে বলে আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই।
মহসীন হাবিব: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে