গণপিটুনির বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ তৈরি হোক
ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দিনে দুজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে একদল শিক্ষার্থী। আর জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতাকে কয়েক দফা মারধর করে হত্যা করা হয়। এদিকে খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মোহাম্মদ মামুন নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বুধবার ভোরের এ ঘটনার জের ধরে গতকাল দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন জায়গায় ‘মব জাস্টিস’ (উচ্ছৃঙ্খল জনগোষ্ঠীর বিচার) চলতে দেখা যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার আহ্বান জানানো হলেও কেউ নিষেধ শুনছে না। এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ, যা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবেই গণ্য করা হয়ে থাকে। গণপিটুনির ঘটনা সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। যারা নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করছেন, তারা তৎক্ষণাৎ তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি কোনো আস্থা না রেখে এসব ঘটনা ঘটিয়ে চলেছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ না করে হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিচারে দোষীসাব্যস্ত হওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিটি ব্যক্তি নির্দোষ বলে প্রতীয়মান হওয়ার অধিকার রাখেন। তা ছাড়া প্রতিটি মানুষের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার সংবিধানে স্পষ্টভাবে স্বীকৃত রয়েছে। উন্মত্ত আবেগের একটা সীমা থাকা দরকার। যারা সমাজে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত, যাদের কারণে সমাজ-রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-আক্রোশ থাকা হয়তো স্বাভাবিক; কিন্তু সে আবেগে সমস্ত হিতাহিত ভুলে উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারি না। মধ্য জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের নির্দেশে পুলিশের গুলিতে যারা মারা গেছেন, তাদের প্রকৃত সংখ্যা এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। সংখ্যা যাই হোক, সেই সময় পুলিশের গুলিতে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের হত্যার বিচার করতে হবে।
প্রতিটি হত্যাকাণ্ডকে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। কে, কার গুলিতে বা কীভাবে মরল, তা খুঁজে বের করা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করে ভবিষ্যতে কেউ আর মানুষ হত্যা করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা না করে। একই সঙ্গে ৫ আগস্টের পর থেকে বিক্ষুব্ধ জনতার নামে সন্ত্রাসী কায়দায়, উলঙ্গ করে, পা ঝুলিয়ে যাদের মেরে ফেলা হয়েছে, এখনো যাদের পিটিয়ে মারা হচ্ছে, সেসব ঘটনারও বিচার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, খুন খুনই। সেটা ফ্যাসিস্ট সরকারের পুলিশের হাতেই হোক, আর প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার হাতেই হোক। আমরা যদি সাম্য, ন্যায় ও ইনসাফের কথা বলি, তাহলে সব রকম অন্যায়-অবিচার-খুনের ঘটনার বিচার করতে হবে। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিপরীতে যেন ছাত্র-জনতার উন্মত্ততার শাসন কায়েম না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে খুনের বদলা খুন চলতেই থাকবে। গণপিটুনির হত্যা আর গুলিতে হত্যার কোনো তফাত নেই, কারণ দুটিতে মানুষের প্রাণ যায়। আর প্রতিটি প্রাণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পরিবার ও কিছু মানুষের স্বপ্ন। প্রতিটি হত্যার বিচার হোক, খুনিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হোক।
নিজের ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক ভিত্তি পুনরুদ্ধার করতে দেশে কিছু কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এখন হিংসার চাষাবাদ করছে। হুঙ্কার ছাড়ছে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের ছেড়ে দেয়া হবে না। তাদের শায়েস্তা করতে হবে। উচিত শিক্ষা দিতে হবে। প্রয়োজন হলে বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হবে। পিটিয়ে হত্যা করা হবে। গত দেড় মাস ধরে দেশে এই প্রতিহিংসার চর্চা চলছে। দেশজুড়ে এখন কেবল অসংবেদনশীলতার চর্চা। ‘১৫ বছর কথা বলতে দেয়া হয়নি’ ‘জুলাই-আগস্টের গণহত্যাকারী ও তাদের দোসরদের ক্ষমা নেই’ এমন কথা বলে এখন এক শ্রেণির মানুষ চূড়ান্ত স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী আচরণ করছেন। যারা জুলাই-আগস্ট মাসে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তাদের খুঁজে বের করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কেউ আপত্তি জানাবেন বলে মনে হয় না। বরং যে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার করে অপরাধীর শাস্তি বিধান করা হলে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মাত্রই খুশি হবেন; কিন্তু সেসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নতুন করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়।
রাজনীতিটাকেই জীবনের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও মহৎ নির্ণায়ক শক্তি মানতে যারা নারাজ, তারা যদি মানুষের সঙ্গে মানুষের এক অন্যতর সেতু বাঁধার কথা ভাবেন, তা হলেই মার মার রবে তাদের দিকে তেড়ে যাওয়ার অধিকার আমাদের বিন্দুমাত্র নেই; কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই আজ সেই পথে। উন্মত্ত আবেগে ভেসে তীব্র যুদ্ধ যুদ্ধ জিগির তুলছি আমরা, লড়াই-আঘাত-প্রত্যাঘাত ছাড়া অন্য কোনো কথা শুনতেই চাইছি না, কেউ অন্য সুরে বললেই তাকে ফ্যাসিবাদের দোসর তকমা দিচ্ছি। সব মানুষের উপলব্ধি একরকম হবে না। ভিন্ন মত, ভিন্ন স্বর, ভিন্ন উপলব্ধির মানুষকে গলা টিপে চুপ করিয়ে দিব? উপলব্ধি ঠিক হোক বা ভুল, তার উপলব্ধির প্রকাশকে আমরা কোন অধিকারে রুখতে পারি? মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কীভাবে খর্ব করতে পারি? মারামারি-কাটাকাটি ছাড়াও আরও অনেক কিছু ইতিবাচক ভাবতে ইচ্ছা করছে, যাকে তাকেই আমরা ‘লীগ’ বলে দেগে দেব? জনমানসে এমন উন্মত্ততা স্বার্থান্বেষী রাজনীতির স্বার্থ চরিতার্থ করতে পারে; কিন্তু আমজনতার বিন্দুমাত্র উপকার তাতে নেই।
উন্মত্ততা যদি এই পর্যায়ে পৌঁছায়, তবে তা আত্মঘাতী হয়ে উঠতে চলেছে নিঃসন্দেহে। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া, খেয়ালখুশিমতো আরেকজনকে প্রতিপক্ষ বানানো, তাকে অপমান অপদস্থ করা কোনো সুন্দর বিকল্প নয়। এমনিতেই দেশ বর্তমানে নানা সংকটে ধুকছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দরকার অসীম ধৈর্য। নিজ নিজ পরিমণ্ডলে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন। দেশটা আমাদের সবার। সবাই মিলেই দেশটাকে গড়তে হবে। এ সময় হিংসা, উন্মত্ততা, গণপিটুনি মোটেও ভালো কাজ নয়। এতে ভবিষ্যতের গর্ভে আমাদের জন্য লুকিয়ে যে অসীম সম্ভাবনা, তা নষ্ট হয়ে যাবে। স্বাধীনতার নামে হিংসা ও উন্মত্ততার জিগির তুলে সমাজটাকে দূষিত করা হচ্ছে। সে স্রোতে ভেসে সংবেদনশীলতা হয়তো লোপ পাচ্ছে হয়তো অনেক মন থেকে; কিন্তু এখনো সংবেদনশীল মনটাকে ঘুম পাড়িয়ে দেননি যারা, তাদের কণ্ঠস্বরটাকে চাপা দেয়ার চেষ্টা ভয়ংকর। কারণ ওই কণ্ঠস্বরগুলো আশার শেষ সলতে আমাদের কাছে। মনে রাখতে হবে যে, একজন মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয়া কখনো সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। হত্যা হত্যাই। একজন মারলেও হত্যা, দশ জন মিলে মারলেও হত্যা এবং তা অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ। ‘দুঃখজনক’ কিংবা ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ঘটনা আখ্যা দিয়ে গণপিটুনির ঘটনাগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার দিন আর নেই। গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারী ও গণপিটুনিতে মদতদানকারীদের কড়া শাস্তি দিতে হবে।
গণপিটুনি বর্তমানে সংক্রামক রোগ রূপে ছড়িয়ে পড়েছে। দীর্ঘমেয়াদি আইন ব্যবস্থার প্রতি তীব্র অনীহা থেকে মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে; কিন্তু সভ্য সমাজে হাতে আইন তুলে নেয়ার অধিকার কোনো ব্যক্তির নেই, কোনো সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীরও নেই। গণপিটুনিতে মৃত্যুর সংবাদ শুনে নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকলে চলবে না। গণপিটুনির বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ তৈরি করতে হবে। গুজবের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সভ্য সমাজে গণপিটুনি নামক বর্বরতাকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেয়া চলে না। এই নৃশংস আচরণ আদৌ বরদাস্ত করা যায় না। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাজের সব স্তরের মানুষকে গণপিটুনির বিরুদ্ধে একজোট হতে হবে। গণপিটুনির শিকার কাউকে হতে দেখলে নিজের হাত দুটি দিয়ে সন্ত্রস্ত মানুষটিকে আঁকড়ে ধরতে হবে। তবেই একে একে আরও অনেক হাত এসে সেই মানুষটির চারপাশে গড়ে তুলবে দুর্ভেদ্য প্রাচীর। বেঁচে যাবে একটা অসহায় প্রাণ। তবেই এই পৃথিবীকে আগামী দিনের শিশুদের কাছে বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকার সফল হবে আমাদের।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে