Views Bangladesh Logo

মহান মুক্তিযুদ্ধ: সাধু সুধারাম ও তার বিশ ভক্তকুলকে হত্যা

শ্রী শ্রী সুধারাম বাবা এক হিন্দু সাধক। পুরান ঢাকার মানুষের কাছে তিনি বেশ পরিচিত হলেও সারা দেশে রয়েছে তার অগনিত ভক্ত-শিষ্য। হিন্দু সাধক হলেও মুসলমানদের কাছেও তিনি শ্রদ্ধার। তার সম্পর্কে কোনো পুস্তক না থাকলেও স্থানীয়দের মুখে মুখে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। পুরান ঢাকার লোকমুখে শোনা যায়, ১৯৫০-৫২ সালের দিকে তিনি সূত্রাপুরে আসেন। কোথায় তার জন্ম, কোত্থেকে এলেন কেউ জানতেন না। তার কোনো ঘর-বাড়ি ছিল না। ভক্তরাই তাকে আশ্রয় দিতেন বা নিয়ে যেতেন। যাকে তার পছন্দ হতো তার বাড়িতে তিনি থাকতেন। এভাবে পুরান ঢাকার বিভিন্ন বাড়িতে তিনি থাকতেন। অধিকাংশ সময় থেকেছেন সূত্রাপুরে শ্রীধাম পাল নামে এক ভক্তের বাড়িতে। সেই বাড়িতে গড়ে ওঠে সুধারাম বাবার আশ্রম।

আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মীয় পাণ্ডিত্যের জন্য সে সময় পুরান ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার প্রচুর ভক্ত-শিষ্য তৈরি হয়। ভক্তরা বিভিন্ন উপদেশ, ধর্মীয় বিষয়াদি জানার জন্য তার কাছে যেতেন। অধিকাংশ সময় তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন। এসব কাহিনি আমাকে বলছিলেন শাঁখারীবাজারের এক স্বর্ণব্যবসায়ী। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, তিনি কি মারা গেছেন? তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আশ্রম থেকে উধাও হয়ে যান সুধারাম বাবা। স্থানীয়দের বিশ্বাস, তিনি গায়েব হয়ে গেছেন। তিনি সাধারণ কোনো মানুষ নন। তিনি সাধু, আর সাধুদের মৃত্যু নেই। তিনি দেহ পরিবর্তন করেছেন।

এসব শোনার পর তার সম্পর্কে আগ্রহ বাড়তে থাকে আমার। ‘সুধারাম বাবা’ লিখে ইন্টারনেট সার্চ করলে ভোরের কাগজে একটা লেখা পাই। লিখেছেন স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক। তিনি লিখেছেন, ‘সূত্রাপুর এলাকায় একজন হিন্দু সাধক বাস করতেন, শ্রী শ্রী সাধু সুধারাম, যাকে এলাকাবাসী সাধু সুধারাম বাবা বলে ডাকতেন। তিনি সব সময় ধর্মকর্মে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। সূত্রাপুর এলাকার তার ভক্ত শ্রীধাম পালের বাড়িতে তিনি গভীর রাত পর্যন্ত অন্যান্য ভক্তকে নিয়ে ধ্যানমগ্ন থাকতেন। তিনি ছিলেন উদার মনের অধিকারী, পরোপকারী ও সমাজসেবক। এলাকার গরিব ও অসহায় মানুষকে তিনি যথাসাধ্য সাহায্য করতে চেষ্টা করতেন। ঢাকার বাইরেও তার অগণিত ভক্ত ছিল।’

তিনি আরও উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল রাতে সাধু বাবা শ্রীধাম পালের বাড়িতে ভক্তদের সঙ্গে অবস্থান করার সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের স্থানীয় দোসরদের নিয়ে বাড়িটি ঘেরাও করে। তারা শ্রীধাম পালের বাড়িতে অবস্থানরত লোকজনকে বন্দি করার জন্য অগ্রসর হলে সাধু বাবা তার ভক্তদের হত্যা না করার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যদের অনুরোধ করেন; কিন্তু বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা তার কথায় কর্ণপাত না করে তাকেসহ মোট ২০ জনকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাদের বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে গুদারাঘাটে নিয়ে হাত-পা ও চোখ বেঁধে অকথ্য নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে লাশগুলো নদীতে ফেলে দেয়। সে দিনের নির্মম গণহত্যায় নিহত ২০ জনের মধ্যে ৫ জনের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। তারা হলেন শহীদ সাধু সুধারাম, শহীদ শ্রীধাম পাল, শহীদ মনোমোহন চক্রবর্তী, শহীদ অমিয় কুমার চক্রবর্তী, শহীদ জানু কিষান।

বৈশাখী টেলিভিশনে ‘জাগ্রত অহংকার’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র উপস্থাপনা করেন কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক। সেখানে স্থানীয় কয়েকজনের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়, এই বাড়িতেই বসবাস করতেন একজন সাধুবাবা। ভক্তরা শ্রদ্ধা নিবেদন, উপদেশ, ধর্মশিক্ষার জন্য এখানে আসতেন। ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল এই বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সাধুবাবা ও তার বিশজন অনুসারীকে। তাদের অনেকেই ছিল বহিরাগত। তাদের সবার নাম জানা না গেলেও ৫ জনের নাম জানা যায়, যারা এই এলাকার মানুষ ছিল। বাকিরা অন্য এলাকার বলে তাদের নাম সংগ্রহ করা যায়নি।

মনোলাল মোদক নামে স্থানীয় এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, যখন সুধারাম বাবাকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ধরে নিয়ে যায় তখন আমি আশ্রমের গলির লাইটপোস্টর নিচে দাঁড়ানো। তখন দেখি মিলিটারিরা এসে লাথি মেরে আশ্রম ভাঙল-এই আওয়াজটা পেলাম। ধুড়ুম-ধাড়ুম আওয়াজ শুরু হলো। এদিক দিয়ে এলাকাবাসী বলল, তুই জলদি যা। দূর থেকে দেখতে পেলাম সাধুবাবাকে মিলিটারিরা গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেল। সাধু বাবাকে যখন গাড়িতে ওঠানো হলো তখন তিনি বলছিলেন, ‘রক্তের ওপর দিয়ে নৌকা যাবে, রক্তের ওপর দিয়ে নৌকা যাবে।’ তিনি জোরে জোরে চিল্লাইয়া বলছিলেন।

বিমল চক্রবর্তী নামে স্থানীয় আরেকজন জানান, আমার বাবাকে সাধুবাবার সঙ্গে একসঙ্গে মেরেছে। আমার বাবা সাধু বাবার ভক্ত ছিলেন। তিনি স্বর্ণের কাজ করতেন। পরদিন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বাবার লাশ পাওয়া গেছে। আমরা কেউ যেতে পারিনি। কারণ পাকিস্তানি আর্মিরা বলেছিল, সৎকার করতে যে আসবে তাকে মেরে ফেলা হবে। তখনকার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী গোলাম আব্বাস এসব কথা বলেন। স্থানীয় বিমল চক্রবর্তী, মনোলাল মোদক, সুবল চন্দ্র যারা সুধারাম বাবাসহ পাঁচজনের লাশ দেখেছিলেন বুড়িগঙ্গা নদীতে তারা জানান, ঘটনার দুদিন পর বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে আমরা সুধারাম বাবার লাশ দেখেছি হাত-পা বাঁধা অবস্থায়। তার দাড়ি ও জট দেখে আমরা চিনতে পারি। আরও চার-পাঁচটি লাশ ছিল হাত-পা বাঁধা। তখন ভয়ে আমরা বাসায় চলে গেলাম। মিলিটারিরা রাউন্ড দিচ্ছিল।

ইফতেখার পাভেল নামে স্থানীয় একজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক জানান, বাসা থেকে সুধারাম বাবাসহ ১৫-১৬ জনকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে যায়। বুড়িগঙ্গা নদীর কোনো এক জায়গায় অথবা ফরাসগঞ্জ ক্যাম্প হতে পারে- কোথায় মারে এটা কেউ জানে না। লাশ ভাসতে ভাসতে এই ঘাটপট্টিতে (বুড়িগঙ্গা নদীর একটি ঘাট) এসে থামে। তখন এলাকার লোক ও আত্মীয়স্বজন আসে। সেখানে সুধারাম বাবা, স্থানীয় বিমলের বাবা, জাদুসহ অনেকের লাশ ছিল। প্রত্যেকের লাশ একসঙ্গে বাঁধা ছিল। এলাকাবাসী যখন লাশ নিতে চাইল রাজাকার ইয়াছিন চাওলার নেতৃত্বে একদল বিহারি যারা পাকিস্তানিদের দোসর তারা বাধা দেয়। তারা বলে, ‘তোমরা যদি এই লাশ নিয়ে যাও, তাহলে তোমাদের পুরো এলাকা জ্বালিয়ে দিব। তখন কেউ বাঁচবে না। ’

কেন বলল এ কথার উত্তরে পাভেল বলেন, এটা বলল প্রথমতো হলো যে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে পাকিস্তান অথরিটি যে কথাটা বলছিল যে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে স্বাধিকার আন্দোলন- এটা হিন্দুদের ষড়যন্ত্র। এটা প্রপাগান্ডা। যার ফলে ব্যাপকভাবে হিন্দুদের মারা হয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, বাঙালিদের মধ্যে একটা প্যানিক তৈরি করে দেওয়া যে, অপারেশন সার্চ লাইটের নামে যে অপারেশনে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়, বাঙালিরা যেন প্রতিরোধ করতে না পারে। সেই প্যানিকটা তৈরি করার জন্য তারা এ কথাটি বলেছে।

প্রিয় পাঠক, এই হলো সুধারাম বাবা ও তার বিশ ভক্তকে হত্যার ঘটনা। পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে শতবর্ষী শ্রী রাধা মাধব জিঁউদেব বিগ্রহ মন্দিরে রয়েছে বাবা সুধারামের একটি পূজাঘর। তার পাশেই নির্মাণ হচ্ছে শ্রী শ্রী সুধারাম বাবার আশ্রম।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ