বিশ্ব ডাক দিবস
চিঠি নেই, রানার নেই তবুও জেগে আছে স্মৃতি
এইতো সেই নব্বইয়ের দশকেও আমরা প্রিয়জনদের উদ্দেশে চিঠি লিখতাম। হাতেলেখা সেসব চিঠিতে জড়িয়ে থাকত আমাদের সুখ-দুঃখ, আবেগ ও ভালোবাসা। আর চিঠি হাতে পাওয়ার অপেক্ষা ছিল অনন্তকালের মতো- চিঠি নিয়ে কখন আসবেন চিঠিবাহক, সে আশায় যেন ঘুম হতো না। এখন এ আধুনিক সময়ে বদলে গেছে আমাদের অপেক্ষা ও জীবনধারণের পদ্ধতি। এখন আর আমরা চিঠির অপেক্ষায় থাকি না, থাকি না কখন আসবেন সেই পোস্টমাস্টার, যাকে আমাদের পূর্বজন বলত ডাক হরকরা বা রানার, তিনিও হারিয়ে গেছেন ইতিহাসের অতল গহ্বরে।
ডাক হরকরা, এখন সে শুধু আমাদের স্মৃতি হয়ে নস্টালজিয়া করে তোলে গানে, কবিতায়, গল্পে। ‘রানার গ্রামের ডাকহরকরা। রাতের পর রাত ক্লান্তিহীন, মানুষের সুখ-দুঃখের খবরের বোঝা বয়ে পৌঁছে মানুষের দোরে, দোরে; কিন্তু তার খবর কে রাখে?’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তার বিখ্যাত গানটির শুরুতেই রানারকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এভাবে। আর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের তো বিখ্যাত কবিতা- ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম্ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে/রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে, ‘রানার চলেছে, রানার!.../কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।’
এমনকি আমাদের জাতীয় সংগীত সুর, যার সুরে অনুপ্রাণিত হয়ে রচিত, তিনি গগন হরকরা, ছিলেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহের পোস্ট অফিসের একজন ডাক হরকরা। তিনি আবার লোকসংগীতশিল্পীও ছিলেন। একদিন মাঝরাতে ‘আমি কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষ যে রে…’ গানটা গাইতে গাইতে ডাক নিয়ে ফিরছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন কুঠিবাড়ি থেকে সেই গান শুনতে পান। একদিন ডেকে পাঠান গগনকে, শোনেন ওই গানটা। সেই গানের সুরই পরে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানে ব্যবহার করেন কবি। এভাবেই আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জুড়ে আছে ডাক হরকরারা।
রানারের কথা ভাবলেই আমাদের কল্পনায় ভেসে উঠে হাতে একটা লণ্ঠন আর বল্লম নিয়ে রাত-বিরাতে ডাক বয়ে নিয়ে দূর-দূরান্তে যাচ্ছেন এক নিঃসঙ্গ পথিক। বল্লমের মাথায় বাঁধা থাকত ঘণ্টা, যাতে সেই ঘণ্টাধ্বনি শুনে মানুষ বুঝতে পারে রানার চলেছে। কেউ যেন তাকে দেখে চোর-ডাকাত মনে না করে।
রানার রাতের আঁধারে একা চলে। পথে কত ডাকাতি হতো। বিখ্যাত লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রানারের এই জীবন নিয়ে লিখেন কালজয়ী গল্প ‘ডাক-হরকরা’। দীনু ডাক-হরকরার মাথার মাথালী দড়ি দিয়ে চিবুকের সঙ্গে বাঁধা, শক্ত হাতে ধরা বল্লম, অন্য হাতে হারিকেনের কম্পমান শিখার ধোঁয়ার চিমনি কালো রঙ ধরেছে, ডাক-হরকরা তার অভ্যস্ত নির্দিষ্ট গতিতে ছুটে চলছে।
কীভাবে এলো ডাক বা হরকরা
এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীন হাতের লেখা চিঠিটি হলো খ্রিষ্টজন্মের ৫০০ বছর আগের। সাইরাস কন্যা পারস্যের রানী আতোসা সে চিঠি লিখেছেন!
কিন্তু আমাদের এই ভারতীয় অঞ্চলে ডাক ব্যবস্থার অস্তিত্ব বহু প্রাচীন। অথর্ব বেদেতে এর উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সাহিত্য, লোকগাঁথা, ছড়া, কবিতায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। আদিকালে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আপনজনের কাছে খবর প্রেরণের জন্য দূত এবং কবুতর বা পায়রা ব্যবহার করা হতো। প্রেয়সীর কাছে বার্তা পাঠাতে মৌসুমি মেঘ এবং বাতাসকেও দূত হিসেবে ব্যবহার করার কল্পচিত্র এঁকেছেন প্রখ্যাত কবি কালিদাস এবং ধোয়ী তাদের গ্রন্থ ‘মেঘদূত’ ও ‘পবন দূত’-এ। পুরাণেও নল দময়ন্তীর কাহিনিতে হাঁস, রামায়ণে হনুমান, আনার-কলিতে হরিণ প্রভৃতি প্রাণী ও পাখিকে দূত হিসেবে ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে।
ইতিহাস বলছে, প্রাচীনকালে দূতের সামাজিক অবস্থান এতই উচ্চে ছিল যে, দূতকে অন্তরীণ করা, অত্যাচার করা বা হত্যা করা হতো না। কৌটিল্যের অর্থ শাস্ত্রেও ডাক মাশুলের উল্লেখ রয়েছে। মৌর্য রাজাদের সময় দূত বা বার্তাবাহকদের কথা বলা হয়েছে।
বাংলায় ডাক
বাংলা অঞ্চলে ডাক ও ডাকবাহকদের সূত্রপাত হয় সুলতানি আমলে, সময়কাল ১১৮৬-১২০৬। উটের মাধ্যমে সংবাদ আদান-প্রদানের ব্যবস্থা তখন শুরু হয়।
ঘুরি সাম্রাজ্যের অন্যতম সুলতান ছিলেন মুইজউদ্দিন মুহাম্মদ বা শিহাউদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরি। আফগানিস্তানের ঘুর অঞ্চলে তার জন্ম ১১৪৯ সালে। বলা হয় তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, বাংলাদেশ ও ইরান। তার প্রিয়ভাজন একজন দাস কুতুবুদ্দিন আইবেক (১২০৬-১২১০) ছিলেন দিল্লির প্রথম সুলতান। কুতুবুদ্দিনের শাসনামলে দিল্লি থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত আরবদের অনুকরণে এক ধরনের ডাক ব্যবস্থা বা ঘোড়ার ডাক চালু হয়। কুতুবুদ্দিন কতগুলো নতুন শব্দও চালু করেছিলেন যেমন কাসিদ মানে দূত, ধাওয়া মানে রানার, উলাপ বা ঘোড়ায় বহনকারী ইত্যাদি।
এই ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করেন সুলতান আলাউদ্দিন খলজি, যিনি সর্বপ্রথম ডাকচৌকি স্থাপন করেন। ১২৯৬ সালে ঘোড়ায় চড়া এবং পায়ে হাঁটা ডাকবাহকের সাহায্যে তথ্য পরিবহনের ব্যবস্থা চালু করেন। তার সময়ে ডাক বিভাগকে বলা হতো মাহকামা-ই-বারিদ। এই বিভাগে দুজন ডাক কর্মকর্তা ন্যস্ত করা হয়, এদের একজনকে বলা হতো মালিক বারিদ-ই-মামালিক এবং তার সহযোগী নায়েব বারিদ-ই-মামালিক। তিনি প্রতিটি শহরে সংবাদ লেখক (মুন্সি) নিয়োগ করতেন।
মোহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনকালে (১৩২৫-১৩৫১) ডাক বিভাগের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান সূচিত হয়। ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনিতে লিপিবদ্ধ আছে যে, তুঘলক সে সময় দুই ধরনের ডাক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন- ঘোড়সওয়ার ডাকবাহক এবং হাঁটা সাধারণ ডাকবাহক। ইবনে বতুতা লিখেছেন, সিন্ধু থেকে দিল্লি ডাক পরিবহনে অত্যন্ত কম সময় ব্যয় হতো। তুঘলকদের শাসনকালে ডাক বিভাগের কর্মকর্তারা আংশিকভাবে পুলিশের দায়িত্বও পালন করত।
শের শাহ এই ব্যবস্থাকে আরও পরিণত রূপ দিয়েছিলেন। গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড নির্মাণ করেছিলেন দ্রুত যাতায়াতের জন্য। শুধু তাই নয়, তিনি ১৭০০টি ডাকঘর তৈরি করেন, প্রায় ৩৪০০ বার্তাবাহক নিযুক্ত করেন, যাদের কাজ ছিল ঘোড়ায় চড়ে বিভিন্ন জায়গায় খবর পৌঁছে দেয়া ও আনা। এই সময় মির মুন্সি অর্থাৎ রাজকীয় ফরমান, যোগাযোগ ও ডাক বিভাগের সচিব, দারোগা-ই-চৌকি পদাধিকারী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে কাজ করতেন। বিপুলসংখ্যক কর্মচারীর সমন্বয়ে সম্প্রসারিত ডাক ব্যবস্থাকে বলা হতো দিওয়ান-ই-ইনসা। তারিখ-নবিস পদাধিকারী দুজন করণিকের অধীনে নিম্নবর্ণের গোত্র থেকে নিয়োজিত মৈওয়ার নামক কর্মচারীরা শাহী তথ্য আদান-প্রদান করত।
শাসনামল পাল্টালেও মুঘলরা দারোগা-ই-ডাকচৌকি ব্যবস্থা বহাল রাখেন। ডাকচৌকিগুলো মূলত প্রাদেশিক সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে বাংলার রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দিল্লির ডাক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ডাক গ্রহণ ও প্রেরণের জন্য ডাকচৌকির দারোগা নিয়োগ করা হয়। বাংলা থেকে উড়িষ্যা এবং রাজধানী থেকে মুর্শিদাবাদের মধ্যে কবুতরের সাহায্যে ডাক যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
ব্রিটিশ আমলের ডাক হরকরা
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলা পরাজিত হলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে শাসন চলে যায়। নিজেদের স্বার্থে ১৭৬৬ মতান্তরে ১৭৪৪ সালে রবার্ট ক্লাইভ ডাকব্যবস্থা সংস্কার করেন। কলকাতায় একজন পোস্টমাস্টার নিয়োগ করা হয়। কলকাতার সঙ্গে পাঁচটি ডাক যোগাযোগ কেন্দ্রের সংযোগস্থাপন করা হয়। তবে প্রধান সংযোগ ছিল ঢাকা ও পটনার সঙ্গে। এই ব্যবস্থাকে বলা হতো ক্লাইভ ডাক।
তার পরের অন্তর্ভুক্তি ওয়ারেন হেস্টিংসের। তিনি নিয়মিত ডাক ব্যবস্থার আওতায় মাত্র দুই আনার বিনিময়ে বাংলাদেশের মধ্যে ১৬০ কিলোমিটার সীমানায় ডাক প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। এ জন্য ১৩৯টি এলাকায় ৪১৭ জন ডাক হরকরা, ১৩৯ জন মশালচি এবং ১৩৯ জন ঢুলি নিয়োগ দেয়া হয়।
প্রাচীন টেলিগ্রাফ প্রেরণ যন্ত্র
১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ভারতের সব ডাকঘরে মানি অর্ডার ব্যবস্থা চালু হয়। ওই বছর নিয়মিত রেল মেইল সার্ভিস চালু হয়। এর মাধ্যমে স্থানীয় ডাক বাছাই কাজ শুরু হয়। ১৯০৫ সালে বাংলাকে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসামের সমন্বয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হয়। ১৯০৭ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম ডাক সার্কেল গঠিত হয় এবং তৎকালীন সার্কেলের যেসব অঞ্চল এই নতুন সার্কেলের এলাকাভুক্ত ছিল ওইসব অঞ্চলই নতুন সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে এই নতুন সার্কেল আবার আগের পূর্ববঙ্গ ও আসাম সার্কেলের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়।
১৯১১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে বিশ্বের প্রথম উড়ো ডাকের (এয়ার মেইল) ঘটনা ঘটে। হেনরি পেকুয়ে নামের ফরাসি পাইলট এলাহাবাদ থেকে ১৫ কেজি ভার (প্রায় ৬ হাজার চিঠি) নিয়ে উড়ে গঙ্গার অন্যপারে অবস্থিত নেইনিতে পৌঁছে দেন। ১৯২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চিঠিপত্রে মাশুল দেয়ার কাজে দ্রুততা আনার লক্ষ্যে মিটার ফ্র্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে ডাকমাশুল প্রদানের ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৩০-এর দশক ছিল বিমানে ডাক পরিবহনের যুগ। ১৯৩৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা-কলকাতার মধ্যে বিমানে ডাক পরিবহন শুরু হয়। একই দিনে চট্টগ্রাম হয়ে কলকাতা-রেঙ্গুন রুটও চালু করা হয়।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হলে ডাক বিভাগের জন্য ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এই সময় নিয়মিত ডাক পরিষেবা বিঘ্নিত হলে বিভিন্ন অঞ্চলের ডাককর্মীরা ফিল্ড পোস্ট অফিসের মাধ্যমে সহযোগিতা করতেন। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষে ফিল্ড পোস্ট অফিসগুলো গুটিয়ে ফেলে আরও উন্নত স্থানে অবস্থিত ডাকঘরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
এর পরই ভারত ভাগ হয়। ডাকব্যবস্থায় ধীরে ধীরে যুক্ত হয় আধুনিক পদ্ধতি। একসময় হারতে থাকেন ডাক হরকরারা। আর এখন তো চিঠিই লিখতেই হয় না আমাদের! তবু এ একুশ শতকে এসে রানারদের স্মরণ করতে হয় বিনম্রচিত্তে। তারাই যে আমাদের ইতিহাস।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে