রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর
যুদ্ধের প্রভাব থাকবে বছরের পর বছর
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই জয়লাভ করতে পারেনি। আগামীতেও এই যুদ্ধে কোনো পক্ষের জয়লাভের সম্ভাবনা নেই। হয়তো এক পর্যায়ে এই যুদ্ধ থেমে যাবে বা উভয় দেশ যুদ্ধ বিরতিতে সম্মতি প্রদান করবে। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ সেই সুদিনের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করছে। যখনই যুদ্ধ শেষ হোক না কেন, এই যুদ্ধের জের বয়ে বেড়াতে হবে অনেক দিন। যুদ্ধ শুরু হবার পর ইউক্রেন হয়তো আশা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। তাহলে যুদ্ধের মোড় অল্পদিনেই ইউক্রেনের অনুকূলে ঘুরে যেতে পারত।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে এমনটিই ধারণা করেছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো কেউই ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে এবং ইউক্রেনের নিকট অস্ত্র বিক্রি করতে থাকে। ইউক্রেনও হয়তো চিন্তা করেনি যুদ্ধ এতটা প্রলম্বিত হবে। এর মধ্যে ফিলিস্তিন সংকট নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ এখন অনেকটাই সেখানে নিবদ্ধ হয়েছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের তালিকায় ইউক্রেন কিছুটা হলেও গুরুত্ব হারিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে ভেবেছিল দেশটি কাবু হয়ে যাবে। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের পাশাপাশি মার্কিন ডলারে থাকা রাশিয়ার রিজার্ভ আটকে দেয়। রাশিয়া পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেয়। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোকে শর্ত দেয়, রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল ক্রয় করতে হলে তার মূল্য রাশিয়ান মুদ্রা রুবলের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। কোনো কোনো দেশ গোপনে রুবলের মাধ্যমে রাশিয়ান জ্বালানি তেল ক্রয় করতে থাকে। এক পর্যায়ে রাশিয়া জ্বালানি তেল উত্তোলন কমিয়ে দেয়। সৌদি আরবের নেতৃত্বধীন ওপেকভুক্ত দেশগুলোও জ্বালানি তেলের উত্তোলন ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধের পূর্বে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে ৭০ থেকে ৭৫ মার্কিন ডলার। সেই জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেতে পেতে এক পর্যায়ে নাগালের প্রায় বাইরে চলে যায়। জ্বালানি তেলের এই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী পরিবহন-ব্যয় বেড়ে যায়। বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক উচ্চ মাত্রায় চলে যায়।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর বিশ্বব্যাপী যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি শুরু হয়, যার রেশ এখনো বিভিন্ন দেশে চলছে, তার পেছনে খাদ্য বা অন্য কোনো পণ্য উৎপাদন ঘাটতির প্রভাবক হিসেবে কাজ করেনি। বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি শুরু হয় মূলত সাপ্লাই সাইডের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কীভাবে বেড়েছে, পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি দিলেই তা অনুধাবন করা যাবে। উল্লেখ্য, বিশ্বে প্রতি বছর যে পরিমাণ জ্বালানি তেল উত্তোলিত হয় তার এক-দশমাংশ আসে রাশিয়া থেকে। যুদ্ধ শুরু হবার এক মাসেরও কম সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ১২৩ দশমিক ৭০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। একই বছর ৩১ মে জ্বালানি তেলের মূল্য কিছুটা কমে ১১৬ দশমিক ১৫ মার্কিন ডলারে নেমে আসে। একই বছর ১৩ জুন জ্বালানি তেলের মূল্য আবারো বৃদ্ধি পেয়ে ১২২ দশমিক ৩৬ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসে। ২০২৩ সালের ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিক জ্বালানি তেলের মূল্য ৭৩ দশমিক ৮০ মার্কিন ডলারে নেমে আসে, যা যুদ্ধ শুরু হবার সময়ের চেয়েও কম। একই বছর ১৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ৯৪ দশমিক ৫০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি তেলের মূল্য আরও কিছুটা কমে ৮২ দশমিক ৫২ মার্কিন ডলারে নেমে আসে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের এই ওঠানামা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলে। আমরা যদি বাংলাদেশের কথা বিবেচনা করি, তাহলে দেখব, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি করা হয়। সেই সময় বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি উত্থাপিত হলে বলা হয়েছিল আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পেলে স্থানীয় বাজারেও মূল্য সমন্বয় করা হবে। এখানে বক্তব্যের মারপ্যাঁচ লক্ষ্য করার মতো। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পেলে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হবে এটা কিন্তু বলা হয়নি। বলা হয়েছে মূল্য সমন্বয় করা হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি-মূল্য যুদ্ধ-পূর্বকালীন অবস্থায় চলে এলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস বা সমন্বয় করা হয়নি। এটা কি অঙ্গীকার ভঙ্গ করা নয়?
শুধু যে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তা নয়। অন্যান্য সব পণ্যের মূল্যই অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো কোনো দেশ এখনো খাদ্যপণ্যসহ নানাবিধ পণ্যের উচ্চ মূল্যের চাপ বয়ে চলেছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেন মিলিতভাবে বিশ্বের দানাদার খাদ্যের মোট ৩০ শতাংশ জোগান দিয়ে থাকে। যুদ্ধের বছরও ইউক্রেন স্বাভাবিক সময়ের মতো ৬ কোটি টন চাল ও গম উৎপাদন করেছে; কিন্তু সেই গম ও চাল আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করতে পারেনি। খাদ্য পণ্যবাহী ইউক্রেনীয় জাহাজ মাসের পর মাস বন্দরে আটকে থাকে। ফলে বিশ্বের অনেক দেশেই খাদ্যপণ্যের সংকট দেখা দেয়। বিশেষ করে যেসব দেশ ইউক্রেনের খাদ্য পণ্যের ওপর নির্ভরশীল তারা বিপাকে পড়ে।
পরে জাতিসংঘের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এবং তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে খাদ্য রপ্তানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও ততদিন বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) সূত্রে জানা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ফলে উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশের দরিদ্র মানুষগুলো বিপকে পতিত হয়। এফএওর তথ্য মতে, ২০১৯ সালে খাদ্য পণ্যের মূল্য সূচক ছিল ৯৫ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২০ সালে তা কিছুটা বেড়ে ৯৮ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়। ২০২১ সালে তা এক লাফে বৃদ্ধি পেয়ে ১২৫ দশমিক ৮ শতাংশ উন্নীত হয়। ২০২২ সালে তা রেকর্ড মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ১৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ উন্নীত হয়। ২০২৩ সালে অবশ্য খাদ্যমূল্য সূচক কিছুটা কমে ১২৪ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো কোনো সূত্র মতে, গত কয়েক বছরে নতুন দারিদ্র্যের সংখ্যা ১০ কোটিরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। যুদ্ধের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। অধিকাংশ দেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশের মতো কোনো কোনো দেশ এ ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থ হয়েছে। কর্তৃপক্ষ এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দিয়ে চলেছে। অথচ অধিকাংশ দেশ নানা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিকে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নামিয়ে আনতে সমর্থ্য হয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। যেমন তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি ৫৪ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। আর্জেন্টিনায় ৫৫ দশমিক ১ শতাংশ, এস্তোনিয়ায় ২৩ দশমিক ২ শতাংশ, লিথুনিয়ায় ২০ দশমিক ১ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯ দশমিক ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই মূল্যস্ফীতি ছিল বিগত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্যান্য ব্যবস্থার পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়নোর একটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে দেশটির অর্থনীতিতে মন্দা সৃষ্টির আশঙ্কা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) গত দুই বছরে অন্তত ১৩ বার পলিসি রেট বৃদ্ধি করেছে। সিডিউল ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্প মেয়াদে ঋণ বা ধার গ্রহণকালে যে সুদ প্রদান করে তাকে পলিসি রেট বলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি পলিসি রেট বৃদ্ধি করে তাহলে সিডিউল ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণকালে আগের তুলনায় বেশি সুদ প্রদান করতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই সিডিউল ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ উদ্যোক্তা বা সাধারণ ঋণ গ্রহীতাদের প্রদানের সময় আনুপাতিক হারে আগের তুলনায় বেশি সুদ চার্জ করবে। এতে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ তুলনামূলক ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমে যায়। মানুষ চাইলেই আগের মতো পণ্য ক্রয় করতে পারবে না। আস্তে আস্তে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। অর্থনীতির এই সূত্রের একটি নেতিবাচক দিকও আছে। উচ্চ সুদের কারণে ব্যাংক-ঋণের প্রবাহ কমে গেলে উৎপাদনশীল কার্যক্রম বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পলিসি রেট বেশ কয়েক বার বাড়িয়েছে। আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ এখন তা ৮ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন আগ পর্যন্তও সিডিউল ব্যাংকগুলোর ঋণদানের আপার ক্যাপ ছিল ৯ শতাংশ। অর্থাৎ তারা আগের তুলনায় বেশি সুদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করলেও ব্যাংক ঋণের সুদের হার সেই আনুপাতিকভাবে বাড়াতে পারেনি। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ আগের তুলনায় আরো সহজলভ্য হয়েছে। অনেকেই এই সুযোগে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। আগের এক মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ; কিন্তু প্রকৃত অর্জন হয়েছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সেই সময় শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল। তার অর্থ হলো গৃহীত ব্যাংক ঋণ উদ্দিষ্ট কাজে ব্যবহার না করে অন্য কোনো খাতে ট্রান্সফার করা হয়েছে। এমনকি এই ঋণের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলেও অনেকে মন্তব্য করেন।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী যে অস্থিতিশীলতা এবং উচ্চমূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল তা ইতিমধ্যেই অনেকটা কমে এসেছে; কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে এখনো উচ্চমূল্যস্ফীতিসহ অর্থনৈতিক অন্যান্য সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে। সরকার যদিও কথায় কথায় অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করছেন; কিন্তু আসল সমস্যা সেখানে নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণ হচ্ছে সরকার রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এক শ্রেণির মানুষ নানা উপায়ে অবৈধভাবে অর্থ-বিত্ত গড়ে তুলছেন। সেই অর্থ বিদেশে পাচার করছেন।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেনের হার আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছিল ৮ হাজার ৫৭১টি। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ১৪ হাজার ১০৬টিতে উন্নীত হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছিল ৫ হাজার ২৮০টি। তার আগের বছরে এর পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭৬৫টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছিল ৩ হাজার ৫৭৩টি। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সন্দেহজনক ঋণ প্রতিবেদন দাখিল করা হয় ৫২০টি। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ৩৪১টি। তার আগেও তিন বছরে যথাক্রমে সন্দেহজনক ঋণ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছিল যথাক্রমে ৯৮টি, ৯৪টি এবং ৫৯টি। বিদেশের সাবেক এক মন্ত্রীর ২৬০টি বাড়ির সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। চিন্তা করা যায় একজন মন্ত্রী কীভাবে বিদেশে এতগুলো বাড়ি ক্রয় করলেন।
এক সময় বিদেশিরা আমাদের দেশ সম্পদ লুটে তাদের দেশে নিয়ে যেত। আর এখন আমাদের দেশের শিক্ষিত সচেতন এক শ্রেণির দেশপ্রেমহীন মানুষ দেশের সম্পদ লুটে নিয়ে বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এ প্রবণতা দূর করা গেলে অর্থনৈতিক সংকট কখনোই মিটবে না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে