নারী ফুটবল
রক্তক্ষরণ বন্ধের পর ক্ষতটাও শুকিয়ে যাক!
শরীরের কোনো অঙ্গ কেটে গেলে, রক্তপাত হলে দূর্বাঘাস চিবিয়ে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয়াটা ছিল আমাদের শৈশবের কার্যকরী প্রাথমিক চিকিৎসা। দেশের নারী ফুটবলে রক্তক্ষরণ হলো, ক্ষতস্থান থেকে সংক্রমণের অবস্থা তৈরি হলো; জল অনেকদূর গড়াল- প্রাথমিক চিকিৎসার লক্ষণ কিন্তু দেখা গেল না। ১৮ সিনিয়র ফুটবলার একাট্টা হয়ে কোচ বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন, বিষয়টি তিক্ততা ছড়ানোর মাধ্যমে ইতিবাচক নারী ফুটবল নেতিবাচক হয়ে উঠল। ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নারী বিভাগের প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণের ঘোষণার পর মনে করা হচ্ছে, নারী ফুটবল-সংক্রান্ত সংকটের কালো মেঘ কেটে গেছে। সেটা আদৌ কতটুকু কাটল বুঝতে হলে আরও অপেক্ষায় থাকতে হবে। কারণ এখনো কিছু বিষয়ে জটিলতার আশঙ্কা কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
প্রথমত, মধ্যবর্তী অচলাবস্থায় সৃষ্ট ক্ষত দ্রুতই শুকিয়ে যাওয়ার কথা নয়। দ্বিতীয়ত, কোচ পিটার বাটলার এবং ১৮ সিনিয়র ফুটবলার- দুপক্ষই কিন্তু পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। বাফুফে কর্মকর্তাদের মধ্যস্থতায় দুপক্ষকে মিলিয়ে দেয়া যাবে ঠিকই। এ-সংক্রান্ত তিক্ততা দূর করবেন কি দিয়ে! ব্রিটিশ কোচের অধীনে অনুশীলন করতে এবং খেলতে গেলে সিনিয়র নারী ফুটবলারদের ফের জটিলতায় জড়ানোর আশঙ্কা আপনি কীভাবে উড়িয়ে দেবেন! মেয়েদের বিষয়গুলো কোচ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবেন কি না- এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। কোচের বিভিন্ন নির্দেশনা মেয়েদের কাছে প্রতিশোধমূলক মনে হওয়াটা অবান্তর নয়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যা শেষ হয়ে গেছে- এমনটি ভাবার সময় কিন্তু এখনো আসেনি।
২০২২ সালের সাফ মুকুট মাথায় তুলল মেয়েরা। ২০২৪ সালে প্রতিকূলতার মধ্যেও সেটা ধরে রাখা গেছে। সে আসরের মাঝপথেই কোচ-খেলোয়াড় জটিলতা প্রকাশ্যে রূপ নিল। সে জটিলতার লাগাম না টেনে পিটার বাটলারকেই কোচ হিসেবে পুনরায় নিয়োগ দেয়ার কারণে দায়টা পুরোপুরি বাফুফের। নারী ফুটবলের সার্বিক বিষয় দেখভাল করার দায়িত্ব যেহেতু নির্দিষ্ট একটি কমিটির। সে হিসেবে দায়টা মাহফুজা আক্তার কিরণের নেতৃত্বাধীন নারী বিভাগের ওপর বর্তায়। যদিও জটিলতা অবসান হওয়ার ঘোষণা দেয়ার দিনে মাহফুজা আক্তার কিরণ নিজে সে দায় চাপিয়েছে জরুরি সভার ওপর। নারী বিভাগ থেকে না কি পিটার বাটলারকে কোচ হিসেবে নিয়োগ না দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। মাহফুজা আক্তার কিরণের দাবি যদি সঠিক হয়ে থাকে, তবে ব্রিটিশ এ কোচকে নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে বাফুফের শীর্ষ কর্তারা নারী বিভাগকে উপেক্ষা করেছে। এখানে তো দেখছি আরেক জটিলতার বীজ বপন করা আছে!
আসলে এখানে দায়টা কার- খুঁজতে গেলে তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। সে কমিটি কেন প্রতিবেদন দিচ্ছে না- কারণ অনুসন্ধানে আরেকটি কমিটি গঠন করতে হবে। এভাবে কমিটির পর কমিটি হবে, শেষ পর্যন্ত মিলবে অশ্বডিম্ব! বিভিন্ন ঘটনার আলোকে দেশের নানা সেক্টরের চিত্র কিন্তু তেমনটাই ইঙ্গিত করছে। কারণ এ দেশে জবাবদিহির বড্ড অভাব, দোষ স্বীকারের প্রবণতা নেই বললেই চলে। তাই ধারাবাহিকভাবে সাফল্য এনে দেয়া নারী ফুটবলে অস্থিরতার প্রকৃত কারণটা অজানাই থেকে যাবে। ঘটনার শুরু থেকে পুরো বিষয়টাতে ছিল লেজে-গোবরে অবস্থা। কারণ কোচ-ফুটবলার দ্বন্দ্ব ফুটবল দুনিয়ার কমন অসুখ। এ অসুখ থেকে উপশমের কার্যকরী উপায় হচ্ছে, পেশাদারি মনোভাব। সেটা যেমন ফুটবলাররা দেখাতে পারেননি, পেশাদারি আচরণ ছিল না পিটার বাটলারেরও। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পেশাদারিত্ব দেখাতে পারেননি বাফুফে কর্মকর্তারাও।
ফুটবলের পেশাদারি দুনিয়ায় কোচের মর্জিই শেষ কথা; কিন্তু বাংলাদেশের মতো পেশাদারি মোড়কে ঢাকা পুরো অপেশাদার কাঠামোতে সে মর্জি পুরোপুরি খাটে না। পিটার বাটলারের খণ্ডকালীন দায়িত্ব গ্রহণের পর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জটিলতা বেড়েছে। তার লাগাম টেনে ধরা যেত আরও আগেই। জটিলতার লাগাম টেনে ধরতে পারতেন কোচ নিজেও। ফুটবলারদের ডেকে নিজের পরিকল্পনা জানাতে পারতেন, নিজের দর্শন নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে পারতেন। তখন ফুটবলারদের কাছে পরিষ্কার বার্তা থাকত যে, আমাদের আসলে করণীয় কি। তাতে সময়ের সঙ্গে জটিলতা না বেড়ে বরং দলের অভ্যন্তরে সুস্থ প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেত। নারী ফুটবলের যে দুরবস্থা দেখা গেল সাম্প্রতিক সময়ে, চিত্রটা কিন্তু তার উল্টো হতে পারত।
নানা নেতিবাচক বিষয় এবং সাম্প্রতিক জটিলতার ইস্যুতে জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে বটে! ভবিষ্যৎ বড় জটিলতা এড়াতে অতীতের ভুলগুলো নিয়ে এখনই ভাবা উচিত। নানা বিষয়ে কোচ, খেলোয়াড়, কর্মকর্তাদের খোলামেলা কথা বলা জরুরি। মাহফুজা আক্তার কিরণ অবশ্য তেমন উদ্যোগের কথা জানিয়ে রেখেছেন। মধ্যবর্তী ঘটনাকে ভুল বোঝাবুঝি হিসেবে উল্লেখ করেছেন ফিফার সাবেক এ কাউন্সিল মেম্বার। উদ্যোগ সম্পর্কে মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেছেন, ‘মেয়েরা পিটার বাটলারের অধীনে অনুশীলনে ফিরবে। দল আরব আমিরাতে যাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি। আমিরাতে যাওয়া ফুটবলারদের বাদ দিয়ে যারা থাকবে, তাদের ছুটি দেয়া হবে। ছুটির পর মেয়েরা জাতীয় দলের ক্যাম্পে ফিরবে। তখন কোচ, খেলোয়াড় এবং বাফুফে কর্মকর্তারা বসে আলোচনা করবেন, যাতে ভবিষ্যতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়।’ কথিত ‘ভুল বোঝাবুঝি’ যাতে না হয়, এ জন্য নেয়া উদ্যোগটা কার্যকরী হোক- দেশের ফুটবলামোদিরা কিন্তু সে প্রত্যাশা করছেন।
এদিকে নারী ফুটবলে ঘটে যাওয়া মধ্যবর্তী ঘটনায় রাতারাতি সাবিনাদের ভিলেনে পরিণত করেছে। এ নিয়ে সাবিনা খাতুন, মাসুরা পারভিন, ঋতুপর্ণা চাকমা এবং মাতসুশিমা সুমাইয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে এখনও হচ্ছেন। জাপানে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি ফুটবলার মাতসুশিমা সুমাইয়াকে তো প্রাণনাশ এবং ধর্ষণের হুমকিও দেয়া হয়েছে। যে কারণে আইনের আশ্রয় নিতে হয়েছে ২৩ বছর বয়সি এ ফুটবলারকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী ফুটবলারদের যারা একহাত নিয়েছেন, তাদের দাবি ছিল সাবিনা খাতুনই নাটের গুরু। গ্রুপিংয়ের উৎপত্তিও নাকি দেশের নারী ফুটবল ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্রকে দিয়ে। এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ নারী লিগে প্রসঙ্গও টানা হয়েছে। লিগের আগে সাবিনা খাতুন না কি সতীর্থদের নিয়ে জোট করেছিলেন। তাদের দাবি ছিল ১৫ লাখ টাকার কমে কোনো ফুটবলার সাইন করবেন না।
অনেকে দাবি করেন, ১৫ লাখ টাকার নিচে কোনো ফুটবলার সাইন না করার ইস্যুতে গড়া অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কারণেই না কি নারী ফুটবল লিগ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে বসুন্ধরা কিংস। হালের পরাশক্তিরা নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার পর নারী লিগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। শেষপর্যন্ত নাসরিন স্পোর্টিং ক্লাব জাতীয় দলের শীর্ষ ফুটবলারদের দলভুক্ত করার মাধ্যমে লিগ মাঠে গড়িয়েছে বটে। তাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ কিন্তু তেমন ছিল না। ছিলনা পেশাদারিত্বের ছোঁয়াও। যে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলে খাবি খাওয়া ভুটানের ক্লাব এএফসির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলেও বাংলাদেশের কোন ক্লাবের সে সুযোগ হয়নি। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর উপলক্ষ ছিল রয়্যাল থিম্পু কলেজ এফসির হয়ে সাবিনা খাতুন, ঋতুপর্ণা চাকমা, মারিয়া মান্ডা ও মনিকা চাকমার এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রাথমিক পর্বে অংশগ্রহণ। যদিও প্রাথমিক পর্বের গণ্ডি পার হতে পারেনি চার বাংলাদেশি ফুটবলার সমৃদ্ধ ভুটানি ক্লাবটি। দুই ম্যাচে ক্লাবটির করা একমাত্র গোল ছিল ঋতুপর্ণা চাকমার।
ধান ভানতে শিবের গিত রেখে আবারও মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ফুটবলামোদি সাবিনা খাতুনদের কাঠগড়ায় তুলে যে দাবি করেছেন, তা সঠিক না ভুল- প্রমাণ করা কঠিন। এটাও প্রমাণ করা অসম্ভব- সাবিনারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য সিন্ডিকেট করছেন। চুইংগাম যেমন চিবিয়ে শেষ করা যায় না; এসব আলোচনারও শেষ লাইন খুঁজে পাওয়া তেমন অসম্ভব। সে কঠিন কাজটা না করে ফুটবলামোদি, ফুটবলার, কোচ, বাফুফে কর্মকর্তা- সকলে এক রেখায় এসে দাঁড়ালে নারী ফুটবলকে সংক্রান্ত স্বপ্নটা পূর্ণতা পাবে। নারী ফুটবল সংক্রান্ত স্বপ্নটা কি জানেন তো? সেটা হচ্ছে, এশিয়ান পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করা। অনূর্ধ্ব-১৭ বয়সি বিভাগে বাংলাদেশ দুই দফা এশিয়ান মঞ্চে পা রেখেছিল। সেটা সাবিনা খাতুন ছাড়া বর্তমান সিনিয়র জাতীয় দলের ফুটবলারদের হাত ধরে। কৃষ্ণা রানী সরকার, মনিকা চাকমা, মারিয়া মান্ডা, সানজিদা আক্তার, ঋতুপর্ণা চাকমা জানেন সে মঞ্চের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাত্রা কতটা তীব্র।
দুই দফা এশিয়ার শীর্ষ আট-এ জায়গা করে নেওয়ার অভিজ্ঞতা আগামী প্রজন্মের মাঝে বিলিয়ে দেয়া, আগামী প্রজন্মকে সেভাবে প্রস্তুত করা কৃষ্ণা রানী সরকারদের দায়িত্ব। সে দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করবেন কৃষ্ণারা। আবার বয়সভিত্তিক সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সেরার মঞ্চে দুই দফা তুলে ধরা সাবিনা-কৃষ্ণাদের যথাযথ সম্মান দেয়াটা ফুটবল নিয়ন্তাদের দায়িত্ব। ২০১৪ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ (দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চল) চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমে সাফল্যর যে ধারার সূচনা হয়েছে, সেটা কিন্তু এখনো চলছে। দেশকে ধারাবাহিক সাফল্য এনে দেয়া ফুটবলারদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখাটা দর্শক-সমর্থকদেরও দায়িত্ব। দেশের ফুটবল সংশ্লিষ্ট সবাই পেশাদারি মনোভাব এবং যৌক্তিকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করলে তা সবার জন্যই সুফল বয়ে আনবে।
সংশ্লিষ্টরা শিকার করুক আর নাই করুক- গত একযুগের বেশি সময় ধরে দেশের ফুটবলের পাইপলাইনে তরুণ ফুটবলার সরবরাহের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল বালক ও বালিকা বিভাগে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে আয়োজিত দুটি প্রতিযোগিতা। রাষ্ট্র ক্ষমতায় পালা বদলে অনেক জায়গায় পরিবর্তন এসেছে। সে পরিবর্তনের হাওয়ায় অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে নতুন কিছু। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর আয়োজিত ক্ষুদে ফুটবলারদের দুটি প্রতিযোগিতা হারিয়ে গেলে কিন্তু বিপদ! দেশের নারী ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ের জটিলতা দূর করা খুবই জরুরি, জরুরি তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায়ের পাইপলাইন সচল রাখতে সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত প্রচেষ্টা। নইলে কিন্তু পথ হারাতে পারে দেশের নারী ফুটবল!
মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে