চিকিৎসাসেবা ব্যবসা নয়, মানবিক হোক
মানুষ মানুষকে যত প্রকার সেবা দিতে পারে, তার মধ্যে চিকিৎসাসেবাই সবচেয়ে সংবেদনশীল। এ জন্য চিকিৎসার সঙ্গে সেবা শব্দটি যুক্ত, কারণ তা জরুরিভিত্তিতে ও মানবিক দৃষ্টিতে দিতে হয়। ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্য দিতে একটু দেরি হলে সে হয়তো মারা যাবে না, অশিক্ষিত মানুষকে শিক্ষা দিতে একটু দেরি হলেও হয়তো তেমন বড় ক্ষতি হবে না; কিন্তু আহত, অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা দিতে একটু দেরি হলেই প্রাণ হারাতে পারে। তাই চিকিৎসার সঙ্গে সেবা ও জরুরি শব্দ দুটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
কিন্তু বিলের জন্য হাসপাতালে আটকে রাখার ফলে রোগী মারা যাচ্ছে, এমন খবর প্রায়ই আমাদের সামনে আসছে। গতকাল সোমবার (৩ জুন) পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, মানিকগঞ্জে মাত্র ৩ হাজার টাকা বিলের জন্য হাসপাতালে আটকে রাখায় বিনা চিকিৎসায় দেড় বছরের এক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।
খবরে প্রকাশ, রোববার সকাল ১১টার দিকে মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমন ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন ঘিওর থানার ওসি সুকুমার বিশ্বাস। মারা যাওয়া শিশু রেজুয়ান শিবালয় উপজেলার বকচর এলাকার সোহেল গাজীর ছেলে। শ্বাসকষ্টজনিত কারণে শনিবার রাত ২টার দিকে তাকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। শিশুটির স্বজনের অভিযোগ, সঠিক চিকিৎসাসেবা না পাওয়াতে রেজুয়ানের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়। পরে রোববার সকালে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় রেফার করেন মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক।
এ সময় হাসপাতালের বিল ৩ হাজার টাকা রেজুয়ানের সঙ্গে থাকা স্বজন পরিশোধ করতে না পারায় তাদের আটকে রাখা হয়। স্বজনের অভিযোগ, আটকে রাখার সময় রেজুয়ানকে কোনো চিকিৎসা দেয়া হয়নি। কোনোরকম চিকিৎসা না পেয়ে এক পর্যায়ে দুপুরের দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শিশুটি।
এমন ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই আমাদের হৃদয় মুচড়ে উঠেছে। মাত্র ৩ হাজার টাকার জন্য কোনো হাসপাতাল একটি অসুস্থ রুগণ শিশুকে আটকে রাখবে, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা চাই ঘটনার দ্রুত তদন্ত হোক। অভিযুক্তরা দোষীসাব্যস্ত হলে তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক। আর যেন এরকম কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, তার জন্য দৃষ্টান্তমূলক নজির স্থাপন করা হোক।
এর আগেও বেশ কয়েকটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। গত মার্চেই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে নবজাতককে আটকে রেখে বিল আদায়ের অভিযোগ উঠেছিল ডেল্টা হাসপাতালের বিরুদ্ধে। ২০ হাজার টাকায় সিজার করিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে তিন দিন পর প্রায় দুই লাখ টাকা বিল ধরিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে গণমাধ্যমের সরব উপস্থিতির কারণে দেশের মানুষ হাসপাতালটির দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসার কথা জানতে পারে। রোগী আটকে রেখে ইচ্ছে করেই তারা বড় অঙ্কের বিল ধরিয়ে দিত।
চিকিৎসাসেবা প্রদানের নামে দেশের আনাচে-কানাচে এখন ব্যাঙের ছাতার মতো বহু হাসপাতাল গড়ে উঠছে। এর বেশির ভাগই ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। অকারণে টেস্ট দিয়ে, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে, দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি রেখে তারা রোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেন।
এ কারণে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে দেশের জনগণ। এ আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে সরকারকেই। এসব অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে চিকিৎসা-ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা কোনোদিনও ফিরে আসবে না। আর তা শুরু করতে হবে এখনই, জরুরিভিত্তিতে। গুরুতর রোগীর মতো বাংলাদেশের চিকিৎসা-ব্যবস্থাই আজ রুগণ হয়ে গেছে। রোগীর চিকিৎসার আগে তাই চিকিৎসা-ব্যবস্থারই চিকিৎসা জরুরি। আমরা চাই, চিকিৎসাসেবা ব্যবসা নয়, মানবিক হোক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে