স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা
স্থানীয় উৎপাদনই হতে পারে সমাধান
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেই দেশের প্রান্তিক জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করেছেন প্রফেসর ডা. সামন্ত লাল সেন। একই সঙ্গে, ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবামূলক বিভিন্ন ধরনের পণ্যের সহজলভ্যতার ওপরেও জোর দেন তিনি।
দেশের অন্যতম সেরা চিকিৎসকের পক্ষে যদিও বর্তমান চাহিদা সম্পর্কে জানা খুব কঠিন নয়। তবে বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশ অর্থাৎ, যেখানকার জনগণকে চিকিৎসার জন্য নিজেদের পকেট থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে হয়, সেরকম একটি দেশের জন্য সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়াই সবচেয়ে কঠিন বিষয়।
এ ছাড়া, বর্তমান সময়ে যেখানে ওষুধ ও চিকিৎসার যন্ত্রপাতি আমদানিকারক কোম্পানিগুলো স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যবহৃত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, সেরকম একটি পরিস্থিতিতে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ড. সামন্ত লাল সেন স্বাস্থ্যসেবামূলক পণ্য ও চিকিৎসা-সরঞ্জামাদি দেশেই উৎপাদন করার কথা ভাবছেন।
ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপে মন্ত্রী বলেন, ‘যদিও রাতারাতি এত বড় সমস্যার সমাধান করা সহজ কাজ না, কিন্তু মনে-প্রাণে একজন চিকিৎসক হওয়ায় আমি অন্তত সমাধানের ভিত রচনা করার চেষ্টা করব।’
তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ায়, স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত পণ্যসমূহের মূল্যবৃদ্ধির খবর রীতিমতো উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। তাই সমস্যার সমাধান হিসেবে দেশেই ওষুধ, ভ্যাকসিন ও যন্ত্রপাতি উৎপাদন করা ছাড়া সরকারের কাছে এরচেয়ে ভালো কোনো সমাধান নেই।
তিনি আরও যোগ করেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে স্টেন্টের দাম নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হচ্ছে। তবে এগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা গেলে এর দাম স্বাভাবিকভাবেই অনেক কমে যাবে।’
তিনি জানান, দেশের ওষুধ খাতের উন্নয়ন সম্পর্কে সরকার অবগত এবং এগুলোর দাম কম রাখতে সরকার সবরকম সহযোগিতা করবে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিটিউক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের (বিএপিআই) তথ্য অনুযায়ী, দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোও উৎপাদনব্যয় কমিয়ে এগুলো মানুষের হাতের নাগালের মধ্যে রাখার উপায় খুঁজছে।
বিএপিআই জানায়, দেশে উৎপাদিত অ্যাকটিভ ফার্মাসিটিউক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্টসের (এপিআই) মূল্য ২০১০ সালের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা থেকে চারগুণ বেড়ে ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি হয়েছে।
বিএপিআই সাধারণ সম্পাদক এস এম শফিউজ্জামান জানান, স্কয়ার, বিকন, এসকায়েফ ও বেক্সিমকো-সহ ১৫টি সংস্থা দেশে এপিআই উৎপাদন করে।
যদিও সূত্রমতে, স্থানীয়ভাবে এপিআই উৎপাদনের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় এখনো খুব নগণ্য।
এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশের মানুষ যেন কম মূল্যে ভ্যাকসিন পায় সে লক্ষ্যে বাংলাদেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিষয়ে এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘খুব শিগগিরই তাদের একটি দল বাংলাদেশে আসবে, যেন আমরা নিজেরাই দেশে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারি।’
চিকিৎসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে চলেছি।’
২০২২ সালে, চিকিৎসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম শিল্প জাতীয় শিল্পনীতি- ২০২২এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে সুসমন্বিত প্রবৃদ্ধির জন্য খুব বেশি সহায়তা পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানানো হলে মন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদনকারী কোম্পানি প্রোমিক্সকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মৌসুমি ইসলাম জানান, তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে তাতে করে সাধারণ রোগীরাও উপকৃত হবেন।
তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যবসা বিশেষ করে, প্রযুক্তি-ভিত্তিক ব্যবসার প্রকৃতি বদলে গিয়েছে। আধুনিক মেডিকেল ডিভাইসগুলো অত্যন্ত জটিল ও মাল্টিডিসিপ্লিনারি বা বহু বিভাগীয় পণ্য। এই পণ্যগুলোর ধারণা, নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য প্রয়োজন- বিভিন্ন সরঞ্জাম, প্রযুক্তি, ফ্রেমওয়ার্ক ও মানগুলো সনাক্তকরণ, সংহতকরণ, স্থাপন ও পরিচালনা করা।
সে কারণে, কোম্পানিগুলোকে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে বাধ্যতামূলক কৌশলগত সহযোগিতার সঙ্গে স্থানীয় ও টার্গেট মার্কেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মান তৈরি, গবেষণা ও উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আর তাই এ মুহূর্তে প্রয়োজন সুযোগ-সুবিধা ও সহায়তা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি, সরকারের সদিচ্ছা। যদিও নীতিমালার স্বীকৃতি প্রথম ধাপ, তবে এ খাতের উন্নয়নের জন্য বাজেট ও এনবিআরের মাধ্যমে সরকারি সহায়তা পেলে খাতটি সত্যিকারের গতি পাবে।’
পরিবর্তিত শুল্ক কাঠামো এবং শিল্পের জন্য শুল্ক ভর্তুকি, শিল্পের দ্রুত বিকাশের জন্য অপ্রচলিত পণ্য উৎপাদনের সুবিধা সবচেয়ে সহায়ক হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে তৈরি মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবামূলক পণ্যের জন্যও সুরক্ষার উদ্যোগ নেয়া উচিত।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, স্থানীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজার প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা, কেউ কেউ বলেছেন এটি ১০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। তবে বর্তমানে মাত্র ৬-৮ শতাংশ চাহিদা স্থানীয় নির্মাতারা পূরণ করে থাকেন বলে জানান তারা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে