মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হয়ে থাকুক ‘বিজয় ফুল’
বিলেতের শিশুরা নভেম্বর মাসে সবার বুকে পপি ফুল দেখে অভ্যস্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি নিজেদের গৌরবগাথা স্মরণ করে কাগজ বা কাপড়ের তৈরি লাল পপি দিয়ে। মূলত কানাডার এক চিকিৎসকের হাত ধরে লাল পপির স্মারক সূচিত হয়। চিকিৎসক লে. কর্নেল জন মাক্রে একটি কবিতা লিখেছিলেন-‘ইন ফ্লানডারস ফিল্ড’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধক্ষেত্র ছিল ফ্লানডারস ফিল্ড। সেখানে ফুটত পপি ফুল, যেন নিহত সৈনিকদের রক্তে ফোটা ফুল। জন মাক্রের মর্মস্পর্শী সেই বর্ণনা জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিয়া মিচিলকে আলোড়িত করে। তিনি লেখেন আরেক অমর কবিতা—‘উই শ্যাল কিপ দ্য ফেইথ’। তিনি এই কবিতায় সবাইকে নভেম্বরে নিজের পোশাকে বুকের কাছে পপি ফুল ধারণের আহ্বান জানান। গোটা ইউরোপ সাড়া দেয় সেই ডাকে। পৃথিবীর অনেক জাতি ও দেশ ফুলের প্রতীক পোশাকে লাগায়।
কবি-শিক্ষক শামীম আজাদের উৎসাহে লন্ডনে বাংলাদেশের দেশপ্রেমী প্রবাসীরা ঠিক করেন শিশুদের অভ্যস্ততাকে কাজে লাগিয়ে তারাও একটি ফুল দিয়ে তাদের বিজয় দিবস উদ্যাপন ও বিজয় দিবসের পাঠ দিতে পারেন সন্তানদের। এসব শিশুর জন্ম বিলেতে। বাংলাদেশ তাদের কাছে কেবলই নানা-নানি, দাদা দাদির ছবি। তাদের কাছে দেশকে তুলে ধরতে, দেশের জন্য ভালোবাসাটা জাগিয়ে তোলার জন্য নানা উপলক্ষে দেশকে হাজির করাটা জরুরি। সেই চিন্তা থেকে বিজয় ফুলের ধারণা ডানা মেলতে থাকে। সহজে আঁকা যায় এমন, আবার রংটা যেন আমাদের জাতীয় পতাকার লাল-সবুজের সঙ্গে মিলে যায়। এই ফুল কোনো গাছে ধরে না, এই ফুল ফোটে হৃদয়ের গভীরে।
দুই.
দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন শামীম আজাদ। একসময় তিনি বাংলাদেশে ‘ফ্যাশন সাংবাদিকতা’-কে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছেন। তার একটি লেখায় তিনি বয়ান দিয়েছেন, ‘কবছর আগের এক শীতার্ত নভেম্বর। হুইলচেয়ারে করে ব্রিটিশ রয়্যাল লিজিওনের হয়ে মহাযুদ্ধের স্মারক টুকটুকে লাল কাগজের পপি বিক্রি করছিলেন ইংরেজ বৃদ্ধ টেড স্টকওয়েল। নিজেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-ফেরত আহত সেনা। তার কাছেই শুনেছিলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর প্রাণহীন বিশুষ্ক ভূমিতে প্রথম ফোটা ফুলের নাম ছিল ‘পপি’। সেই থেকেই হাতে তৈরি ‘পপি’ বিক্রি করে এক ক্যানাডিয়ান নারী তার বিক্রয়লব্ধ অর্থে মৃত সৈনিকদের সন্তানদের জন্য কিনেছিলেন প্রথম ক্রিসমাস উপহার। সেই তো শুরু। এখন পাশ্চাত্যে তা এক বিশাল ব্যাপার!”
এই প্রণোদনা থেকে শামীম আজাদের মনে হলো, একাত্তরের ডিসেম্বরের সেই বিস্ময়কর সময়েই তো ফুটেছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ফুল। পতাকার ঘন সবুজে যে রক্তিম সূর্য উঠেছিল, তারই রূপকল্পেই তো হতে পারে, আমাদের ‘বিজয়ফুল’। ১৯৯৮ সালে প্রথম তিনি ‘বিজয়ফুল’-এর ধারণা প্রচার শুরু করেন। গত কয়েক বছরে যুক্তরাজ্য ছেড়ে এ কর্মসূচি ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিভিন্ন দেশে। বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষাভাষীরা এ কর্মসূচি পালন করছেন। এসব দেশে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিশু-কিশোররা উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ‘বিজয়ফুল’ তৈরি ও বিতরণে কাজ করছে। নবপ্রজন্ম যারা দেখবে তাদের মা-বাবার জামায় ‘বিজয়ফুল; স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে। বাবা ও মায়েরা তখন মুক্তিযুদ্ধের কথা তাদের বলবেন, বলবেন বিজয়ের কথা।
পাঁচটি সবুজ পাপড়ি আর মাঝখানে লাল বৃত্ত তৈরি করতে করতে শিশুরা জানতে চায়, কেন পাঁচটা পাপড়ি, কেন বৃত্তটি লাল? তখনই সুযোগ আসে স্বাধীনতার কথা বলার, দেশের কথা উচ্চারণের। পাঁচটি পাপড়ি দিয়ে কত কিছু বোঝানো যায়! পাঁচটি মৌলিক অধিকার, আমাদের দেশের পাঁচটি প্রধান নদী, আমাদের সমাজের বৈচিত্র্য, নানা জাতিসত্তার অস্তিত্ব।
‘বিজয়ফুলের মূল লক্ষ্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করা। কয়েক বছর ধরে ডিসেম্বর এলেই ১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর প্রতিদিন দেশ-বিদেশের বাংলাদেশিরা নিজেদের জামা, ব্লাউজ, শার্ট, পাঞ্জাবি, টি-শার্টে এ ফুল পরছেন। ইউরোপের শিক্ষাঙ্গনে ও বাংলাদেশি সামাজিক সংগঠন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের এই প্রতীককে ঘিরে করছে মুক্তিযুদ্ধের গল্পবলা, লেখা ও আর্ট ওয়ার্কশপ। আঁকার ছলে কিংবা কেটে কেটে তৈরির সুবাদে খুব সহজেই শিশু-কিশোরদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাস। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা ‘বিজয়ফুল’কে বেছে নিয়েছেন স্মৃতিচারণার সূত্র হিসেবে। কাগজের তৈরি এ সহজ অনাড়ম্বর ফুলটি গেয়ে যাচ্ছে আমাদের একাত্তরের বিজয়ের স্মৃতি!
বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশে ‘বিজয়ফুল কর্মসূচি’ উদযাপিত হলেও ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে এর কার্যক্রম শুরু হয়। ওই বছরের ২৪ নভেম্বর ধানমণ্ডির সাত নম্বর রোডের আড়িয়াল হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে কবি শামীম আজাদ ‘বিজয়ফুল’ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। ঢাকায় প্রায় ছয় হাজার সাইকেল আরোহী ‘বিজয়ফুল’ পরে মিছিল করে। ধীরলয়ে ছড়াতে থাকে দেশের আনাচে-কানাচে। যিনি এ ‘বিজয়ফুল’টা পোশাকে, পকেটে পরবেন, তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তি তৈরি হবে। এ শক্তি হতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ জাগরণ। বিজয় ফুলে বিজয় স্মরণ ধারণ করে আছে আমার দেশ, তার ইতিহাস, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার ঐতিহ্য আর মূল্যবোধ। আমি ধারণ করে আছি সে প্রক্রিয়া সারা বছর আমার হৃদয়ে- ওটাই তো আমার অঙ্গীকার।
লেখক: কলাম লেখক ও সংগঠক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে