Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

মহান বিজয় দিবস

তারুণ্যের শক্তি হোক স্বাধীনতার মূলমন্ত্র

Jatin  Sarker

যতীন সরকার

সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

জীবনে অভিজ্ঞতার ঝুলি তো আর কম ভারী নয়। নিজ চোখে ব্রিটিশ শাসনামল দেখেছি। দেখেছি পাকিস্তান শাসনামলের অপশাসন। পাকিস্তানের জন্ম যেমন দেখেছি, তেমন দেখেছি তার মৃত্যুও। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে প্রবল বিক্রমে ছিনিয়ে আনা স্বাধীনতার গতিবিধি দেখেছি। স্বাধীন দেশে বুক পেতে নিঃশ্বাস নিয়েছি। তাই বিজয়ের মাস নিয়ে লিখতে গেলে কলমের ডগায় অসংখ্য স্মৃতি জমা হয়।

এরই মধ্যে বিজয়ের ৫৪ বছর পালন করেছি আমরা। ৫৩ বছর পর আমাদের বিজয়ের যে প্রাপ্তি- এটা বলে শেষ করা যায় না। ‘বিজয়’ নিজেই একটা প্রাপ্তি।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর স্বপ্ন ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অপদর্শনের অবসান এবার ঘটবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি, পাকিস্তান মরে গিয়েও আমাদের ওপর যেন ভূত হয়ে চেপে বসে ছিল। গ্রাম বাংলায় একটি কথা রয়েছে, মানুষ মরে ভূত হয়। রাষ্ট্রও যে মরে ভূত হতে পারে, তা নিজের চোখে দেখেছি পঁচাত্তরে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে তারই নেতৃত্ব ও ডাকে স্বাধীনতা অর্জনকারী জাতি অসাম্প্রদায়িক দেশে স্বাধীনতার চেতনার বিসর্জন দেখাল কতিপয় স্বজাতদ্রোহীর অবিমৃষ্যকারীতায়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো পাকিস্তানপন্থি উগ্রবাদীরা।

পাকিস্তানের মিত্রশক্তির কাছে নতুন ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে বাংলাদেশ। পাকিস্তান মরে গিয়েও ভূত হয়ে চেপে বসে ছিল। খন্দকার মোশতাকের ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের খোলসে পাকিস্তানি শাঁস পুরে দেয়ার চেষ্টা দীর্ঘদিন অব্যাহত ছিল। তার পরও মানুষের প্রত্যাশা ফুরোয় না। মানুষ আরও প্রত্যাশা করে। বারবার স্বপ্নভঙ্গের মাঝেও এ প্রত্যাশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আমিও প্রত্যাশা করেছি। বাঁচিয়ে রেখেছি নিজের মনোলোকে সুপ্ত প্রত্যাশা। বড় প্রত্যাশা, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার অনুসারে অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ।

আমাদের সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা-এ চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যদি আমরা বৈষম্যর নিরসন করতে চাই তাহলে এ চারটি মূলমন্ত্রের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত করতে হবে। রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা করা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উপেক্ষা করে। এমনটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের মূল চেতনার বিষয়ে আমাদের এ দ্বিধা দূর করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। স্বাধীন দেশে তরুণ প্রজন্ম নেতৃত্বের দায়িত্ব নেবে তা অন্যতম প্রত্যাশা। আর এ প্রত্যাশা পূরণের জন্যই দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছি।

অনেক শিক্ষার্থীকে শিখিয়েছি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হতে। দেশ, জাতি, আদর্শ ও বিজয়ের মূল্যবোধ তাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি সব সময়। সাক্ষরতার হার বেড়েছে। বেড়েছে শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। কিন্তু বিজয়ের মূল্যবোধ দ্বারা চালিত তরুণ প্রজন্মের অভাব ভীষণভাবে বোধ করি। আজও প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য যেমন বিপুলসংখ্যক নির্মোহ রাজনীতিকের প্রয়োজন ছিল, তেমনটি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় না, এটা কষ্টের বিষয় বৈকি।

তারপরও দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধীরা আমাদের সংবিধানকে যেভাবে কাটাকুটি করে নষ্ট করে দিয়েছিল। সেই পুরো সংবিধানটিকে তারা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। তাই সংবিধান সংস্কার করতে হলে এই বিষয়টি সবার আগে মনে রাখতে হবে। আমাদের মধ্যে রাষ্ট্র ধর্ম বলে এখনো একটা ধর্ম বজায় আছে। আবার বলা হয়েছে আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্রের কথা। এই যে গোঁজামিল, এই গোঁজামিলের অবসান না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃতভাবে আমাদের বিজয়ের যে ফল সেটা সবার ঘরে পৌঁছবে না।

কাজেই জাতিকে সংহত করার জন্য আমাদের মালিকানার মূল দলিল, অর্থাৎ ৭২-এর সংবিধানকে ভেজালমুক্ত করে গ্রহণ এবং তার ঘনিষ্ঠ অনুসরণকে এই মুহূর্তের প্রধান কাজ বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রবর্তনকালে ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল যে, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা নিষিদ্ধ করা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান না করা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার বন্ধ করা, কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারীর প্রতি বৈষম্য বা তার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হবে। ১৯৭৮ সালের দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র আদেশ দ্বারা উক্ত অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা হয়। প্রয়াত বিচারপতি চিন্তক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রণীত ‘যার যার ধর্ম’ কোষ গ্রন্থে রাষ্ট্রধর্ম সম্পর্কে যে আলোকপাত তিনি করেছেন সেখান থেকে উদৃত করছি। সংবিধান প্রবর্তনকালে ৩৮ অনুচ্ছেদে যে সাংগঠনিক স্বাধীনতার কথা বলা হয়, সেখানে একটি শর্ত ছিল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সংবলিত বা লক্ষ্য হিসেবে ধর্মীয় নাম যুক্ত বা ধর্মভিত্তিক কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করার বা তার সদস্য হওয়ার বা অন্য কোনো প্রকারে তার তৎপরতার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকবে না।

১৯৭১ সালে এদেশের যে তরুণেরা লড়াই করেছিল পাকিস্তানি হায়েনাদের মুখোমুখি অসীম সাহসী যোদ্ধা রূপে, সেই ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের কথা জানা প্রয়োজন তরুণদের। না হলে শত্রুকে জানতে পারবে না। তরুণের দল যখন দেশের মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস জানবে তখন নিজস্ব চেতনা জাগ্রত হবে তরুণদের মধ্যে।

ফলে তারা দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করবে। একদিকে শিক্ষায় এগিয়ে যাবে একালের তরুণ যোদ্ধারা, আরেকদিকে স্বাধীনতার যে সফলতা, তারও দিকে অগ্রসর হতে থাকব আমরা।

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে আমরা আর তলাবিহীন ঝুড়ি নই। আমাদের উৎপাদন বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয়, মাথাপিছু আয় বাড়ার মধ্য দিয়ে কার কার মাথা এখানে যুক্ত হয়েছে, কত শতাংশ মানুষ কত শতাংশ সম্পদ ভোগ করছে, এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এগুলো নিয়ে কথাও হচ্ছে অনেক। এই যে বৈষম্য, এই বৈষম্য নিরোধ না করা পর্যন্ত প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের স্বাধীনতার আসল মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা হবে না। কাজেই সেই বৈষম্য বিলোপ চাই; বৈষম্য বিলোপের জন্য সমাজতন্ত্রকে লক্ষ বিন্দুতে রেখে, সমবায়কে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে আমাদের নতুনভাবে এগিয়ে যেতে হবে এবং পাকিস্তানের ভূতরা যে আমাদের পেছনে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে, সেখান থেকে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।

এই অবস্থা থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই। পরিত্রাণ কে করবে? আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আমাদের অনেক দায়িত্ব আছে। আমাদের তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তরুণদের একটি অংশ যদিও সেক্যুলার চিন্তাভাবনা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি একে বাধা মনে করি না। আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রে উত্তরণ পর্বেও তরুণদের একটি অংশে স্বাধীনতার বিরুদ্ধশক্তি বিদ্যমান ছিল। পথের তরুণদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদি আবার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে দেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবে।

যতীন সরকার: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ