রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি ফুটবলও সংস্কার করা হোক
সমাজ এবং রাজনৈতিক জীবনের বাইরে আলাদা জগৎ নয় ক্রীড়াঙ্গন। রাষ্ট্রীয় জীবনের ঢেউগুলো এ অঙ্গনেও আছড়ে পড়বে আর পরিচিত-অপরিচিত কিছু মুখ ব্যক্তি এবং সমষ্টির এজেন্ডা বাস্তবায়ন মুখ্য হয়ে উঠবে, সেটিই স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে ক্রীড়াঙ্গনে চলমান বিশৃঙ্খলা আর ক্রীড়াচর্চা বাধাগ্রস্ত হওয়াটাও তাই অস্বাভাবিক নয়। একই অভিজ্ঞতা অতীতেও আমাদের হয়েছে।
তবে এবারের ক্ষেত্রে কাউকে কাউকে পরিস্থিতির সঙ্গে স্বাভাবিক লাগলেও কাউকে কাউকে দেখে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। ব্যক্তি আর সমষ্টির স্বার্থের খেলায় রাজনৈতিক মতাদর্শ-নীতি এবং আদর্শ বিসর্জনের পাশাপাশি ফুটবল চত্বরে এখন চলছে রঙ বদলের নানা খেলাও। এতদিন অন্য খোলস ধরে তক্কে তক্কে ছিলেন অনেকেই। রেজিম বদলাতেই তাই আদর্শ আর নৈতিকতার কোনো তোয়াক্কা না করেই ভোল পাল্টে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া। যেন, সুযোগের হাতছাড়া করা যাবে না কিছুতেই। সময়ের অনুসারী না হতে পারলে যেন থাকতে হবে অন্ধকারেই!
তবে ব্যক্তিপূজায় জড়িত ক্রীড়াঙ্গনের এই ভাবমূর্তি কতটা ঠুনকো- সেটি জানেন বলেই নানা শঙ্কায় সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল। অনেক বছর ধরেই কঠিন সময় পার করছে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। অনিশ্চয়তা আর আত্মবিশ্বাসের অভাবে সংকুচিত অগ্রগতির ধারা। বরং, দিনকে দিন আন্তর্জাতিক স্তরে মান গিয়ে ঠেকছে তলানিতে। ফিফা র্যাংকিংয়ে ভুটানেরও পেছনে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছে ফুটবল বাংলাদেশ।
২০১০ সালের পর গত ১৪ বছর সাউথ এশিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ট্রফি ছোঁয়ার সুযোগ পায়নি বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ দল। এরপরও মাঠের বাইরে কতই না খেলা, হইচই, কখনো কখনো আবার আত্মতৃপ্তিতেও ভোগা! হিংসা-বিভাজন, পদে পদে বিরুদ্ধাচরণ, ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব আর কাজের ক্ষেত্রে অনৈক্যের বোঝা বেড়েই চলেছে। এই ফুটবলের উত্তরণ হবে কীভাবে? হবে না। কখনো হয়ওনি।
পাঁচ যুগেরও বেশি সময় পার হলেও ফুটবলসংশ্লিষ্ট মহলের এই চিন্তা-ভাবনা আর মনমানসিকতার পরিবর্তন আসেনি। সংস্কার সাধন এবং সময়ের প্রয়োজনে উদ্যোগের ক্ষেত্রে পরিবর্তন নিয়েও ভাবা হয়নি। ফুটবলে অগ্রাধিকার এবং রোডম্যাপের বিষয়টিও সব সময় অবহেলিত। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বাফুফেকে বিতর্কিত করার পাশাপাশি ফুটবলের উন্নয়ন ব্যবস্থাকে আমলে নেয়া হয়নি প্রতিষ্ঠানটির ভেতর থেকেই। ক্ষমতা ধরে রাখা আর ক্ষমতা দখলের লড়াই তাই কখনোই ফুটবলের মেরুদণ্ডকে শক্ত হতে দেয়নি।
দেশের ফুটবলের প্রধান প্রাণকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। ফিফা এবং এএফসি অনুমোদিত আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ভেন্যুতে চলছে সংস্কারকাজ। ১৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিকায়নের পর এই মাঠে ফের কবে ফুটবল গড়াবে- সেটিও সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। এতদিন ধরে একটি স্টেডিয়াম খেলাবিহীন- এ কথা ভাবা যায়!
ফুটবল ফেডারেশনে অমুকের পদত্যাগ, অমুক নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন কি-না (যদিও বিষয়টি মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার)- সেজন্য কত মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন! বেশ কয়েকজন প্রাক্তন খ্যাতিমান ফুটবলারও প্রকাশ্যে বা আড়ালে জড়িত ছিলেন ওই আন্দোলনে। কই, তাদের নেতৃত্বে পঞ্চাশজন প্রাক্তন ফুটবলার তো বিবৃতি বা মানববন্ধন করে দাবি জানাননি- কাজ শেষ করে দ্রুত ফুটবলের জন্য স্টেডিয়ামটিকে উন্মুক্ত করে দেয়া হোক। যেন আন্তর্জাতিক ম্যাচ হতে পারে।
স্বাধীনতা-উত্তর ৫৩ বছরের ফুটবলের মূল সমস্যা দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি এবং সুশাসনের অভাব। ফুটবল ব্যবহৃত হয়েছে ব্যক্তি এবং সমষ্টির স্বার্থে। পরিচালিত হয়নি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমষ্টিগতভাবে সংযুক্ত করে। ফুটবল কখনো মানবিক হতে পারেনি। কখনো আত্মপ্রকাশ করেনি গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা, সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারায়ও। ফুটবলে পেশাদারিত্ব তৈরি হয়নি, গুরুত্ব পায়নি নীতি-নৈতিকতাও। বরং, খেলাটাকেই অবহেলিত রেখে ব্যক্তি বিশেষের প্রশংসা, আলোচনা, সমালোচনা এবং নিন্দার প্রাধান্য পেয়েছে বছরের পর বছর ধরে।
প্রতিষ্ঠান নষ্ট করে ব্যক্তির এই প্রাধান্য ক্ষতি করেছে ফুটবলকেই। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নেও তাই ব্যর্থ হয়েছে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটি। পূর্ববাংলার বাঙালিদের সুবর্ণময় অতীত থাকলেও স্বাধীন দেশে ফুটবলের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছে মানুষ। এটিই সবচেয়ে দুঃখজনক।
একটি সময় যারা আমাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও গড়তে পারেনি, তাদের সঙ্গেই এখন মাঠের লড়াইয়ে নামার আগে আমরা সংশয় এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগি। কেননা, তারা তো পরিকল্পনামাফিক ফুটবলকে লালন-পালন করে প্রতিদিনই এগিয়ে চলছে- আর আমরা তাদের সমকক্ষ হতে পারছি না। ফুটবল চত্বরে জন-আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে কতটুকু স্পষ্ট জানি না। সাধারণ মানুষ চাচ্ছেন, এত বছরের জঞ্জাল থেকে ফুটবল মুক্তি পাক।
তাদের চাহিদার বাস্তবায়ন হোক সংস্কারে। ফুটবলের এই সংস্কারে প্রয়োজন ঐকমত্য। নীতি এবং যুগোপযোগী সিদ্ধান্তের কঠোর বাস্তবায়ন। এজন্য অবশ্য আপাতত ২৬ অক্টোবর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচনের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে। তার আগে কিছু বলার সুযোগও তেমন একটা নেই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে