‘হামজা উন্মাদনা’ মাঠেও অনূদিত হোক
ফিফা র্যাঙ্কিংকে মানদণ্ড ধরলে এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ‘সি’ গ্রুপের তলানিতে অবস্থান বাংলাদেশের। লাল-সবুজদের ঘিরেই আবার কেউ কেউ তলানি থেকে উঠে আসার স্বপ্ন দেখছেন। সেটা হামজা চৌধুরীর উপস্থিতির কারণে। ফুটবলের এ প্রত্যাশার সঙ্গে কেন যেন মিলে যাচ্ছে ক্রিকেট। বৈশ্বিক মেগা আসরের আগে বরাবরই ভালো করার প্রত্যয় থাকে টাইগারদের, সমর্থকদের কেউ তো আগ বাড়িয়ে সেমিফাইনালের স্বপ্নও দেখেন! বাস্তবতার জমিনে মিনোসদের কাছে হেরে মাথানত করে মাঠ ছাড়তে হয়! বিবেককে একপাশে তুলে রেখে আবেগ দিয়ে সবকিছু বিচার করা হয় বলেই বোধকরি বারবার আশাহত হতে হচ্ছে।
ফুটবলের ক্ষেত্রে এমনটা হবে- এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ নিকট অতীতে বাংলাদেশ যে ব্র্যান্ডের ফুটবল খেলেছে, তা ছিল ইতিবাচক। সে ইতিবাচক ফুটবলের সঙ্গে হামজা চৌধুরী এবং ফাহমিদুল ইসলামের অন্তর্ভুক্তি যদি ক্লিক করে বসে- ভালো কিছুর প্রত্যাশা করতে দোষ কোথায়! এ অবস্থায় বাংলাদেশি সমর্থকদের ভালো কিছুর প্রত্যাশা করাটাই বরং নিরাপদ। কারণ হংকং, সিঙ্গাপুর ও ভারতকে টপকে এশিয়ান কাপে জায়গা করে নেয়ার প্রত্যাশা করাটা বোধকরি আবেগ মাখা, বিবেকসম্মত হবে না।
বাংলাদেশের হয়ে ভারতের বিপক্ষে এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই খেলতে ১৭ মার্চ দেশে এসেছেন হামজা চৌধুরী। শেফিল্ড ইউনাইটেডে লোনে খেলা লেস্টার সিটির এ মিডফিল্ডারকে বরণ করতে ছুটে গিয়েছিলেন ফুটবলামোদি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) কর্মকর্তা এবং সিলেটের উৎসুক জনতা। ২৭ বছর বয়সী এ ফুটবলারকে বরণের জন্য আয়োজিত সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান রূপ নিয়েছিল গণসংবর্ধনায়। তাতে আপ্লুত হামজা চৌধুরীও, যার বহিঃপ্রকাশ সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বলা, ‘উইন করিয়া প্রোগ্রেস করতে পারমু’ কথাতে।
তিনি বোঝাতে চেয়েছেন এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাইয়ের ‘সি’ গ্রুপ থেকে মূল পর্বে নাম লেখাবে বাংলাদেশ। এ জন্য হংকং, সিঙ্গাপুর ও ভারতকে টপকে ‘সি’ গ্রুপের শীর্ষে বসতে হবে। কাজটা যে কতটা কঠিন- ফুটবলের নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখা ব্যক্তিরা বুঝতে পারছেন। কঠিন কাজটা করতে হলে বাংলাদেশকে এমন ফুটবল খেলতে হবে, যেমনটা বিগত কয়েক বছর দেখা যায়নি। লাল-সবুজদের মিশন শুরু হচ্ছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের প্রধান শহর শিলং থেকে, ২৫ মার্চের ম্যাচ দিয়ে। এ ম্যাচ দিয়ে একটা চক্র শুরু হচ্ছে। ৬ ম্যাচের চক্রটা শেষ হবে ২০২৬ সালের ৩১ মার্চ সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে অ্যাওয়ে ম্যাচ দিয়ে।
সে চক্র শেষে বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়ায়- সময়ই বলতে পারে। আপাতত হামজা চৌধুরীকে বরণ, দলের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক নানা দিক নিয়ে আলোচনা চলছে। সে আলোকে ফুলানো হচ্ছে প্রত্যাশার বেলুন। হুজুগে যারা হামজাকে নিয়ে মেতেছেন, তাদের প্রত্যাশা এ ফুটবলার সোনার হরিণ এনে দেবেন- যা বাস্তবতা বিবর্জিত ভাবনা। সাবেক ফুটবলাররা বরাবরই বলছেন, ‘ভালো করতে হলে বাংলাদেশ দলকে একটা ইউনিট হয়ে উঠতে হবে। হামজা চৌধুরীকে হয়ে উঠতে হবে টিম প্লেয়ার।’ বাংলাদেশের মতো ফুটবলে পিছিয়ে থাকা জনপদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইংলিশ ফুটবলের আধুনিক ধ্যান-ধারণায় বেড়ে ওঠা হামজা কতটুকু মানিয়ে নিতে পারবেন- এ নিয়ে সংশয় তো থাকছেই। আসলে সংশয় কিংবা প্রাপ্তি- হিসাবটা পরে মেলানো যাবে। আগে হামজা চৌধুরীকে ঘিরে ফুটবলামোদিদের উৎসব-উচ্ছ্বাসের চিত্রগুলো ঘুরে দেখে আসা যাক।
শেফিল্ড ইউনাইটেড ও শেফিল্ড ওয়েডনেসডে একই শহরের দুই ক্লাব। দক্ষিণ ইয়র্কশায়ারের এ শহর স্টেইনলেস স্টিলের জন্য প্রখ্যাত। এ কারণে শেফিল্ড শহরের দুই ক্লাবের দ্বৈরথকে ‘স্টিল সিটি ডার্বি’ বলা হয়। ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাওয়ার কারণ হলো ‘স্টিল সিটি ডার্বি’ শেষ করে মাঠ থেকেই বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন হামজা চৌধুরী। শেফিল্ড ওয়েডনেসডের বিপক্ষে ১-০ গোলের জয়ের পর সতীর্থদের সঙ্গে মাঠে উৎসব করেছেন হামজা চৌধুরী। ডার্বি জয়ের পর উৎসব প্রত্যাশিতই ছিল; যার মাধ্যমে চ্যাম্পিয়নশিপের টেবিলের শীর্ষে থাকা লিডসের সঙ্গে পয়েন্ট সমান হয়েছে, এ কারণে বোধকরি চলতি লিগে ক্লাবটির ২৫তম জয়ের পর উৎসবটা আরও রঙ পেয়েছিল।
হিলসবরো স্টেডিয়ামের পর সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও উৎসব দেখলেন হামজা চৌধুরী। মাঝে ৪ হাজার ৯৮০ মাইল দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল সইতে হয়েছে। সিলেটে বিমানবন্দরে হামজা চৌধুরীকে বরণ করতে হাজির হয়েছিলেন হাজারো উৎসুক জনতা। ফুটবলামোদি, স্থানীয় উৎসুক জনতা, নিরাপত্তারক্ষী, ইউটিউবাররা মিলে এমনই আবহ তৈরি করলেন; হামজা চৌধুরী আর নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারলেন না।
করবেন কী করে? ভিড়ের মধ্যে প্রশ্নই শুনতে পাচ্ছিলেন না ২৭ বছর বয়সি এ ফুটবলার। যতটুকু শুনেছেন, তার উত্তরও গণমাধ্যম কর্মীদের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেন না। ভিড়-হট্টগোলের মাঝে যা শোনা গেল, তাতে হামজা চৌধুরীর মুখে শোনা গেল, ‘এখানে আসতে পেরে আমি ভীষণ খুশি’, যার বহিঃপ্রকাশ ছিল এ ফুটবলারের হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে। বিমানবন্দরে নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাফুফে কর্মকর্তারা হামজা চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিদায় দেন। ছাদ খোলা গাড়িতে করে বিমানবন্দর থেকে হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট গ্রামের পৈতৃক ভিটার উদ্দেশ্যে রওনা হন এফএ কাপ, এফএ কমিউনিটি শিল্ড এবং ইএলএফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী এ ফুটবলার।
বেলা পৌনে ১২টায় বিমানবন্দরে অবতরণের পর সিলেটের নানা আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাতে বেজেছে বিকেল পৌনে ৪টা। স্নানঘাটে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় আপ্লুত হয়েছেন ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২১ দলের হয়ে সাত ম্যাচ খেলা হামজা চৌধুরী। হাজারো মানুষ ছুটে এসেছিলেন এ ফুটবলারকে এক নজর দেখতে। স্নানঘাটে আয়োজন করা হয়েছিল সংবর্ধনা সভার। সাংস্কৃতিক নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফুলেল শুভেচ্ছায় হামজা চৌধুরীকে বরণ করে নেয়া হয়।
হামজা চৌধুরীকে ঘিরে স্থানীয়দের নানা আয়োজনের আবদার ছিল; কিন্তু এ ফুটবলারের বাবা মোরশেদ দেওয়ান চৌধুরী আয়োজকদের নিরুৎসাহিত করেন। দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল এবং পারিবারিক নানা আয়োজনের কারণে বিভিন্ন আয়োজন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। দেশে পা রাখার দিন স্নানঘাটে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ইফতার করেছেন হামজা চৌধুরী। স্ত্রী অলিভিয়া চৌধুরী এবং তিন সন্তানকে নিয়ে ১৭ মার্চ রাতে গ্রামের বাড়ি স্নানঘাটেই অবস্থান করেছেন হামজা চৌধুরী।
লেস্টার সিটির হয়ে মাঝ মাঠে খেলা হামজা চৌধুরীকে শেফিল্ড ইউনাইটেডের হয়ে কখনো রক্ষণ, কখনো মাঝ মাঠে খেলতে দেখা যায়। সর্বশেষ ম্যাচ ছিল ‘স্টিল সিটি ডার্বি’, যেখানে হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে পুরো ম্যাচ খেলেছেন। দলের আক্রমণে রসদ জোগানোর পাশাপাশি কয়েকটি দারুণ ব্লকও করেছেন এ ফুটবলার, যার অন্তর্ভুক্তিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলেও আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু বলছেন, এ ফুটবলারকে ভালো সতীর্থ হয়ে উঠতে হবে। সাবেক তারকার কথায়, ‘সন্দেহ নেই হামজা চৌধুরীর অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক দিক; কিন্তু ফুটবল তো টিম গেম। এখানে ভালো করতে হলে গোটা দলকেই খেলতে হবে। হামজা চৌধুরী যত দ্রুত সতীর্থদের সঙ্গে মিশে যেতে পারবেন, ভালো সতীর্থ হয়ে উঠতে পারবেন; ততই মঙ্গল।’
হামজা চৌধুরীর সঙ্গে জাতীয় দলে অভিষেকের প্রতীক্ষায় আছেন ইতালিপ্রবাসী ফাহমিদুল ইসলাম। তাদের নিয়ে জাতীয় দলে প্রবাসী ফুটবলার সংখ্যা পাঁচ-এ উন্নীত হলো। ডেনমার্কে বেড়ে ওঠা জামাল ভূঁইয়া, ফিনল্যান্ডে বেড়ে ওঠা তারিক রায়হান কাজী, কানাডায় বেড়ে ওঠা সৈয়দ কাজেম শাহ কিরমানী জাতীয় দলে খেলছেন। তাদের সঙ্গে আক্রমণভাগে দেখা যেতে পারে ইতালির পেশাদার লিগ সিস্টেমের চতুর্থ স্তরের ক্লাব ওলবিয়া কালসিওর হয়ে খেলা ফরোয়ার্ড ফাহমিদুল ইসলামকে।
মাঝ মাঠে জামাল ভূঁইয়া-সৈয়দ কাজেম শাহ কিরমানীর সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারলে বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল। তাদের পেছনে রক্ষণ সামলানোর কাজ করবেন তারিক রায়হান কাজী। ফুটবলে টিম গেমই শেষ কথা। তাই প্রবাসীদের পাশে মিতুল মারমা, তপু বর্মণ, রাকিব হোসেন, শেখ মোরসালিনদের ভুলে বসলে কিন্তু চলবে না। বাংলাদেশের ভালো করার যে প্রত্যাশা, তা পূরণ করতে হলে গোটা দলকে একটি ইউনিট হয়ে উঠতে হবে। হামজাকে ঘিরে বাইরে যে উন্মাদনা দেখা গেল, সেটা মাঠেও অনূদিত হোক!
মাহবুব সরকার: লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে